ক্ষণিক সময়ের সাথে একাত্মতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে এবং তাঁর ও তাঁর প্রেমাস্পদের মধ্যে পার্থক্য অনুভব করে, তিনি তাঁর মনকে অন্তর্লোকে নিবদ্ধ করেন। তাঁর মানসের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ তিনি মানসচক্ষে অবলোকন করে তাঁর এ রোগের বিভিন্ন উপসর্গ আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। ....যদিও এ রোগের উপসর্গ আপাতদৃষ্টিতে ছিলো সাংঘাতিক, তবুও প্রেমাস্পদের দর্শন লাভে সব জ্বালা যন্ত্রণার উপশম হয় এবং তাঁর স্বাভাবিক অবস্থা লাভে তিনি সক্ষম হন। সে প্রেমাস্পদের দর্শনলাভে বরং হাসনরাজার জীবনে অভূতপূর্ব আনন্দের সৃষ্টি হয়
হাসনজানের মুখ দেখিয়া ফাল্দি ফাল্দি উঠে
দিনে রাইতে হাসনরাজার চিড়া-বাড়া কুটে \
এ প্রেমের প্রতিক্রিয়া প্রেমিকের জীবনে কিভাবে দেখা দেয়? হাসনরাজার উত্তর এ ক্ষেত্রে অতিশয় স্পষ্ট
পিরীতের মানুষ যারা, আউলা ঝাউলা হয় যে তারা
হাসনরাজা পিরীত করিয়া, হইয়াছে বুদ্ধি হারা \
পিরীতের এমনি ধারা, মনপ্রাণ করেছে সারা
আরও করে কারা কারা, লাগল যারা পিরীতের বেড়া \
এখানেই হাসনরাজার প্রেমতত্তে¡র পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর কাছে প্রেমের মধ্যে এমন একটি শক্তি রয়েছে, যারা কার্যকারিতায় দেহ ও মন উভয়েই বিনষ্ট হয়। তবে এ বিনাশের অর্থ ব্রহ্মে বিলীন হওয়া বা মহাশূন্যে নির্বাণ লাভ নয়। এর সোজা অর্থ কামনা-বাসনার পরিসমাপ্তি। এ স্থলে বিনাশের অর্থ সত্যিকার আত্মার বিনাশ নয়। তথাকথিত দেহের সঙ্গে সর্বতোভাবে বিজড়িত নফসের বিনাশ।’ এ প্রসঙ্গে সেক্সপিয়র বলেছেন
The Lunatic, the lover and the poet
Are of imagination all compact.’
হাসন রাজা তাঁর প্রেমাস্পদকে বলেছেন ‘অন্তরিয়া’। অন্তর্লোকে যাঁর বাস; অন্তরে যাঁকে তিনি উপলব্ধি করেন; মানসচক্ষু দিয়ে যাঁকে দেখেন, তিনিই তো হাসন রাজার অন্তরিয়া। ‘মনের মানুষ’এর এই প্রতিশব্দ হাসন রাজারই উদ্ভাবন। এই অন্তরিয়াই হাসন রাজার আল্লাহ, খোদ, মৌলা, হরি, গৌরহরি শ্যাম, ঠাকুর, প্রাণবন্ধু। তিনিই তাঁর মুর্শিদ। তিনিই তাঁর প্রেমাস্পদ। তিনিই তাকে ভব-তরঙ্গ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। তিনিই তাকে দিদার দিয়ে ‘প্রেমের আগুন’ নেভাতে পারেন।
পিরীত মোরে করিয়াছে দেওয়ানা।
হাসন রাজা পিরীত করিয়ে হইয়াছে ফানা।
আরি পরি সকলেরই হইয়াছে জানা।
হাসন রাজা লাগিয়াছে শ্যাম পিরীতির টানা।
হাসন রাজা শুনে না তোর কট্্ মুল্লার মানা।
এই কামনা বাসনার উর্দ্ধে থেকেই হাসন রাজা যে প্রেমে আবিষ্ঠ হয়েছেন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বৈরাগ্য দেখা দেয়। এ-মরজগতের অনিত্যতা কেবল তাঁকে এ জগতের প্রতি বীতস্পৃহ করেনি, এই পর্যায়ে এ সংসারের মোহ ও ভোগ বিলাস থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে।
কিসের আশা, কিসের বাসা, কিসের সংসার
মইলে পরে ভাবিয়া দেখ, কিছু নয় তোমার।
কিসের আশয় কিসের বিষয়, কিসের জমিদারি
কিসের হয় রামপাশা, কিসের লক্ষণছিরি।
ছাড় ছাড় হাসনরাজা, এই ভবের আশা
এই চিন্তা কর পাইতায় (বন্ধের) চরণ তলে বাসা।
