প্রভূ পুরুষোত্তম সত্তা মহাব্রহ্মান্ডময় সদগুরুর নিকট নি:শর্ত ‘আসলেম’ বা আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তি বা সেই পুরুষোত্তম সত্তায় উত্তরন করার আকুতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর উপরের গানটিতে। তাই শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রিয়ভক্ত অর্জুনকে বলেছেন:
‘সর্বধর্মান্ পরিতাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহংত্বাং সর্ব পাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মাশুচ: \
অর্থাৎ তুমি সকল ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমারই শরানাগত হও; আমি সর্বপাপ থেকে তোমাকে মুক্ত করবো, শোক করো না। কিন্তু এই প্রভুমূখী হতে গেলে আত্মমূখী হতে হয়, নিজের আত্মাকে চিনার দরকার হয়ে পড়ে। পশ্চিমা দেশের বিখ্যাত মরমি কবি ওয়াল্ট হোয়াইটম্যান হাসন রাজার এই সুর ধরেই অনেকটা সেই মূল উৎপত্তিকে লক্ষ্য করেই গেয়ে উঠেছেন:
I celebrate myself, and sing myself,
And what I assume you shall assume,
For every atom belonging to me as good belongs to you.
I loafe and invite my soul,
I lean and loafe at my ease
observing a spear of summer grass.
My tongue, every atom of my blood,
form'd from this soil, this air,
Born here of parents born here from parents the same,
and their parents the same,
I, now thirty-seven years old in perfect health begin,
Hoping to cease not till death.
সকল ধর্মরাশি সম্পূর্নভাবে চিহিৃত-পূর্বক গ্রহন ও বর্জন করেই এই ওয়াল্টম্যানের মতই হাসন রাজা প্রভু পুরুষোত্তমে উত্তির্ন হয়ে পূর্ণমানব-রূপ ধারন করে বলেছিলেনÑ
প্রাণরে মিছে বলি আমি আমি
ভাবনা চিন্তা করিয়া দেখি সকলেই তুমি \
তুমি ঘরে তুমি বাইরে তুমি অন্তর্যামী
মিছামিছি এদিক সেদিক কেন আমি ভ্রমি \
তুমিই জগতের কর্তা তুমি জগৎ স্বামী
হাসনরাজা লোকে বলিয়া করিল বদনামি \
নজরুলের গানে মরমবাদী চিন্তা-চেতনার খবর নিতে গিয়ে হাসন রাজার ভাবনার বার্তা মিলে। নজরুল গেয়েছেন
খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুলখেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে ।
তেমনি হাসন রাজার গানে শুনা যায়:
কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে
রঙ্গের রঙ্গীলা কানাই।
এই কথাটা হাছন রাজার উঠে মনে মনে।
সত্তর দশকের সাহিত্যিক রনজিৎ কুমার সেন হাসন রাজার স্বগত গানকে ভেঙ্গে হাসন রাজার কথাগুলো বললেন: ‘দেশের মানুষ আমাকে যা ইচ্ছা ভাবতে পারে, কিন্তু আমি সেই পরম ঐশী শক্তিরই স্বরূপ দর্শন করে তাঁর গানই কেবল গেয়ে বেড়াই।’ তিনি আরো বলেন: ‘আধুনিককালে কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে এই আইডিয়ার আংশিক বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই আইডিয়ার প্রথম পৃথিকৃৎ যে পূর্ববঙ্গের কবি দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী, তাতে সংস্বয় নেই।’ নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আর হাসন রাজার ‘বিচার করিয়া চাইয়ে দেখি সকলেই আমি’ শীর্ষক কবিতা থেকে সেই একই ভাবনার শ্রোত নির্গত হয়Ñ তা সবাই সহজে অনুমান করতে পারেন। পুরুষোত্তম ঘোষণায় সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে সকল মোহমুক্ত হয়েই কবি নজরুল গেয়ে উঠেছিলেন
আমি মৃন্ময় আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর
আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে,
আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ!!
