হাসন রাজা ছিলেন একজন উদার অসাম্প্রদায়িক এক সাধক কবি। সকল সম্প্রদায়ের সমন্বয় সাধন ছিলো তার জীবন-ব্রত। ভেদাভেদ ভুলে তিনি মানুষের মিলন কামনা করেছেন। তার কাব্যেও সেই ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে গবেষক রামানন্দ বলেনÑ ‘ভগবানের শরণাগত হইয়া যে ভক্তির পথে আসিল, তাহার পক্ষে বর্ণাশ্রম বৃথা। কাজেই ভগবতভক্ত খাওয়া-দাওয়ায় কেনো বাছাবাছি করিবে? ঋষিদের পূজিত পরমেশ্বর ভগবানের নামে কেন সবার পরিচয় হইবে না? সেই হিসাবে সবাই তো ভাই, সবাই এক জাতি। ভক্তি দ্বারাই শ্রেষ্ঠতা, জন্ম দ্বারা নহে।’ আর এই ভক্তিরসে হাসন রাজাও উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। কোনোদিকে তার ভ্রæক্ষেপ ছিল না। তার জীবন বৈচিত্র্যে ‘হিন্দু মুসলমান দুটি ঐতিহ্যের ধারা হাসন মানসে মিলিত হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণের প্রেমতত্ত¡ বা উপনিষদের ব্রহ্মতত্বের ভাবগুলি তার জীবন দর্শনে ছায়াপাত করেছিল। চতুর্দিকের হিন্দু সমাজ আর নিজ মুসলিম গন্ডী এই দুয়ের মধ্যে বিরোধ দেখেননি হাছন রাজা। হিন্দু বনেদি ঐতিহ্যের অন্তর্গত নানা ধ্যান ধারনার মহাভান্ডার তার মানসে ক্রিয়াশীল ছিল। আর দৈন্দিন মুসলিম জগত তাঁকে আত্মপ্রকাশের ভাষা যুগিয়েছিল।’ হাসন রাজার পূর্বপরুষ তার প্রপিতামহ হিন্দু বংশসম্ভূত ছিলেন, যিনি পরে মুসলিম ধর্মে দিক্ষীত হন। তার থেকেই হিন্দু-মুসলমানকে একত্রে সমানভাবে দেখার একটি উদার মনোভাব এই পরিবারের ঐতিহ্য ছিল। তিনি হিন্দু মন্দির স্থাপনে ভূমি দান করেছিলেন। এমন কি তার ‘মায়ের শ্রাদ্ধের সময় প্রজারা তাঁকে প্রায় ১২০টি গরু দিয়েছিল। কিন্তু হিন্দুদের ধর্মসংস্কারে যাতে আঘাত না লাগে এই জন্যে একটি গরুকেও তিনি বধ করতে দেননি।’
অমিয়শঙ্কর চৌধুরী ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘কলিকাতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনÑ ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্যর মূল ধরে নাড়া দিয়েছেন মনসুর বয়াতি। হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই যে বাঙ্গালী এই সহজ কথাটি এর আগে অন্য কেউ প্রকাশ করেন নি।’ উনবিংশ শতাব্দীর একবারে প্রাচীন ধারার একজন মুসলিম কবি মুন্সি বেলায়েত হোসেন, থাকতেন কলকাতার শিয়ালদহ অঞ্চলে। তার চিন্তার স্বচ্ছতা এত বিশ্ময়কর যে, লক্ষ্য করা যায় হাছন রাজার সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চিন্তার ঐক্য। তার বইটি ‘ফেছানায়ে আজায়েব’ বা ‘জানে আলম্ আঞ্জেমন্্ আরা’ ‘ফার্সি ভাষায় লেখা ‘ফসানা-ই-আজায়েব’ এর বাংলা পদ্যানুবাদ (পয়ারে)..বইটি মুসলমানী রীতিতে ছাপা অর্থাৎ ডানদিক থেকে শুরু হয়ে বাঁ দিকে শেষ। ‘বস্তুত নিখিল মানুষের যে জাত, হাসন রাজা সেই জাতের মানুষ। কোন বিশেষ সম্প্রদায়ে, বিশেষ জাতিতে, বিশেষ বংশে জন্মগ্রহন করলেও সেই ক্ষুদ্র গন্ডি কখনও তাদের সংকীর্ণ পরিধিতে আবদ্ধ রাখতে পারে না, মানুষমাত্রের সঙ্গেই থাকে তাদের সহজ সরল স্বাজাত্যবোধ।’ হাসন রাজার জন্য সবার দ্বার উন্মুক্ত ছিল। তিনি জনপ্রতিনিধি না হয়েও নিজ গুণে জনপ্রতিনিধিরও অধিক ছিলেন।