হাসন রাজা তাই এ সংসারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন ভিন্ন করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ‘তবে এ স্তরেও হাসন রাজা স্বস্তি লাভ করতে পারেননি। নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি বুঝতে পেরেছেন এগুলোর মাধ্যমে সত্যের সঙ্গে তার মিলন সম্ভবপর নয়। তিনি পূর্বেই উপলব্ধি করেছেন শরীয়তের বিধান পালন করেও যে প্রেমাস্পদকে পাওয়া যায় না। তার জন্য প্রেমের প্রয়োজন, আবার প্রেমানলে জ্বলে গিয়েও সে প্রেমাস্পদের সাড়া পাওয়া যায় না। সে যন্ত্রণা দেয়। পার্থিব বিষয়ের প্রতি আসক্তি ত্যাগ ব্যতীত তার সঙ্গে মিলন সম্ভব নয়। হাসনরাজা বৈরাগ্যের চরম স্তরে যেয়ে তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলিত হতে সক্ষম না হয়ে সর্বশেষ স্তরে বিচার বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করেন। তা থেকেই হাসন-মানসের সর্বশেষ পর্যায় আরম্ভ হয়। তখন থেকে প্রেমিক ও বিবাগী হাসনরাজা দার্শনিক হাসন রাজাতে পরিণত হন। এ পর্যায়ে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে হাসন রাজা তাঁর আপন সত্তা সম্বন্ধে বিচার-করা কালে, সর্বসাধারণে প্রচলিত দেহ-মনের সম্পর্কে ভিত্তিভূমি বলে গ্রহণ করেছেন। দেহ ও মন দুটো সত্তারূপে তার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। তারা পরস্পরের উপর ক্রিয়াশীল। তবে যদিও মানব জীবনে দেহ ও মনের সমান গুরুত্ব রয়েছে, আপতদৃষ্টিতে দেখা যায় মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার আত্মার মাঝেই পাওয়া যায়। হাসন রাজা তাঁর নিজের আত্মাকে দেহের মাঝে বন্দী অবস্থায় দেখে কেঁদে আকুল হয়েছেন
মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে-
কান্দে হাসনরাজার মন মুনিয়ারে
মায়ে বাপে বন্দি কইলা খুশীরও মাঝারে
লালে ধলায় বন্দি হইলা, পিঞ্জিরার মাঝারে
বন্দি আত্মার এ অসহায় অবস্থা হাসন রাজাকে ভাগ্যবাদীতে পরিণত করেছে। হাসন রাজা প্রথম দিকে জীবাত্মা ও পরম আত্মার এরূপ বিরাট সম্বন্ধ অনুভব করেননি। বরং পরমাত্মার হাতে জীবাত্মাকে এক অসহায় ঘুড়ির মতো বলে ধারণা করেছেন। কাজেই এখানে তাঁর আত্মা আর বন্দি বিহঙ্গও নয়। ঘুড়িও নয়। সে মুক্ত, সে স্বাধীন। সে আর দেহের খাঁচায় ছঁটফট করে মরছে না, বরং দেহের মাঝেই তাঁর স্বতন্ত্র সত্তা বিরাজ করছে। একই সত্তা নানাবিধ রূপে দেখা দিয়েছে। এ দেহ থেকেই শক্ত আর নরম, ঠান্ডা আর গরমের যেমন উৎপত্তি হয়েছে, তেমনি এ দেহের বর্ণ থেকে মুসলমানী দীনের উৎপত্তি। কাজেই একই দেহের নানাবিধ অঙ্গ থেকে পার্থিব, অপার্থিব, জড় ও অজড় নানাবিধ বিষয়ের উৎপত্তি বলে, দেহ তার জড়তা হারিয়ে অপূর্ব রূপ ধারন করেছে। তেমনি মনও তার পূর্বের স্বরপ হারিয়ে অন্য গুণে গুণান্বিত হয়েছে। অর্থাৎ তার জীবনে দেহ ও মন বলে দুটো পৃথক সত্তা আর থাকেনি, একই সত্তার কার্যকরী দুটো দিক থেকেই এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সব কিছুরই উৎপত্তি হয়েছে। আধুনিক দর্শনে আল ফ্রেড নর্থ হোয়াইট-হেডের বহু পূর্বেই দেহ ও মনের পার্থক্য অস্বীকার করে হাসন রাজা জড় জগতের নানাবিধ বিষয় এবং মানস জগতের নানাবিধ বিষয়ের পার্থক্য এক হিসেবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর এ ধারণার অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে বলা যায়, দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারিতাগত পার্থক্য থাকতে পারে; তবে এর ফলে তারা একেবারে পরস্পর বিরোধী সত্তা নয়।
