পরিবার পরিচিতি

পারিবারিকভাবে যে ক’জন মানুষ হাসন রাজার জীবনে ঘনিষ্টভাবে নানানরকম জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বাবা আলী রাজা, মা হুরমতজাহান বিবি এবং দু-ভাই এক-বোনসহ তাঁর এক ভাতিজা। তাঁদের কিছু প্রসঙ্গ এখানে না বললেই নয়, কেননা এরা কোন কোন সময় মা বাবা ভাই বোন হিসেবে তাঁর জীবন অঙ্গনে ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আলী রাজা (১৮০০-১৮৭১)

হাসন রাজার পিতা আলী রাজা। তাঁর ১৩ বছর বয়সে পিতা দেওয়ান আনোয়ার খাঁন মাত্র ৩৮ বছরে ইহলোক ত্যাগ করেন। (আলমনুর রাজা, আজিজুর রাজা সুত্রে) তথ্যটি দেওয়ান গনিউররাজা প্রদত্ত তথ্যের সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই সময় মাতা দৌলত জাহান বিবি ৯ মাসের অন্তসত্বা ছিলেন। বাবার মৃত্যুর প্রায় এক মাস পরেই কনিষ্ট পুত্র দেওয়ান আলী রাজার জন্ম হয়। জন্মাবদী পিতৃহীন সর্বকনিষ্ট সন্তান আলী রাজা পরিবারে তাঁর বড় ভাই আলম রাজা ও দুই বোনের মাঝে তিনি ছিলেন অতি আদরের। বাবার অসিয়তে তাঁর নাম রাখা হয় আলী রাজা। বাপহারা এই সন্তানকে মাতা দৌলতজান প্রানের অধিক ভালোবাসতেন। আলী রাজা পারিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী ফারসী, আরবী ও সংস্কৃত ভাষায় গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন।

বাবা আনোয়ার খাঁন ও বড়ভাই আলম রাজা থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি হাতী আলী রাজার হাতে আসার পর তাঁর মধ্যে হাতি সৌখিনতা বেড়ে যায়। শুনা যায় আলী রাজা তাঁর বাপ-দাদার আমল থেকে এই অঞ্চলে হাতি ধরা শিক্ষা পেয়েছিলেন বলে কয়েকবছর হাতী বেচাকেনার ব্যবসা করেন। এটি তখন সিলেট অঞ্চলে দু’চারটি দামী ব্যবসার মধ্যে একটি। তাঁর পূর্বসূরীদের সময় থেকে সিলেটে এর ব্যবসা-বানিজ্য বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে একটি মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় লিন্ডসে সাহেব (১৭৭৮-১৭৮৯)এর লেখায়: Chittagong, Tipperah, and Sylhet ; each of these places furnishes annually a considerable number for the use of our armies,” “This observation will be fully understood when I state, that, in the twelve years I resided under these mountains, at least five hundred elephants were caught annually,” (Robert Lindsays, ANECDOTES OF AN INDIAN LIFE. P: 62). লিন্ডসে সাহেব এও উল্লেখ করেছেন যে সিলেটের এই হাতীগুলো বিভিন্ন প্রয়োজনে সমস্ত ভারতের দুরদুরান্তের শহরগুলাতে সরবরাহ করা হতো। দেওয়ান আলী রাজা সাহেব অত্যন্ত সৌখিন ছিলেন বলে পরবর্তীকালে তাঁর পুত্রগনের মধ্যেও এই সৌখিন-স্বভাব লক্ষ্য করা যায়। আলী রাজা হাতি ধরার স্বার্থে কয়েকবারই কেদা করিয়েছেন। এছাড়া তিনি কোড়া ও ঘোড়ার প্রতিও আসক্ত ছিলেন। হাতি পালনে তাঁর এতখানি নিষ্টা ছিল যে, হাসন রাজা পরবর্তীকালে তাঁর ‘সৌখিন বাহার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: আলী রাজার অগনিত হাতি বজ্রাঘাতে মারা যাওয়ার পরও তিনি হাতি পালনে পিছপা ছিলেন না।

“সুন্দর না লাগে হাতী, অল্প কালা হইলে
মালিকের না দু:খ লাগে, সেইসব হাতী মইলে
এই মত কত হাতী, গেছে আমরার মরি
একদিন আমার পিতায়, না চাইলেন ফিরি”