হাসন রাজা তার পরিবার সদস্যগণের মাঝেও একটি চলাফেরা আর উঠাবসার একটি অভ্যেস চালু করিয়েছিলেন। একদিন ‘বোরকা না পরে খোলামুখে হাজী বিবি তার দুই ভাইঝি, আম্মা ও খালাআম্মাকে বোরকা পরিয়ে নিয়ে এসে হাজির। তারাও এসে বঙ্ক বাবুকে রীতিমত পা ছুইয়ে সালাম করলেন। অমুসলমান হিন্দু মুরুব্বিদের সালাম করতে আমরা বা হাসন রাজার পরিবারের লোকেরা গোড়াতেই অভ্যস্ত ছিলাম।’ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের এই বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, হাসন রাজার সন্তানেরা এ-ব্যাপারটিতে খুবই সজাগ ছিলেন। তার সন্তানদের শিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলা হয়েছিল এমনভাবে যে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টানসহ যে কোনো ধর্মাবলম্বী মুরব্বিগনকে যেন যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। হাসন রাজার জীবনেও এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে যা আমাদের বাঙালির কৃষ্টি ও সভ্যতার সঙ্গে ভীষণভাবে মিল। সমাজ ও পরিবারে একটি সুন্দর সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এরকম আচার-ব্যবহার তিনি জিইয়ে রেখেছিলেন।
শুধু ধর্ম-নির্বিশেষে নয় জাত কুল নির্বিবাদে হাসন রাজার সব মানুষকে সমান মর্যাদা দান করতেন। সুদুরর জয়পুরের মাড়োয়ারী মহিলার প্রতি যে মমত্ববোধ দেখিয়েছেন, অন্যদিকে সুনামগঞ্জ শহরে খাসিয়া সম্প্রদায়ের পরিবারের পূনার্বাসন তিনি সাদরে আহŸান জানিয়েছেন। মুহম্মদ আব্দুল হাই বলেছেন. ‘নি¤œস্তরের বেদেদের সাথেও তিনি সহজভাবে মেলামেশা করতে মোটেই ভ্রæক্ষেপ করতেন না।’
লক্ষণশ্রীতে হাসন রাজার বাড়ি ছিল একেবারে নদীর কূল ঘেঁষে। নদীর ক‚লে একদল লোক বাস করতো। তাদেরকে ‘জলাবাসী’ বলা চলে। সারি সারি অনেক নৌকাতেই ছিল বাস। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেব জানিয়েছেনÑ ‘এদের মধ্যে তিন শ্রেণীর লোক ছিলো। তবে সর্বসাধারণের কাছে তাদের সাধারণ পরিচয় ছিলো গায়েন। এদের মধ্যে এক দলের পেশা ছিলো মেয়েদের দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে চুড়ি, জলেভাসা সাবান, মিঠাই, সুগন্ধি তৈল প্রভৃতি তৈরি ও বিক্রি। দ্বিতীয় দল ছিলো সাপুড়ে। ওদের ছেলেমেয়েরা উভয়েই মাথায় সাপের ঝাঁপি নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং সাপের খেলা দেখাতো। তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা ছিল মালবৈদ্য। মেয়েদের পেশা ছিলো দাঁত থেকে পোকা বের করা, হাতে পায়ে রসবাত হলে শিঙ্গা লাগিয়ে তা বের করে আনা। তাদের জীবন হাসন রাজার কাছে আকর্ষণীয় ছিল বৈকি।’
এ গ্রন্থের অনেক জায়গায় হাসন রাজার জাত্যাভিমানের অভাবের কথা প্রত্যক্ষভাবে না বললেও পরোক্ষভাবে অনেক আলোচনা হয়েছে। তিনি যে সাধারণ মানুষের সাথে এত সহজভাবে মিশতে পারতেন, কোনো ঠাঁট বাটের ধার ধারতেন না।