পুরুষোত্তম নজরুলের এই কবিতা প্রসঙ্গটি আনার সাথে সাথে একটি কৌতুহল জাগে! কবি কাজী নজরুল ইসলাম কখনো কি তাঁর জীবদ্ধশায় হাসন রাজার সন্ধান করেছিলেন? সুরমাত্রায় উজ্জ্বল নক্ষত্র কাজী নজরুল ইসলাম হাসন রাজার উত্তর প্রজন্মের কৃতি কবি। তখন ১৯২৬ সালের মে মাস। ‘গ্রীষ্মের অবকাশের সময় সিলেটে এলেন নজরূল ইসলাম। তবে তিনি এসে উঠেন রায় বাহাদুর রমণী মোহন দাসের বাড়িতে। ঢাকা ও কোলকাতায় চলছে হিন্দু-মুসলমানে ভীষন দাঙ্গা। ...একলিমুর রাজা সাহেব (হাসন রাজার তৃতীয় পুত্র) তাঁকে জোর করেই বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সে-সময় নজরুল ইসলামের সম্বর্ধনা উপলক্ষে একলিমুর রাজা সাহেব যে-কবিতা রচনা করেছিলেন ‘এক তরঙ্গ’ নামে তখন ‘বহিৃবীনা’ নামক সংকলনে সেটি স্থান পেয়েছিলো। তাঁর এ কবিতা আবৃত্তি শুনে নজরুল ইসলাম সত্যি অভিভূত হয়েছিলেন। কবিগুরু ছাড়া নজরুলও হাসন রাজার খোঁজ নিয়েছিলেন যে তার উপরোক্ত খবরটুকু মিলে। প্রসঙ্গত: বলা যেতে পারে অনেকেরই মতে যে, হাসন রাজা ও লালন ফকির রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার। প্রকৃতপক্ষে হাসন রাজার গানের সাথে ঋষিকবির পরিচয় ঘটে ১৯২৪ সালের দিকে যখন হাসন রাজার কিছু গান কবিগুরুর হস্তগত হয়।
সাধক কবি হাসন রাজা নিজেকে জানতে পেরেছিলেন বলে নিজেই ব্রহ্মা প্রতিভূরূপে বিশ্বকর্মার সৃষ্টিতে নিজের আত্মবিশ্বেষণী শক্তিতে উদ্ভাসিত ও উজ্জিবীত হয়ে উঠেছিলেন। ‘সাধক হাসন রাজার এই উপলব্ধি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আকৃষ্ট করেছিল, সম্মোহিত করেছিল এবং হাসন-মানসকে তুলে ধরার জন্যে কবিগুরু যে গানগুলো নির্বাচন করেছিলেন তা একজন উঁচু স্তরের মরমী সাধক হিসেবেই তাঁর পরিচয় দেয়। আবার অনেক সুফি-পন্থীরাও মনে করেন তাঁর এই পুরুষোত্তম-পর্যায়ে উঠে আসা মানেই হলোÑহাসন রাজা অভিন্ন জীবাত্মা আর পরমাত্মার মিলন ঘটিয়েছেন ঐ মহাসত্ত¡ায়। তাঁর আত্মবিচার শীর্ষক কবিতাগুলোতেই ব্রহ্মরূপে আত্মপ্রকাশের সুস্পষ্ট রূপ দেখা যায়। হাসন রাজার মেয়ের দিকের নাতী দেওয়ান ওহিদুর রাজার তাঁর ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারনে বলেনÑ ‘১৯২৬ সালে নজরুলের সিলেট সফর উপলক্ষে হাসন রাজার ‘হাসনউদাস’ গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে কবি আবিষ্কার করলেন হাসন রাজার একটি গান:
‘আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিব শঙ্করী।
আমি যখন উঠি রেগে, দেখে যমদূত ভাগে
আসে না মোর মায়ের আগে, দেখ যেয়ে লক্ষণছিরি।
হাসনরাজার সন্ধান আছে, যম কি আসবে তার কাছে
প্রাণ দিয়েছি হরির কাছে, যম কারে নিবে ধরি’।
গানটি পড়ার পর অবাক হয়ে কবি জানালেন, যে, তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সাথে কোথায় যেনো এর একটি মিল রয়েছে। জানা যায় নজরূল আর একলিমুর রাজার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ট যোগাযোগের কারনেই বিদ্রোহী কবি নজরূল হাসন রাজার পরিচয় পেয়েছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে একটি শ্রদ্ধাবোধ পুষন করতেন। একবার একলিমুর রাজা এবং কবি জসিমউদ্দিনের মাঝে একটি ঝামেলা বাধে এবং নজরুলের সাথে তাঁদেরর উভয়েরই অন্তরঙ্গতার সুত্র ধরেই বিদ্রোহী কবি ব্যাপারটিতে বিচারক ছিলেন। ঝামেলাটি সুরাহা করতে কলকাতায় অবস্থানরত বিচারক কবি নজরুল ইসলাম এবং সুরস¤্রাট আব্বাসউদ্দিন বিষয়টি নিয়ে বসলেন। শেষে তাঁদের দুজনের হস্তক্ষেপে এটি সুরাহার পথ দেখলো। বিজনবিহারী পুরকায়স্থ লিখেন: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার কবিকৃতিকে আন্তরিক প্রশংসা করে গেছেন এবং কাজী নজরুল ইসলামেরও হাসন রাজা সম্পর্কে একটি কৌতুহল রয়ে গিয়েছিল। আপন অস্থিত্ব ধ্যানের মাধ্যমেই সন্ধানী সাধকÑ মনের ধন ও মূল সফল ‘বোধোদয়Ñগুরু’কে বা মহাপ্রভুকে খুঁজে পান। তাই হাসন রাজা গেয়ে উঠেন:
আমার মনের মাঝে আছে ধন
বুঝতে পারবে রে ভাই সুজন।
মনের মাঝের ধন
তারে জান নারে মন,
গুরুর পদে কররে সাধন।
তাইতো সাঁইজি লালন তাঁর কালামে হুঁশিয়ারী করে গেয়েছেন:
‘গুরুকে মনূষ্য জ্ঞান যার
অধ:পাতে গতি হয় তার।’
মন যে অজ্ঞান, আত্মদর্শনের শক্তিতে আদ্যোপান্ত সকল জ্ঞান লাভ করা যায় গুরুজি সম্পর্কে। সে-যে মনের মাঝেই বিরাজ করছে, তা খুঁজে নিতে হয়। সেই আপন সত্ত¡ায় মনের সকল বাহ্য বিষয়কে বর্জন করে অন্তর্দৃষ্টি ফেললেই ‘মরমী আত্মার নির্ভুল আজান ধ্বনি প্রবাহ হতে থাকবে। আর এ ধারাতে কবি নজরূল ইসলামও দিকদর্শন উপস্থাপন করেছেন। নজরুলের আধ্যাত্বিক, মরমি কিংবা ইসলামী গানের সাথে হাসন রাজার গানের সুসামঞ্জস্য কতদুর আছে তা খুঁজে নেয়া কিংবা তার বিশ্লেষন বা গবেষনার ভার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেই রইলো। হাসন রাজা শুধু এক জায়গায় বলেছেন
