তিনি প্রেমের প্রয়োজন বোধ করেছেন সবার জন্যে। শুধুমাত্র সত্যিকার প্রেমই এই হিংসা বিদ্বেস ছল-চাতুরির নিরসন ঘটাতে পারে। আজরফ সাহেব লিখেছেন, ‘বাইরের এ তপস্যা বা প্রার্থনার এ সংশোধন দ্বারা অন্তিম সময়ে কোনো লাভ হবে না। অন্বেষণকারীর আন্তরিকতা এবং তার হৃদয়ের পবিত্রতাই মুমিনের মুক্তির দুটো মাধ্যম। তবে এগুলোর সঙ্গে প্রেমও যুক্ত হওয়া চাই। প্রেম কেবল হাসনরাজার কাছে নয়, সকল শ্রেণীর মুসলিম মরমীবাদীর কাছে সত্য লাভের একমাত্র মাধ্যম এ প্রেম থেকেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি।’
হাসন রাজার প্রেমের স্তরভেদগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আজরফ সাহেব একটি পরম্পরা টেনেছেন তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে: ‘শরীয়তের অনুশীলন ও ভুয়া শরীয়তপন্থীর সমালোচনার স্তর থেকে হাসনরাজা প্রেমের স্তরে উপনীত হয়ে, প্রেম সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা ও প্রেমের কার্যকারিতা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রেমের বাজারে বিকে মানিক সোনারে
যেই জনে চিনিয়া কিনে লভ্য হয় তার দুনারে \
সুবুদ্ধি ও সাধু যারা, প্রেম বাজারে যায় যে তারা
নির্বুদ্ধিরা ভব-বাজারে, বেগার খাটিয়া মরে রে \
* * * * * *
মানিক রত্ম না কিনিলাম, প্রেম বাজারে যাইয়া
ভব-বাজারে বোকার মত রহিয়াছে চাইয়া \
হাসনরাজায় বলে আমার কি লিখিয়াছ ললাটে
যা লিখিয়াছে নিরঞ্জন সেকি আর মিটেরে \
এখানে তিনি বৈষ্ণব-রীতিপদ্ধতির ভিতর থেকেই বৈষ্ণবীয় ভাব-সাধনার এই গীতিকাব্য ‘প্রেমের হাট’ নামক এই গানটির নীচে কবি নিজের স্বাক্ষর দিয়েছেন ‘হাসনউদাস’ নামে। প্রেমের হাটে রতœ মানিকের ছড়াছড়ি। যে এই রতœকে চিনতে পেরে কিনতে পেরেছে তার তিনগুন লাভের সওদার সম্ভাবনা। এ বাজারে অপ্রেমিকের ঠাঁই নাই। এখানে আশ্রয় নিতে পারলেই জীবনের বুনিয়াদ একেবারে পাকা হয়ে গেল। নিরাশার চরম সুরও দেখা দিয়েছে এখানে। ললাটের লেখা কখনোই মুছে ফেলা যায় না। প্রেমের রাজ্যে হাসন রাজা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রবেশ করেননি। প্রেমই অনিবার্য আকর্ষণের দ্বারা প্রেমাস্পদের পানে তাঁকে টেনে নিয়েছে। তাঁর কাছে প্রেম ভীষণ জ্বরের মতো। সে জ্বরে হাড়-মাংস সব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় :
প্রেম জ্বরে, আমি মরি গো, প্রেম জ্বরে-
এগো প্রেম জ্বরে প্রাণ যায়-এখন কি যে করি গো।
প্রেমের গরজেই হাসনরাজা মাঝে মাঝে আপনাকে বিকিয়ে দিতে গিয়ে তিনি নিজেকে একটি সুন্দরী কুমারীর সঙ্গে তুলনা করে তাঁর প্রেমাস্পদের নিকট নজরানা স্বরূপ প্রেরিত হতে চাচ্ছেন;
বিকাইলেনি ঐ বন্ধে কিনে গো সজনী সই-
সই গো বিকাইলেনি ঐ বন্ধে কিনে?
তিনি নিজেই জানেন না, তাঁর এ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হৃদয়ের কি পরিণতি ঘটেছে। এ জন্য তিনি চিৎকার করে বলেছেন:
তার লাগি মন আর ধৈর্য্য না মানে
না জানি কি কৈল মোরে মন মোহনে গো।
ক্ষণিক একাত্মতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে এবং তাঁর ও তাঁর প্রেমাস্পদের মধ্যে পার্থক্য অনুভব করে, তিনি তাঁর মনকে অন্তর্লোকে নিবদ্ধ করেন। তাঁর মানসের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ তিনি মানসচক্ষে অবলোকন করে তাঁর এ রোগের বিভিন্ন উপসর্গ আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। ....যদিও এ রোগের উপসর্গ আপাতদৃষ্টিতে ছিলো সাংঘাতিক, তবুও প্রেমাস্পদের দর্শন লাভে সব জ্বালা যন্ত্রণার উপশম হয় এবং তাঁর স্বাভাবিক অবস্থা লাভে তিনি সক্ষম হন। সে প্রেমাস্পদের দর্শনলাভে বরং হাসনরাজার জীবনে অভূতপূর্ব আনন্দের সৃষ্টি হয়
হাসনজানের মুখ দেখিয়া ফাল্দি ফাল্দি উঠে
দিনে রাইতে হাসনরাজার চিড়া-বাড়া কুটে \
এ প্রেমের প্রতিক্রিয়া প্রেমিকের জীবনে কিভাবে দেখা দেয়? হাসনরাজার উত্তর এ ক্ষেত্রে অতিশয় স্পষ্ট
পিরীতের মানুষ যারা, আউলা ঝাউলা হয় যে তারা
হাসনরাজা পিরীত করিয়া, হইয়াছে বুদ্ধি হারা \
পিরীতের এমনি ধারা, মনপ্রাণ করেছে সারা
আরও করে কারা কারা, লাগল যারা পিরীতের বেড়া \
এখানেই হাসনরাজার প্রেমতত্তে¡র পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর কাছে প্রেমের মধ্যে এমন একটি শক্তি রয়েছে, যারা কার্যকারিতায় দেহ ও মন উভয়েই বিনষ্ট হয়। তবে এ বিনাশের অর্থ ব্রহ্মে বিলীন হওয়া বা মহাশূন্যে নির্বাণ লাভ নয়। এর সোজা অর্থ কামনা-বাসনার পরিসমাপ্তি। এ স্থলে বিনাশের অর্থ সত্যিকার আত্মার বিনাশ নয়। তথাকথিত দেহের সঙ্গে সর্বতোভাবে বিজড়িত নফসের বিনাশ।’ এ প্রসঙ্গে সেক্সপিয়র বলেছেন
‘ÔThe Lunatic, the lover and the poet
Are of imagination all compact.’