দেহ-মনের এই পারস্পরিক কার্যকারিতার সম্পর্কে হাসন রাজা নিজেকে বিচার বিশ্লেষনে আবিষ্কার করেছেন যে তিনি প্রেমাষ্পদের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত এবং আনন্দের আতিশয্যে আত্মহারা হয়ে উঠেন। ড. মোমেন চৌধুরীর মতে, ‘তিনি গভীরভাবে খোদাপ্রেমে প্রত্যয়ী। তাঁর মতে, প্রেমহীন বাহ্যিক কৃত্যাদির দ্বারা খোদা-প্রাপ্তি অসম্ভব। তাঁর গানে সেই প্রত্যয়েরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
খোদা মিলে প্রেমিক হইলে
পাবে না, পাবে না খোদা, নমাজ রোজা কইলে \
খোদা যদি ধরতে চাও, তাঁর সঙ্গে পিরীত বাড়াও
মিলিবে মিলিবে খোদা, প্রেমে তাঁর মজিলে \
প্রেমে একাগ্রতা না থাকলে তাঁকে পাওয়া যাবে না। প্রকৃত প্রেমাস্পদ ও প্রেমিকজনের মধ্যে আর কোনো ভেদাভেদ নেই। তারা একই বিষয়বস্তুর দুটো দিক মাত্র। মুসলিম জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জালালউদ্দীন রুমী বলেন
Think not that God is distinct from me.
Open clear eyes and look upon me,
That you may behold the light of God in a mortal.
Tho Beloved once called the ka’ba ‘My house,’
But has said to me ‘O my servant’ seventy times;
O Bayazid, you have found the Ka’ba,
The World takes it being from me, not I from it
রুমির মতই হাসন রাজা তাঁর সেই পরমসত্তায় খেলা খেলতে এসে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির মূলে তিনি নিজেকে নিজে খুঁজে পেয়েছেন। সব ঠা’য়ে, সব অস্থিত্বে যেনো তাঁরই উপস্থিতি। তাই আত্মগর্বে গেয়ে উঠেন:
আমিই মূল নাগর রে
আসিয়াছি খেইড় খেলিতে, ভব সাগরে রে \
আমি রাধা, আমি কানু, আমি শিব শঙ্করী
অধর চাঁদ হই আমি, আমি গৌর হরি \
খেলা খেলিবারে আইলাম এ ভবের বাজারে
চিনিয়া না কোনজনে আমায় ধরতে পারে \
আমিই মূল, আমিই কোল, আমি সর্ব ঠাঁই
আমি বিনে এ সংসারে আর কিছু নাই \
নাচ নাচ হাসনরাজা কারে কর ভয়
আমিত্ব ছাড়িয়া দিয়া জাতে হইছ লয় \
তখনকার সমাজে হাসন রাজা ধর্মের গোড়ামিতে একটি মিথ্যাচারের চর্চা দেখতে পেয়েছিলেন যা আজো বিদ্যমান। সুনামগঞ্জ সিলেট এমন কি সারা বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলের নানান জায়গায় ‘জামাতে নামাজ’ তথা ‘সালাহ’ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে দলবদ্ধ যে জনগুষ্টি মসজিদমূখী হতেন, তাদের অনেককেই আবার পরনিন্দা, পরচর্চা আর ছুগুলকারীতায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যেতো। এ বিষয়টি একাগ্রচিত্তে পর্যবেক্ষন করে হাসন রাজা সজাগ হয়ে উঠেছিলেন Ñতা নীচের গানটিতে ফুটে উঠেছে। এ-ক্ষেত্রে ছুগুলকারীদের অভ্যাসের পরিনাম কি হতে পারে!Ñতাও তিনি ভালভাবে জানতেন। জামাতে অংশগ্রহনের লক্ষ্যই হলো দলবদ্ধ হয়ে পরমাত্মা তথা স্রষ্টার কাছে পরম অনুরাগ-প্রেমের মধ্য দিয়ে দয়া-করুনা ভিক্ষা চাওয়া এবং তাঁকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে তাঁর সান্নিধ্য ও পরম প্রীতি লাভ করা