ও মন রইলে রে ফিকির
দম থাকিতে করলে না ইল্ল¬াহ্ল্ল¬ার জিকির \
লা ইলাহা ইল্ল¬াহ্ল্ল¬া, হৃদ না করিলে
কি উপায় হইবে তোমার ছক্রাতের কালে \
কোরআনের পরিভাষাগত ‘লা ইলাহা ইল্ল¬াহ্ল্ল¬ার’ যখন হাসন রাজার গানে গীত হয় তখন সহজেই অনূমেয় হয় তাঁর অন্তরের অভ্যন্তর থেকে সুস্পষ্ট এবং সুদৃঢ় এই উচ্চারন। বিশ্লেষনে দেখা যায় ‘লা ইলাহা ইল্ল¬াহ্ল্ল¬ার’ মহাকাব্যটির প্রথমাংশ ‘লা-ইলাহ’ ‘নফি’ বা নাস্তি সম্বন্ধীয় (ঘবমধঃরাব) এবং শেষের অংশটি ‘ইল্ল¬াহ্ল্ল¬ার’, যাকে ‘ঈস্বাত’ বা ‘আস্তি’ সম্বন্ধীয় (চড়ংরঃরাব) বলা হয়। ইসলামিক অর্থ বিশ্লেষনে ‘ইল্লাহল্লাহ’ শব্দ আল্লাহকেই সরাসরি ইঙ্গিত করে সুস্পষ্টভাবে। আল্লাহ তথা স্রষ্টা তথা গুরু বা পুরুষোত্তম সত্তারই প্রতীক যিনি একমাত্র উপাস্য।
ইসলামে আছে Ñ ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাক্কাদ আরাফা রাব্বাহু’ Ñ অর্থাৎ নফস্ বা নিজেকে চিনতে পারলে মহান প্রভূকেও চেনা যায়। বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনে আবার ‘নিজ’ বা ‘আত্মা’ই নাথ বা ঈশ্বররূপে বিধৃত: ‘আত্মাহি আত্মানং নাথ, কোহি নাথ পরশিয়া’Ñ অর্থাৎ আত্মা বা নিজেই নিজের শ্রেষ্ট নাথ, অন্য কোনো নাথ বা উদ্ধারকর্তা নেই। বস্তুত: মানবদেহের সজীবতা ও সচলতার জন্যে দেহাভ্যন্তরে যে অদৃশ্য চলৎ-শক্তি (রিষষ-ভড়ৎপব) বিরাজিত, তা-ই আত্মা বলে অভিহিত।’ সংস্কৃত শব্দ ‘আত্মন’ এর পূর্বে ‘অধি’ শব্দ যুক্ত হয়ে ‘অধ্যাত্ম’ শব্দের রুপ নিয়েছে।’ ‘অধি’ এর অর্থ উৎসর্গ। আত্মার স্বরূপ উদঘাটনে আত্মোৎসর্গের নামান্তরই হলো আধ্যত্মিকতা। মূল কথা এই যে, আধ্যাত্মিক মানে আত্মা সম্বন্ধীয় তথা আত্মা ও ঈশ্বর বিষয়ক। সুতরাং আত্মার পরিচয় লাভের মহান ব্রতই হলো আধ্যাত্মিকতা। মনুষ্যত্বের চরমোৎকর্ষ সাধন তথা মানবাত্মার পূর্ণ শুদ্ধিই আধ্যাত্মিকতা। এই চরম উৎকৃষ্ট মানুষটি পরিপূর্ণ মানুষ বা মহামানবÑ ‘আল ইনসানুল কামিল’ বা পুরুষোত্তম হয়ে উঠেন তাঁর সাধন পথে। ইসলামিক সুফিচিন্তায় পুরুষোত্তম ‘আলে মুহাম্মদ’ সর্বজনীন ও সর্বকালীন মহান সত্তা যা জীবনকে শিক্ষাদীক্ষা দান করে ইনসানে রুপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে। তাই মুহাম্মদকে গুরুরুপে যারা মানেন তাঁরাই ইনসানী শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রকৃতরূপে এই মানবদেহেই সুপ্ত ও অজাগ্রত ‘নূরে মোহাম্মদী বা প্রভূগুরু সত্তারূপে মনুষ্যত্ব বিরাজিত। আধ্যাত্মিকতার সাধন পথে এই সত্তারূপকে জাগ্রত করে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করলে অর্থাৎ ‘আশরাফুল মাখলুকাতে’ অন্তর্ভূক্ত হলে তিনি সেই ব্যক্তি ‘নূরে মুহম্মদী’ বা ‘বাকা বিল্লাহ’ পর্যায়ে স্থিত হন। আর এরই আরেক নাম ‘পুরুষোত্তম’ রূপ ধারন করা। হাসন রাজার বহু গানে সেই সর্বশ্রেষ্ট ব্যক্তিস্বরূপের সাথে ‘পুরুষোত্তম’এর একটি মেল বন্ধন রচিত হয়েছে এবং অনেক সময় তিনি তাঁর সাথে একাত্ম হতে পেরেছিলেন বলেও তাঁর গানে আভাস পাওয়া যায়। কবিগুরু এই সত্তাকে চিনে নিয়েই বলে উঠেছিলেন:
অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী
তবু সদা দুরে ভ্রমিতেছি আমি।
সংসার সুখ করেছি বরণ,
তবু তুিম মম জীবনস্বামী।
না জানিয়া পথ ভ্রমিতেছি পথে
আপন গরবে অসীম জগতে।
তবু ¯েœহনেত্র জাগে ধ্রæবতারা
তব শুভ আশিস আসিছে নামি।
পুরুষোত্তম এই গুরুবাদী মানব ধর্ম-দর্শনের মৌলিকত্ব এক এবং অভিন্ন। মহাজাগতিক এই সাধন পথে সাঁইজি লালনের কন্ঠে মহাসত্যই উচ্চারিত হয়েছে:
‘অবতার অবতারী
সে তো স্বভাবে তারি,
দেখো জগৎ ভরি
এক চাঁদে হয় উজালা
ভান্ড বেভান্ড মাঝে
সাঁই বিনে কি খেল আছে
লালন কয়, নাম ধরেছে
কৃষ্ণ-করিম-কালা।
হাসন রাজা অন্যদিকে দেখেছেন এই মহাসত্তাকে নারী পুরুষ ও ভ্রহ্মান্ডের যাবতীয় সব সৃষ্টিকুলের অস্থিত্বের মধ্যে। তাই তিনি গেয়ে উঠেছেন।
কখন কালী, কখন রাধা, কখন গো তারিণী
জ্ঞান চক্ষে চাইয়া দেখি, মা মোর পরাণী \
কালীরূপ ধরিয়া মাগো, অসুর কইলায় নাশ
রামরূপে রাক্ষসগণ করিলায় বিনাশ \