’
হাসন রাজা তাঁর প্রেমাস্পদকে বলেছেন ‘অন্তরিয়া’। অন্তর্লোকে যাঁর বাস; অন্তরে যাঁকে তিনি উপলব্ধি করেন; মানসচক্ষু দিয়ে যাঁকে দেখেন, তিনিই তো হাসন রাজার অন্তরিয়া। ‘মনের মানুষ’Ñএর এই প্রতিশব্দ হাসন রাজারই উদ্ভাবন। এই অন্তরিয়াই হাসন রাজার আল্লাহ, খোদ, মৌলা, হরি, গৌরহরি শ্যাম, ঠাকুর, প্রাণবন্ধু। তিনিই তাঁর মুর্শিদ। তিনিই তাঁর প্রেমাস্পদ। তিনিই তাকে ভব-তরঙ্গ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। তিনিই তাকে দিদার দিয়ে ‘প্রেমের আগুন’ নেভাতে পারেন।
পিরীত মোরে করিয়াছে দেওয়ানা।
হাসন রাজা পিরীত করিয়ে হইয়াছে ফানা।
আরি পরি সকলেরই হইয়াছে জানা।
হাসন রাজা লাগিয়াছে শ্যাম পিরীতির টানা।
হাসন রাজা শুনে না তোর কট্্ মুল্লার মানা।
এই কামনা বাসনার উর্দ্ধে থেকেই হাসন রাজা যে প্রেমে আবিষ্ঠ হয়েছেন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বৈরাগ্য দেখা দেয়। এ-মরজগতের অনিত্যতা কেবল তাঁকে এ জগতের প্রতি বীতস্পৃহ করেনি, এই পর্যায়ে এ সংসারের মোহ ও ভোগ বিলাস থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে।
কিসের আশা, কিসের বাসা, কিসের সংসার
মইলে পরে ভাবিয়া দেখ, কিছু নয় তোমার।
কিসের আশয় কিসের বিষয়, কিসের জমিদারি
কিসের হয় রামপাশা, কিসের লক্ষণছিরি।
ছাড় ছাড় হাসনরাজা, এই ভবের আশা
এই চিন্তা কর পাইতায় (বন্ধের) চরণ তলে বাসা।
হাসন রাজা তাই এ সংসারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন ভিন্ন করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ‘তবে এ স্তরেও হাসন রাজা স্বস্তি লাভ করতে পারেননি। নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি বুঝতে পেরেছেন এগুলোর মাধ্যমে সত্যের সঙ্গে তার মিলন সম্ভবপর নয়। তিনি পূর্বেই উপলব্ধি করেছেন শরীয়তের বিধান পালন করেও যে প্রেমাস্পদকে পাওয়া যায় না। তার জন্য প্রেমের প্রয়োজন, আবার প্রেমানলে জ্বলে গিয়েও সে প্রেমাস্পদের সাড়া পাওয়া যায় না। সে যন্ত্রণা দেয়। পার্থিব বিষয়ের প্রতি আসক্তি ত্যাগ ব্যতীত তার সঙ্গে মিলন সম্ভব নয়। হাসনরাজা বৈরাগ্যের চরম স্তরে যেয়ে তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলিত হতে সক্ষম না হয়ে সর্বশেষ স্তরে বিচার বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করেন। তা থেকেই হাসন-মানসের সর্বশেষ পর্যায় আরম্ভ হয়। তখন থেকে প্রেমিক ও বিবাগী হাসনরাজা দার্শনিক হাসন রাজাতে পরিণত হন। এ পর্যায়ে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে হাসন রাজা তাঁর আপন সত্তা সম্বন্ধে বিচার-করা কালে, সর্বসাধারণে প্রচলিত দেহ-মনের সম্পর্কে ভিত্তিভূমি বলে গ্রহণ করেছেন। দেহ ও মন দুটো সত্তারূপে তার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। তারা পরস্পরের উপর ক্রিয়াশীল। তবে যদিও মানব জীবনে দেহ ও মনের সমান গুরুত্ব রয়েছে, আপতদৃষ্টিতে দেখা যায় মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার আত্মার মাঝেই পাওয়া যায়।