আলী রাজার বয়স যখন ১৯ বছর তখন বড় ভাই আলম রাজা মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে নি:সন্তান অবস্থায় মারা যান। এরপর থেকে মা দৌলত জাহান বিবি (আফগান বংশসম্ভূত ওয়েজদি কোরেশীর কন্যা) তাঁর শেষদিন পর্যন্ত ছেলেকে ঝক্ষের ধনের মত আগলে রাখতে চেষ্টা করতেন। ওদিকে চাচাত ভাই কামদার খান পুত্রহীন অবস্থায় মৃত্যমুখে পতিত হলে আলী রাজা চাচার বিশাল সম্পত্তিরও মালিকানা লাভ করেন। মায়ের প্রভাব-বলয়ে আলী রাজা আপন জমিদারী এক সুষ্টু পরিচালনার মধ্যে দিয়ে চালিয়ে যান। জমিদারীর বিভিন্ন বিষয়ে মায়ের কাছে তিনি প্রায়ই পরামর্শ ও উপদেশ চাইতেন।

কিন্তু ইতোমধ্যে মা দৌলত জাহান ছেলের ২৫ বছর বয়সে প্রথম বিবাহ করান দিনারপুর পরগনার সদরঘাট মৌজার দেওয়ান হায়দর গাজীর কন্যাকে। এই স্ত্রী অন্তসত্বা অবস্থায় মারা যান। তাঁর কবরস্থানের চিহৃটি এখনও রামপাশায় গোরস্থানে রয়েছে। পরম্পরায় আলী রাজার বংশধরগনের মধ্যে এই কাহিনী প্রচলিত আছে যে, এই প্রথম স্ত্রীবিয়োগের পর তিনি আর বিবাহ করতে রাজী ছিলেন না। এক মউজুফ বুজুর্গ মোহম্মদ গাজীর নিকট তিনি বাইয়াত নেন। এই বুজুর্গের পরিধানে থাকতো বস্থার টাট দিয়ে। এজন্যে এই বুজুর্গ ‘টাটসা মৌলা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সমস্ত ভূসম্পত্তি ও জৌলুস ছেড়ে দিয়ে আলী রাজা বৈরাগ্য লাভে অধিক আগ্রহী হয়ে পড়েন। কিন্তু বুজুর্গ তাঁকে এই বৈরাগ্য পথে নিরুৎসাহিত করেন এবং পরামর্শ দেন, সংসারধর্মে আত্বনিয়োগ করে আল্লার নামের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বংশধরগনকে ধরে রাখাই উত্তম কাজ। অবশেষে দিনারপুর পরগনার শতক বর্তমানে আতানগিরি গ্রামনিবাসী দেওয়ান সায়েস্থা রাজার কন্যা নফীজা বানুকে বিবাহ করায় প্রথম সন্তান দেওয়ান ওবায়দুর রাজার জন্ম হয় ১৮৩২ সনে। সিলেট শহরে আলী রাজা তৃতীয় বিবাহ করেন তাঁর এক বন্ধু রহমান খানের বিধবা স্ত্রী নুর বিবিকে। এই বিবির গর্ভে জন্ম নেন সঈফা বানু ১৮৫১ সালে, এবং আরেক পুত্র দেওয়ান মোজাফ্ফর রাজা ১৮৫৩ সালে। এই সঈফা বানুই সিলেটের বিখ্যাত প্রথম মহিলা কবি হিসেবে স্বীকৃত। অতি অল্প বয়সের এ দু’সন্তানকে রেখে নুর বিবি মৃত্যুবরন করায় তাঁরই ছোট বোন জরিনা বানুকে আলী রাজা চতুর্থ স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করেন। উদ্দেশ্য ছিল যে, ঐ শিশু সন্তানদেরকে লালন পালন করা। শেষে এই জরিনা বিবি নি:সন্তান মারা যান। আলী রাজার বয়স তখন পঞ্চাশোর্ধ। এতসব মৃত্যুতে কাতর আলী রাজা তার আরেক আপনজন সুনামগঞ্জে লক্ষণশ্রীর জমিদার পরিবারের শেষ ব্যক্তিটি আপন খালাতভাই আমির বক্স চৌধুরীকেও ইহলোকে হারান। এই সময় বিপন্ন খালাত ভাবীকে উদ্ধারকল্পে ১৮৫৩ সালে তাঁর সর্বশেষ পঞ্চম বিবাহ হয় হুরমতজাহান বানুর সাথে। আর এমনই মহান কর্তব্য পালনশেষে যে শিশুটির জন্ম হয় ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর অর্থাৎ ৭ই পৌষ, ১২৬১ বাংলা বর্ষে সেই শিশুটি আমাদের আলোচ্য লোক সংগীত ও লোক-দর্শনের বরেন্য “মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজা”। আর এই হুরমতজাহান বানুই হলেন হাসন রাজার মা।