তুমি বাড়ি, তুমি ঘর মা, তুমিই সংসার
তুমি বিনে অন্য জনা কেহই নাই আর \
নানা সময় নানারূপে, অবতার হইয়া
ভক্ত বাঞ্ছা পূর্ণ কর দুষ্টকে মারিয়া \
আবার অন্য একটি গানে গেয়েছেন:
শ্রীকৃষ্ণকে ভাবত যেমন শ্রীমতিও রাধা
সেই মত ভাবলে মিশবায়, না রহিবে জুদা \
মিশলে পরে আয়নুল হক বলিতে নাই বাধা
আয়নুল হক আয়নুল হক হাসনরাজা বলে সিধা \
প্রাণ সই আমিই কানাইয়া হই, আমি হই রাধা
মধ্যেখানে মুল¬া মুন্সিয়ে, কেন দেয় বাধা গো \
আমার মাঝে আমার খোদা, আমি নয়রে সুদা
মুল¬া মুন্সির কথা যত, সকলই বেহুদা গো \
ইসলামিক পরিভাষায় পরামাত্মা নূরেরই অংশ। বস্তুত আল্লাহ সর্বজগৎ ও সর্বসৃষ্টির রব বা সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহর অস্থিত্ব নূররূপী। ইসলামী সৃষ্টিধারায় এই ‘মুহম্মদী নূর’ই থেকে সমস্তের উৎপত্তি। ধর্ম, কর্ম নির্বিশেষে যেকোনো লোকের বংশসম্ভূত শিশু সন্তান তাঁর মায়ের উদরে মানবাকৃতি লাভ করার পরপরই প্রবিষ্ট হয় এই নূরের আংশিক বিজ-উপ্ত রূহ অবস্থায়। সাধকের মধ্যে মূর্তমান হয়ে উঠে এই নূর রূহরূপে। সাধুসাস্ত্রের পরিভাষায় রূহই হলো পরমাত্মা । ইসলাম অথবা সাধন-সূধনের বাইরে অনেক বুদ্ধিজীবিরা অবশ্য একে জ্ঞান, বিবেক অথবা প্রজ্ঞা বলেও অভিহিত করেন। যাইহোক রূহ বা পরমাত্মা এক ও অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু এর প্রকাশ বহুর মধ্যে। রবরূপে আল্লাহ সবার মাঝে বিরাজমান। অদ্বৈতবাদীরা (চধহঃযবরংঃ) আল্লাহতালার পরমসত্তার মধ্যে বিলীনতায় বিশ্বাসী। স্রষ্টার মাঝে একিভূত হয়ে যাওয়ার মধ্যে এদের ব্যাকুলতা একধরনের সাধনা। তবে এই প্রজ্ঞা, জ্ঞান বা ঙৎফবৎ(আদেশ) সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্পিনোজার দর্শনে বলা হয়েছে:
Nature “By substance I understand what is in itself and is conceived through itself”; “By attribute I understand what the intellect perceives of a substance, as constituting its essence”; “By God I understand a being absolutely infinite, i.e., a substance consisting of an infinity of attributes, of which each one expresses an eternal and infinite essence.”
According to the traditional Judeo-Christian conception of divinity, God is a transcendent creator, a being who causes a world distinct from himself to come into being by creating it out of nothing. God produces that world by a spontaneous act of free will, and could just as easily have not created anything outside himself. By contrast, Spinoza's God is the cause of all things because all things follow causally and necessarily from the divine nature. “God is everything and everything is God.”
By Natura naturata I understand whatever follows from the necessity of God's nature, or from any of God's attributes, i.e., all the modes of God's attributes insofar as they are considered as things that are in God, and can neither be nor be conceived without God.
হাসন রাজার গানেও সেই স্পিনজার অদ্বৈতবাদী পরমসত্তা স্রষ্টারই দ্যুতনা পরিলক্ষিত হয় যে পরম স্রষ্টাই সবকিছু এবং সবকিছুই পরম স্রষ্টা। অনেক সময় প্লেটোর পরম স্রষ্টার সকল গুনাগুন ও বৈশিষ্ট্য যাবতীয় সকল বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য আর পরম স্রষ্টার অস্থিত্ব ছাড়া কখনো বস্তুর অস্থিত্ব বুঝা সম্ভব হতো না।
হাসন রাজা বলেছেন:
তুমি ঘরে, তুমি বাইরে, তুমিই সবার অন্তরে
কে বুঝিতে পারে প্রভু, তোমার যে পেছাপেছি \
হাসনরাজার এই উক্তি, সকলই তুই মা শক্তি
তুমি আমি ভিন্ন নহি, একই হইয়াছি \
অথবা
কিসের আশা, কিসের বাসা, কিসের লক্ষণছিরি
(আরে) কিছুই কিছু নয় রে, সকলি গৌর হরি \