একদিন হাসন রাজা নদী পাড় হয়ে সদরগড়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। যেখানে তার হাতি ও ঘোড়ার আবাসস্থল ছিল। এগুলো বেশিরভাগ গাছের সাথে বাঁধা থাকতো। সেখানে পরিদর্শন করতে গিয়ে সারিসারি অনেকগুলো নৌকার বহর দেখেন। কৌতুহল নিয়ে তিনি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কারা? কোথা থেকে এসেছে? উত্তর পেলেন ঢাকার মুন্সিগঞ্জ ও সাভার থেকে। এই বহরটা নাকি একটি ভাসমান বেদেপলী। ওদের জীবন আঙ্গিকে ভ্রমণ, সাপ ও গানের সাথে নিবিড় সম্পর্ক। হাসন রাজা আগ্রহভরে তাকে সাপখেলা দেখানোর অনুরোধ করলেনÑ ‘আমাকে সাপের নাচ দেখাও ও গান শুনাও, বকশিষ পাবে’। শুরু হলো গানের পালা। গানের তালে তালে সাপের ক্ষীণ শরীরের নাচন। পরবর্তীকালে বহুদিন পর্যন্ত হাসন রাজার কান থেকে সে শব্দের আওয়াজ শেষ হয়ে যায়নিÑ ‘রে...ইয়ে বিধির কি হইল।’ এই সাপুড়ে স¤প্রদায়ের প্রতি হাসন রাজার বড় রকমের মমত্ববোধ গড়ে উঠেছিল বলে তিনি ভেবেছিলেন এই অঞ্চলে যদিও এই স¤প্রদায়টি অত্যন্ত সংখ্যালঘু, তথাপি সমস্ত আঞ্চলিক ও সামগ্রিক সামাজিক পরিবেশে সকল স¤প্রদায়ের জন্য এরা শোভনীয় ও উপকারী। সেজন্যেই হয়তো পরবর্তীকালে হাসন রাজা সোনাপুর, লালপুর, ভাদেরটেক এবং আরো সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা-অঞ্চলে এদের আবাসস্থল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
আরেকবার রামপাশায় হাসন রাজা এই বেদেদের নিয়ে আরেকটি ঘটনায় জড়িত পড়েছিলেন। শোনা যায় রামপাশার পার্শবর্তী গ্রাম নধারের খাল ধরে যখন নইলাবিলে রেরুচ্ছিলেন তখন হঠাৎ তার কানে গেলো একটি কুড়ার আওয়াজ। হাসন রাজা বজরাটি তীরে লাগিয়ে ডাঙ্গায় উঠে পড়লেন এবং আওয়াজটি অনুস্মরণ করে একটি বেদে নৌকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। নৌকায় ছিল একটি কোড়া। বেদেরা তখন তাদের দুপুরের আহার খাচ্ছিল। তিনি কুড়া দেখবেন কি, সেখানে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই হাসন রাজার সামনে অতি সাধারণ আহার পানিভাতের একটি থালা তার সামনে তুলে ধরা হলো। হাসন রাজার পাইকপেয়াদারা শঙ্কিত হয়ে জানালো ‘সাহেব এ খেতে পারবেন না, কিন্তু হাসন রাজা তাদেরকে ধমক দিয়ে সেই থালাটি হাতে নিয়ে কয়েক লোকমা ভাত তার মূখে পুরে দিলেন। সাথের পলকদাস বাবু বললো, সাহেব এরা বেদে জাত! কি করে আপনি এ স্পর্শ করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, এরা আর আমি যে স্বজাতি লোক। আমরা সবাই কুড়া পাখি ধরি আর লালনপালন করি।
মানবসমাজে জাতে-জাতে শ্রেনীতে-শ্রেনীতে ভেদাভেদ রয়েছে তা হাসন রাজা ভালোভাবেই জানতেন এবং সে ভেদাভেদ তিনি নিজের আচরণ দিয়ে নিরসের চেষ্টা করতেন। হাসন রাজা ঘোষণা দিয়েছিলেন শ্রেণীহীন বিভেদহীন প্রাণভরা আলোকিত মনের মানুষেরা যদি জাতেজাতে একজাতের হয় তাহলে তার গানের মর্মার্থ সহজেই বুঝা সম্ভব হবে।