পৈত্রিক বিশাল সম্পত্তির সাথে স্ত্রীর সুনামগঞ্জের সম্পত্তি যোগ হওয়ায় সিলেটের বৃহত্তম ভূমির অধিকারী হিসেবেই শুধু নয়, আলী রাজা এই অঞ্চলে এক বিশেষ খ্যাতিমান পর্যায়ে উত্তীর্ণ হন। ১৮০০ সাল থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ জীবনকাল জুড়ে আলী রাজার খ্যাতি সমস্ত সিলেট ব্যাপি ক্রমশ: ছড়িয়ে পড়ে। হাসন রাজা তাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র গনিউর রাজাকে তাঁর পিতা আলী রাজা সম্পর্কে বর্ননা করতে গিয়ে বলেন : “আমার পিতা আলী রাজা সাহেবের নাম দাম আর যশ এমন হইয়াছিল যে সমস্ত সিলেটের মধ্যে তাঁহার মত খ্যাতিমান পুরুষ খুব কমই ছিলেন।” ( খা: বা: গনিউর রাজার তথ্যকথা বই নং ) তাঁর বড়ভাইয়ের নামে ‘আলম রাজা তালুক’ নামে খ্যাত এক তালুকেরই শুধুমাত্র জমির পরিমানই ছিলো ২ লক্ষ ৮৮ হাজার একর। এটি সম্ভবত সিলেটের বৃহত্তম তালুক হিসেবে পরিগনিত ছিল। তবে শুনা যায় বানিয়াচুঙ্গে এরকম আরেকটি তালুকের অস্থিত্বও ছিল। রামপাশার পৈত্রিক ভূসম্পত্তির সীমারেখা টানতে গিয়ে তিনি চতুর্দিক বেষ্টিত পরিখা নির্মান করেন, আজো যা বিদ্যমান রয়েছে। রামপাশার থেকে দক্ষিণপূর্বে পাঁচ মাইল দুরত্বে তাঁর নামানুসারে আলীখালি নামে একটি খাল এখনও দৃশ্যমান। জায়গায় জায়গায় স্থানে স্থানে তাঁর দেয়া খাছাড়ি নির্মান জমিদারী পরিচালনায় দক্ষতা ও কর্মক্ষমতারই শামিল। তাঁর মধ্যে ছিল অনাবিল নিশর্ত ও নিস্বার্থ বদান্যতা। হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে তিনি দানশীলতার কাজে মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, আখড়া, মক্তব নির্মানে অনেক দান খয়রাত করেন। উদাহরনস্বরূপ টেংরার আখড়ার মত অনেক আখড়াতে তিনি সাহায্য প্রদান করেছেন। আলী রাজা ছিলেন সত্যবাদী পন্থার লোক। একবার এক লোক আলী রাজার উপর একটি মামলা করে এবং সাক্ষী মানে তাঁরই পুত্র ওবায়দুর রাজাকে। বাবার বিরোদ্ধে সাক্ষ্য দিতে ইতস্তত করায় আলী রাজা পুত্রকে সত্য সাক্ষ্য দিতে উপদেশ দেন। নিজ পিতার বিপক্ষে এত সাহসভরে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসায় বিচারক এই সত্যবাদিতায় অভিভূত হয়ে সমস্ত অভিযোগটি খারিজ করে দেন। আলী রাজা ধন-ঐশ্বর্য্য থাকা সত্তেও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি দেনাদায়গ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তালুকের পর তালুক নিলাম হতে থাকে। এমনি অবস্থায় একদিন “ভাদেশ্বর নিবাসী এক চৌধুরী সাহেব ৫০০ শত টাকার জন্যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিলাম হওয়ার আশংকায় আলী রাজা সাহেবের কাছে এসে সাহায্যপ্রার্থী হন, তখন তিনি তাঁর নিজের অবস্থা বিবেচনা না করে তৎক্ষনাৎ খাজাঞ্চীকে আদেশ করেন চৌধুরীকে ৫০০ টাকা দেয়ার জন্যে। খাজাঞ্চী এতে মন খারাপ করলে তিনি বললেন ‘আমার ৫০০ টাকায় কোন কাজ পুরণ হবে না, বরঞ্চ এই টাকায় ঐ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি রক্ষা পাবে।” (দেওয়ান বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃ: ৪ ) তা সত্তে¡ও আলী রাজা আত্মসম্মান বোধটি বেশ একটুখানি প্রকট ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে অনেক ভুঁইফোড় লোকও তালুক বন্দোবস্ত করে নামের পিছনে চৌধুরী লেখা শুরু করে। সিলেটের তদানিন্তন কালেক্টারগন অন্যান্য জমিদার-মিরাশদারদের সাথে লক্ষনশ্রীর জমিদারদেরকেও ‘চৌধুরী’ সম্বোধন করে চিঠি-পত্র আদান-প্রদানের রেওয়াজ রাখে। এতে পরবর্তীকালে আলী রাজা তাঁর ‘নামের পিছনে চৌধুরী লিখতে আপত্তি করেন। উল্লেখ্য হাসন রাজার পূর্ব পুরুষগনের কারো বেলাতেই কোনসময়ই চৌধুরী উপাধি ছিল না। লক্ষ্য করা যায় ঐ সময়ই কালেক্টারগন এই উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করে।