ওদিকে প্রাচ্যে সাধারনভাবে বিষ্ণুর অনুগামী অনুসারীরা অথবা প্রকৃতপক্ষে বিষ্ণুভক্ত কিংবা বিষ্ণু-উপাসক ধর্ম সম্প্রদায়কে বৈষ্ণব বলে আখ্যায়িত করা হয়। ‘ভক্তি দ্বারা ভগবৎ অনুগ্রহে মোক্ষলাভ’ই বৈষ্ণব ধর্মের মূলকথা। এ ধর্ম প্রেমের ধর্ম, ভক্তির ধর্ম। অধুনা ভাবগত ধর্ম বলতে সাধারনত: বৈষ্ণব ধর্মকেই বুঝায়।’ ‘পরবর্তীকালে বিষ্ণু কৃষ্ণে পরিনত হলেও মহাভারতের ‘কৃষ্ণ’ ও পদাবলীর ‘কৃষ্ণ’ সম্পূর্ণ পৃথক ভাবধারার প্রতীক।’ শ্রীমদ্ভগবতের মতে শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের অবতার নন, তিনি স্বয়ং ভগবানÑ‘পরমানণং পূর্ণ ব্রহ্ম সনাতনম’। বিষ্ণু এবং কৃষ্ণ একই, তিনি সর্বভূতে সকল সৃষ্টির মধ্যে অনুবিষ্ট বলে তিনি বিষ্ণু, পক্ষান্তরে সর্বভূত ও নিখিলবিশ্বকে নিরন্তর নিজের দিকে আকর্ষন করেন বলে তিনি কৃষ্ণ।’ বস্তুত বৈষ্ণব ধর্মে ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে যে প্রেম সম্পকর্, তা বৈষ্ণব ধর্মে রাধা-কৃষ্ণ এর প্রেমলীলার রূপক চিন্তার মাঝে উপলদ্ধ হয়। বৈষ্ণবদের উপাসক শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান আর রাধা তাঁর ভক্ত আরাধিকা। অর্থাৎ পরমাত্মা হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং জীবাত্মা হলেন সমস্ত মানবাত্মার প্রতীক কিংবা সমগ্র ভক্তকুলের প্রতিনিধি রাধিকা।
গীতায় বিধৃত আছে:
‘অবজানন্তি মাংমূঢ়া মানুষীং তনু মাশ্রিতম
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম’ ( শ্রীমদ্ভগবদগীতা, অধ্যায় ৯ম,
শ্লোক: ১১শ)
অর্থাৎ আমি সকলভূতের ঈশ্বর। আমি মনুষ্যদেহ ধারন করেছি বলে মূঢ় ব্যক্তিরা আমার পরম তত্ত অবগত না হয়ে আমাকে অবজ্ঞা করে। কাজেই কৃষ্ণের নবরূপ তাঁর মায়ামাত্র। আর রাধাই তাঁর অংশ। এরূপ ভাবনা নিয়েই হাসন রাজার কাছ থেকে শুনা যায় একখানা গান:
আমি যে পাগল তোমার, হইছে জানাজানি
ঘরে ঘরে আরিপরিয়ে, করে কানাকানি \
শুন, শুন এগো রাধা, তুমি জগৎ রাণী
রাধা বলিয়ে হিন্দুয়ে ডাকে, আমি নাহি মানি \
আল্ল¬া বিনে কিছু নাই, আর সব ফানী
হাসনরাজা ডাকে তোমায়, রহিম ও রব্বানী \
রহিম ও রব্বানী ডাকে, আর ডাকে ছুবহানী
আল্ল¬া আল্ল¬া বলিয়ে ডাকে, এ বিনে না জানি \
তাই রাধা মানবীয় নয়; ভগবৎ শ্রীমন্মহাপ্রভূ শ্রীকৃষ্ণের অংশ হিসেবেই গোপী প্রধানা রাধার সঙ্গে প্রনয় পর্যায়েই জীবাত্মা পরমাত্মার রূপক প্রেমলীলাই প্রতিষ্টিত হয়েছে ধর্মদর্শন ও ভজন সাধনের মধ্যে। কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান আর ষোলশ গোপিনী তাঁর সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যে তিনি বিচিত্রভাবে ও বিচিত্রবিধায় বিভাসিত। তিনি পিতা-পুত্র-কন্যা-বন্ধু-সখা ইত্যাদি রূপে খেলা করছেন। যেখানে ¯্রষ্টার সঙ্গে মানুষের প্রেমের সম্পর্ক, সেখানে নিয়ম নীতির কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। কাজেই আনুষ্ঠানিক ধর্মের ঠাই সেখানে মেলে না। অনুরাগে প্রেমের উন্মেষ, বিরহবোধে উপলদ্ধি এবং মিলনে সার্থকতা। এ প্রেম জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খন্ডাংশ। বিন্দুস্বরূপ জীবাত্মা তাই পরমাত্মার জন্যে ব্যাকুল। এই ব্যাকুলতার জন্যে জীবাত্মা প্রেমিক, তাই সে রাধা। পরমাত্মার আকুলতা আছে কেননা জীবাত্মাকে বাদ দিয়ে পরমাত্মার লীলাভোগ হয় না। কিন্তু বিশেষ কোনো একক জীবাত্মার জন্যে আকুলতা নেই। কিন্তু একক জীবাত্মা রাধা সদা-উদ্ভিগ্ন, পাছে সে বাদ পড়ে। পরমাত্মা কৃষ্ণের ষোলশ গোপিনী যেমন আছে, তেমনি রাধার কৃষ্ণ ছাড়া তার আর কেউ নেই। হাসন রাজা বলেছেন:
আমি মরিয়া পাই যদি, শ্যামের রাঙ্গা চরণ
[আরে] তবে সে রঙ্গিনী রাধার সাফল্য জীবন \
মরিয়া মরিয়া যদি, শ্যামের নাগাল পাই
রাঙ্গা চরণে ধরি জনম গোওয়াই \
ছাড়াইলে না ছাড়িমু, ধরিমু চরণ
যাহা করে জগন্নাথ, জগৎ মোহন \
হাছন রাজায় বলে, জান যাইবে যখন
সে সময়ে দেখতে চাই যুগল চরণ \
এই প্রেমের পরিনতি একাত্মতায়Ñ যখন বলা চলে ‘আনাল হক’। সূফিদের ভাষায় একে দুইটি পর্যায়ে ‘ফানাফিল্লাহ’ ও ‘বাকাবিল্লাহ’ এবং বৈষ্ণবের কথায় ‘যুগল রূপ ও অভেদ রূপ’ নামে অভিহিত করা হয়। অন্য প্রতিশব্দে একে স্বর্বেশ্বরবাদ বা অদ্বৈতবাদও বলা হয়। এ সাধনার বৈষ্ণবীয় নাম ‘রাধা-ভাব’। তবে সাধারনের জন্য এ সাধনা নয়, কেননা তারা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনকামী নয়। এজন্যে তারা কেবল ‘গোপিভাবে’ সাধনা করবে। অর্থাৎ তাঁরা সুফিদের মতো ¯্রষ্টার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সাধনা করেন না, রাধা-কৃষ্ণের লীলা-সহচর-রুপেই তাঁদের সিদ্ধি। তাই ‘বৈষ্ণব সাহিত্যে ভগবান প্রেমিক আর ভক্ত প্রেমিকা। এই প্রেমের সার্থকতা আবার ‘পরকীয়া-ভাবে’। পরকীয়া নরনারীর মধ্যে যেরূপ প্রেমের তীব্র আকর্ষন করে এরূপ আকর্ষনের তীব্রতা ভক্তের মধ্যে প্রকাশ পেলে তবেই ভগবানকে লাভ করা সম্ভব। তাই হাসন রাজা তার সোনা বউয়ের জন্যেও ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন যা পরমসত্ত¡ায় গিয়ে স্পর্শ করেছে।
সোনা বউ গো বউ তোর লাগিয়া হাসন রাজা ব্যাকুল
হাসন রাজা জানিয়াছে , তুমিই হৃদের ফুল \
সর্বলোকে জানে হাসন রাজা লম্পটিয়া
নিশ্চয় জানিও বউ মোর, নিব যে কাড়িয়া \
বস্তুত: পরকীয়া বলতে যেমন লোকলজ্জাদি উপেক্ষা করে পরপুরুষে আত্মসমর্পন বুঝায়; তেমনি বৈষ্ণব তত্তে¡ ঠিক সেরকম বিষয়-বিত্ত-মুক্ত, ইচ্ছা-প্রবৃত্তি-মুক্ত নিষ্কামচিত্তে ভগবৎ-প্রণয়-জলে ডুবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করলে পরই ‘মহাভাব’এ পরিনত হয়ে থাকে। এই ‘মহাভাবে’র আরেক নাম পরকীয়া প্রেম।
সেন আমলে সৃষ্ট রাজধর্ম রূপী ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপে পড়ে দ্বিধাবিভক্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় অনেকেই তখন হিন্দুদেবতা এবং তাঁদের আচার সংস্কারকে অনেকখানি মেনে নিয়ে, বিশেষভাবে বৌদ্ধ-সহজিয়ারা ব্রাহ্মন্যবাদের প্রভাব-বলয়ে থেকে ‘প্রজ্ঞা উপায়ে’র পরিবর্তে ‘রাধা-কৃষ্ণ’ রূপক চিন্তা-ভাবনাকে তাঁদের ভজন-সাধন রূপে গ্রহন করে এবং বৈষ্ণব সহজিয়া নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেকটি উপসম্প্রদায় গড়ে উঠে। এরা রাধা-কৃষ্ণকে দেবদেবী জ্ঞান না করে প্রকৃতি-পুরুষ রূপে গ্রহন করে। এটা নারী পুরুষের অন্তর্নিহিত সত্তা। উভয়ের যুগল-মিলনই এ সাধনার লক্ষ্য। বৈষ্ণব সহজিয়াগন এই ‘প্রজ্ঞা উপায়’ পর্যায়কে ‘রাধা-কৃষ্ণ’ রূপে বিদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি ও পুরুষ’ এই দুয়ের যুগল মিলনই পরম-তত্ত¡।
চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম মূলতঃ শ্রীমদভাগবতের ওপর প্রতিষ্টিত। প্রাক-চৈতন্যযুগের ভারতীয় বৈষ্ণব ধর্মের চার সম্প্রদায়ের মতবাদ সমন্বয়ে যে এক সার্বজনীন ভক্তিমূলক ধর্মের প্রবর্তন করেন, তাতে বস্তুত: ‘নিষ্কাম কর্ম, স্বধর্ম পালন, সর্বভূতে ভগবদ্ভাব, ভগবানে আত্মসমর্পন ইত্যাদি গীতা-বর্ণীত ধর্মের সারকথা যা ভাগবতেরও মূল কথা।’
বৌদ্ধ যুগের শেষে শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বৈদান্তিক জ্ঞান মার্গ এবং কুমারিল ভট্ট বৈদিক কর্ম-মার্গের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর এই দুই মার্গ-ই কালক্রমে একরূপ নিরীশ্বর হয়ে পড়ে এবং জ্ঞান ও কর্মের সঙ্গে ভক্তির সম্পর্ক ছিন্ন হয়। নিত্য-নৈমিত্তিক-কর্মে ধর্ম-প্রাণতা বিনষ্ট হয়ে ধর্ম-ধ্বজিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কামিনী কাঞ্চনাদির কামনায় কলুষিত চিত্তে ভক্তি বর্জিত এই সকল ধর্ম-কর্ম বা ধর্ম-বাণিজ্য সম্পন্ন হতে থাকে। এই ভাবে যখন ধর্মের গøানি এবং শোচনীয় অবস্থা দেখা দিল, তখনই শ্রীচৈতন্যদেব অবতাররূপে আবিভর্‚ত হয়ে ভক্তিহীন-জ্ঞান ও কর্মমার্গ সম্পূর্ণ পরিহার করে প্রেম-ভক্তি ও হরিনাম প্রচার শুরু করলেন। এর নাম যুগ ধর্ম। এই ধর্মে অধিকার ভেদে ‘রাগানুগা’ ও ‘বৈধী’ ভক্তি এবং ‘নিবৃত্ত-কর্ম’ ও ‘সন্ন্যাসে’র..... সঙ্গে বৈষ্ণব ও স্মার্ত-আচারের সংমিশ্রণে এই ধর্মের স্বরূপ অনেকটা বিমিশ্র হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ‘গোপী ভাবে’র সাধনা চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয়-বৈষ্ণব ধর্মকে বিশিষ্টতা দান করে। এদিকে “ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ হইতে, বাঙ্গালায় সুফি ভাব প্রবণতা গঙ্গাধারার ন্যায় অপ্রতিহত গতিতে প্রবেশ করিতেছিল, পঞ্চাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আসিয়া তাহা চৈতন্যের মধ্যে বঙ্গীয় ভাব-প্রবনতার সহিত পূর্নভাবে মিশিয়া গেল। এই মিশ্র