দেওয়ান হাসন রাজার প্রথম পুত্র খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা থেকে জানা যায় যে আলী রাজা অত্যন্ত শক্তিমান ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। তাঁর মৌলভিবাজার ভ্রমনকাহিনীতে তিনি এর একটি সুন্দর গল্প জুড়ে দিয়েছেন। চলুন সেই কাহিনীর কথাটি একবার জেনে নেই।

(বর্তমান সিলেটের শেরপুর সন্নিকটে) অরমপুর মৌজা সংশ্লিষ্ট জমিদার আজাদ বক্ত চৌধূরী। এই পরিবারের সাথেও হাসন-রাজা-পরিবারের রক্ত সম্পর্ক রয়েছে। মৌলভিবাজার সফরকালে এই জমিদারীর আওতাভূক্ত একটি গ্রামে হাসনপুত্র গনিউর রাজা রাত্রি যাপন করতে হয়েছিল। কেননা গন্থব্যস্থল মৌলভি বাজারের দূর্লভপুর পৌছতে তখনও অনেকদুর। হাওরের পাশে সেই গ্রামে রাত্রের দুই প্রহর যখন চলছিল তখন হঠাৎ করে লক্ষ্য করা গেলো তাঁদের আশ্রয় নেয়া বাড়িটিতে বেশ কিছু লোক আস্তে আস্তে এসে ভীর জমাতে শুরু করে। আশ্রয়দাতার কাছে লে¤েপর আলো জালানোর তেল চাইলে পর সে জানাল ঘরে আর কোন তেল নেই। সফর-দলের সাথে টাকা পয়সা আছে মনে করে গ্রামের লোকগুলা বলাবলি শুরু করে দিল যে পাশের হাওরের কারনেই এ অঞ্চলে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হয় অর্থাৎ সময়ে সময়ে লোকজনের উপর ডাকাতি করে তাদের জীবিকা-আয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এমনি পরিস্থিতিতে গনিউর রাজার সফরসংগী অনুগত ডেংগাই এক বিশেষ কাহিনীকার দক্ষতার পরিচয় দিয়ে রাত্রের এই অশুভ সম্ভাবনাময় বিপদ থেকে হাসন রাজার পুত্র গনিউর রাজাকে সেদিনের মত উদ্ধার করে। আর এই কাহিনীর সাথেই আমরা হাসন রাজার পিতা আলী রাজার সাহসিকাতর পরিচয় পাই।