ভাব-বন্যা প্রবাহে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙ্গালাদেশ উপপ্লাবিত হইয়া গিয়াছিল। এখানে দেখা যায় চৈতন্যদেবের ভক্তি ও প্রেমের ধর্ম প্রচার অনেকখানি গভীরভাবে এবং ব্যাপকভাবে সুফিদের জীবনাদর্শের সাথে মিলে যায়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক বাবু প্রমথ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, “ভারতবর্ষের মধ্যযুগের এই নব বৈষ্ণব ধর্ম্ম (অর্থাৎ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম) সনাতন হিন্দু ধর্ম্মের একটি নবশাখা মাত্র। তবে এই নবত্বের কারণ, মুসলমান ধর্ম্মের প্রভাব। মুসলমান ধর্ম যে প্রধানতঃ ঐকান্তিক ভক্তির ধর্ম্ম একথা কে না জানে? ভারত বর্ষের মধ্যযুগের বৈষ্ণব ধর্ম্ম যে মুসলমান ধর্মের এতটা গা-ঘেষা, তার কারণ পাঁচশ বৎসর ধ’রে হিন্দু ধর্ম্ম ও মুসলমান ধর্ম্ম পাশাপাশি বাস করে আস্ছিল। তাই বলা হয়ে থাকে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম মূলত সুফি দর্শনের প্রভাবে সৃষ্ট উদার এক ভক্তিমূলক সর্বজনীন ধর্ম।
যাহোক, চেতন্যদেব যে এক সার্বজনীন ধর্ম-আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন, তার মধ্যে উচ্চ-নীচের বর্ণভেদ, হিন্দু-মুসলমানের জাতিভেদ কিংবা কোন ধরনের অস্পৃশ্যতার স্থান ছিল না। তিনি ¯েœহ-প্রেমের সওদা বিতরণ করে এবং সবাইকে বুকে স্থান দিয়ে তখনকার অবক্ষয়মান হিন্দু সমাজকে রক্ষা করেন। ঈশ্বরে ভক্তি ও প্রেমই ছিল তার মূল ভিত্তি। ‘ভগবানে ভক্তিসম্পন্ন তথাকথিত নীচ জাতিকে ভক্তিহীন-উচ্চবর্ণ-ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ মনে করা হল। তাঁকে স্মরণ বা হরিনাম কীর্তনই এই ধর্ম পথের মূলক্রিয়া। ব্যক্তিগত জীবনে চৈতন্যদেব ত্যাগ-তিতীক্ষা দেখালেন, ভগবদ্্-প্রেমে তাঁর তন্ময়-ভাব, সর্বভূতে সমান দৃষ্টি এবং দয়া প্রদর্শন, সব জাতিতে বর্ণে সকল লোকের সমান আসন নির্দিষ্ট করে জোর দেয়া এই ধর্মের বিশেষত্ব ছিলো। তাই উপেক্ষিত ও নির্যাতিত হিন্দু সমাজের তথাকথিত অস্পৃশ্য লোকগন এই ধর্মে ক্রমে দিক্ষীত হতে থাকে।
‘শাক্ত তান্ত্রিকতার নানা অনুষ্ঠানাচ্ছন্ন সমাজের আবহাওয়ার মধ্যে একটা সহজ-সরল-ক্রিয়াহীন ‘হরের্নামৈব কেবলম’ ধ্বনি উত্থিত হল। চৈতন্যদেবের একান্ত ভক্তিমূলক ধর্ম সর্বসাধারণের ধর্মে পরিণত হল।’ শ্রীচৈতন্যদেবকে সাধারণত একজন নব ধর্ম প্রচারক কিংবা গৌড়ীয়-বৈষ্ণবমতের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সমকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত বিলুপ্ত-প্রায় বৈষ্ণব ধর্মেরই পুনঃউদ্ধার এবং তার সংস্কার সাধন করেন। যার প্রেক্ষিতে তৎকালীন বৈষ্ণব পথের পথিক বৃদ্ধ অদ্বৈতাচার্য এবং চৈতন্যদেবের বয়োজ্যেষ্ঠ নিত্যানন্দ তাঁর সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করলেন। ফলে নানা স্থান থেকে আরো অনেক বৈষ্ণব-ভক্ত জুটতে থাকেন। এঁদের মধ্যে শ্রীবাস, গদাধর, মুকুন্দ প্রমুখ ছিলেন তাঁর পার্ষদ। অনেক দুষ্কৃতকারী হীন ব্যক্তিও তাঁদের প্রভাবে পাপাচার পরিহার করে বৈষ্ণবমত গ্রহণ করে। অতঃপর চৈতন্যদেবের প্রধান-পার্ষদ নিত্যানন্দ ও ভক্ত হরিদাসের মাধ্যমে তিনি নব-দ্বীপে সংস্কারকৃত বেষ্ণব ধর্ম তথা প্রেম-ভক্তির ধর্ম প্রচার শুরু করলেন। এদিকে তাঁর তিরোধানের (১৫৩৩ খ্রি.) পর বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীÑ সনাতন, রূপ, জীব, গোপালভট্ট, রঘুনাথদাস, রঘুনাথভট্ট এঁরা নানা পান্ডিত্য প্রদর্শনে এক সূ²-তত্ত¡ ও দর্শন যুক্ত করে প্রচলিত বৈষ্ণব ধর্মকে চৈতন্য ধর্ম বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব-ধর্ম-রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-গোস্বামীদের জনসাধারনের মধ্যে চৈতন্যদেবের ‘প্রেম-ধর্ম প্রচার এবং সেই সঙ্গে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের প্রচার-প্রসারের ফলে বাংলার ধর্মাকাশে এক প্রকার প্রেমের ঝর উঠে। সহজিয়া বৈষ্ণবগন এই প্রেমকে তাঁদের এই ধর্ম-সাধনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। ফলে সহজ-সাধনায় প্রেমের একটি প্রধান ভূমিকা নির্দিষ্ট হয়। শ্রীচৈতন্যদেব বা গৌরাঙ্গের এই প্রেমধর্ম হাসন রাজার প্রানে একধরনের বাজনার ধ্বনি তুলেছিলÑ তা নীচের গানটিতে স্পষ্টই বুঝা যায়:
বাজনা বাজে, বাজনা বাজেরে
বালা গৌর গৌরাঙ্গ বলিয়া বাজে বাজনা বাজে
হাসনরাজা নাচতে আছে, তার মাঝেরে \
হাসনরাজার ডাকতে আছে গৌর গৌর বলে
প্রেমের মাতাল হাসনরাজা, পরে হেলে দুলে রে \
এই দেখিয়া হাসনরাজার গুষ্টি মরে লাজে
ধরিয়া না রাখতে পারে, নাচে সবার মাঝেরে \
নাচে নাচে হাসনরাজা, উঠিয়া দেয়রে ফাল
গৌর চান্দ গৌর চান্দ বলিয়া হইছে বেহাল রে \
এই প্রেমের সঙ্গে ভক্তির সমন্বয় সাধিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মানুষের প্রানের ঠাকুরে রুপান্তরিত হলেন। আর রস-লীলার মূর্তমান-বিগ্রহে পরিনত হলেন শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। তিনি যেন রাধা-কৃষ্ণের যুগল প্রেমের প্রতীক। রাধার ভাব-কান্তি নিয়ে কৃষ্ণই যেন এখানে আবির্ভূত হলেন। সিলেটের প্রখ্যাত অধ্যাপক মুসলিম চৌধুরী মনে করেন: ‘এই হাসিকান্না, নাচলাফ ইত্যাদির মর্ম বুঝিতে হইলে যাবতীয় সংস্কার মুছিয়া ফেলিয়া সরল প্রেমসিক্ত হৃদয়ে অগ্রসর হইতে হয়। টাকাআনাইপানাই এর মনোবৃত্তি যাহাদিগকে পাইয়া বসিয়াছে, যাহারা নিরন্তর বিষয়তরঙ্গে হাবুডুবু খাইতেছে তাহাদের কাছে এসব দৃশ্য অদ্ভূত ঠেকিবে।’ ভবের মায়াজালে জড়িয়ে পড়েছেন বলেই তিনি তাঁর প্রেমাস্পদের সাথে মিলিত হতে পারছেন না । অল্পদিনের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মায়াজালের সকল বন্ধন ছিন্ন করে বেড়িয়ে আসতে পারছেন না বলে তিনি নিজেকে বন্দী অবস্থায় দেখছেনÑ
মায়াজালে পাগল কৈল হাসনরাজারে
মায়াজালে পাগল হইল রে \
আমারে করিল পাগল, আর করলো ভাইয়ারে
ইষ্টি কুটুম পাগল, করলো দেখ চাইয়ারে \
সুন্দর সুন্দর মায়াজাল গো জানে বড় ছন্দি
কিনা মন্ত্র পড়িয়া হাসনরাজা করল বন্দী \
হাসন রাজার প্রিয়াকে ‘ধরতে গেলে না যায় ধরা’ এবং যে ‘লাগাইছে প্রেমের বেরা আড়ালে থাকিয়ারে’ কিংবা যার রূপ দেখে ‘চিরাবারা হাসন রাজার বুকের মাঝে কুটে’Ñএই প্রাণপ্রিয়ার স্বরূপটি চিনতে হলে নিছক ধ্যানের দ্বারা সম্ভব নয়, প্রেমসায়রে ডুবে তারে চিনতে হয়। উপমহাদেশের মুসলিম বিজয়ের পর হিন্দুু-মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্ম-সংস্কৃতির ত্রিমূখী সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিন ভারতে, অত:পর উত্তর ভারতে এবং সবশেষে বাংলাদেশে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর বাহ্যরূপে ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন হয়। ইসলাম থেকে উৎসারিত সুফিবাদই এ-সব আলোড়নের শক্তি ও প্রেরনা যোগিয়েছে। ফলশ্রæতিতে এই প্রেরনার মর্মমূল থেকে ‘ভক্তিবাদ’, ‘সন্তধর্ম’, ‘শৈব ধর্ম’, ‘বৈষ্ণব ধর্ম’ প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্ম বা উপধর্মের উদ্ভব ঘটে। বাংলার বাউল মতবাদের বীজ এর-মধ্যে নিহিত থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘বাউলরা গুরুবাদী কিন্তু বেদ-বিরোধী অর্থাৎ প্রথাগত শাস্ত্রীয় ধর্মাচার তাঁরা মানেন না। তাঁদের মধ্যে জাতীভেদ প্রথা বা শ্রেনীবৈষম্য নেই। বর্তমানে তাঁরা গৃহত্যাগী বা সন্যাসী এবং গৃহী বা সংসারী এই দুই শ্রেনীতে বিভক্ত। এই বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার মূল ভিত্তি হচ্ছে মিথুনাত্মক যোগ-সাধন পদ্ধতি। এদের সাধনা দেহ-কেন্দ্রীক। এদের কাছে দেহভান্ড হলো ব্রহ্মান্ড। তাঁদের বিশ্বাস এই দেহ-মন্দিরেই বিরাজ করেনÑ প্রানের ঠাকুর সেই পরম পুরুষ।যা বাউল পরিভাষায় ‘মনের মানুষ’। কেউবা একে বলেছেন, সহজ মানুষ, রসের মানুষ, প্রানের মানুষ, ভাবের মানুষ, অটল মানুষ, অচিন পাখি, মন মনুয়ারা, নিরঞ্জন প্রভৃতি। আর হাসন রাজা একে বলেছেন মন মনিয়া, মন ময়না এবং অন্তিম এক পর্যায়ে গিয়ে একে তাঁর এক চরম প্রজ্ঞারূপে আখ্যায়িত করেছেন তাঁর নিজের নামের সাথে মিশিয়ে ‘হাসনজান’ রূপে যা পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। কেননা এই পরমসত্ত¡া-সম্পর্কীয় নামটি যেনো তাঁর নিজের একান্ত সত্ত¡ার সাথে আন্তরিকভাবে একটি সম্বন্ধ-সুত্রের বন্ধনে আবদ্ধ।