গনিউর রাজা, ডেংগাই এবং তাদের সফরসঙ্গীরা লক্ষ্য করলেন অত্র গ্রামের বেশ কিছু লোকেরা তাদের সাথে লাটি ও ধনুক নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে এবং কিজানি প্রস্তুতি নিবার পায়তারা করছে। ইতিমধ্যে হাসনপুত্রকে মেঝেতে বিছানো মাদুর বিছানার মধ্যখানে বসিয়ে দিয়ে ডেংগাই তার সঙ্গীদেরকে নিয়ে মন্ডলাকারে বসলো এবং সম্ভাব্য এই ডাকাতদের উদ্দেশ্যে এক লম্বা কাহিনীর সূত্রপাত ঘটালো। গানের সুরে সুরে হাসন রাজার পিতা দেওয়ান আলী রাজার সত্যিকার সাহসিকতার কথা বলতে গিয়ে ডাকাতদেরকে শুনাতে লাগলো।

“হে মিয়াগন তোমরা কেন লাটি ও ধনুক নাড়া ছাড়া করিতেছ আর বলিতেছ যে এই হাওর তোমাদেরকে পালে। কেন বলিতেছ তাহা কি আমরা বুঝতেছি না ? তাহা সবই আমরা বুঝিতেছি। কিন্তু আমরা ভয় পাইবার পাত্র নই। আমরা লড়িয়া মরিতে পারিব কিন্তু পালাইতে পারিব না। কেননা আমাদের দেওয়ান নিতান্ত বালক। তাহার সঙ্গে আমরা আসিয়াছি। তাহার বিনা হুকুমে কিছু করিতে পারিব না। করিলে তাহার বাবাজান হাসন রাজা ও তাহার মা সাহেবের কাছে আমরা কি জবাব দেব। জুতা খাইতে হইবে। নতুবা তোমরা বুঝিতে পারিতে আমাদের সাহস ও বল র্বিয্য কি প্রকার।

এই মিয়ার পিতামহ অর্থাৎ দাদা (আলী রাজা) কৌড়িয়া পরগণার রামপাশা মৌজার বড় জমিদার ছিলেন। একদিন বিশেষ দরকারে উক্ত দেওয়ান সাহেব রাত্রি মধ্যে শ্রীহট্ট যাইবার দরকার হইলে ৯/১০ জন লোক সংগে লইয়া নৌকা যোগে রওয়ানা দিলেন।

রাম পাশা হইতে শ্রীহট্ট যাইতে হইলে অধিকাংশ ভুমিই উক্ত দেওয়ান সাহেবের জমিদারীর অন্তগর্ত। যদিও মাঝে মধ্যে ছোট ছোট তালুকদারেরও ভূমি রহিয়াছে। কিন্তু তাহাদের বিচার আচারও দেওয়ান সাহেবের হাতে হইত। দেওয়ান সাহেবের দুহাই সর্বত্র চলিত। নিজ গ্রাম হইতে প্রায় তিন সারে-তিন মাইল পূর্ব দিকে বন্ধুয়া গ্রামে যখন দেওয়ান সাহেবের নৌকা পৌছিল তখনই উক্ত দেওয়ান সাহেবের এক মন্ডলের (মরল) বাড়ির ঘাটে এককানা ছোয়ারি বড় নৌকা লাগানো দেখা গেল। তখন দেওয়ান সাহেব তাঁহার ছোয়ারী নৌকার বাহিরে বসিয়া ধুমপান করিতেছিলেন। সঙ্গীয় লোকগণকে বলিলেন। নৌকা ওখানে লাগানোর জন্যে। তিনি বলিলেন আমার মড়লের ঘাটে ভাটিয়ালী ডাকাতগনের নাও দেখিতেছি। বলামাত্রই নৌকা লাগানো হইল এবং দেওয়ান সাহেব নিজে সমস্ত সংগের লোকজন নিয়ে উক্ত মড়লের বাড়ীতে উঠিতে লাগিলেন। অর্দ্ধেক লোক মড়লের পিছ দোয়ারের সামনে দাড়াইল, আর অর্ধেক লোকসহ নিজে দেওয়ান-সাহেব মন্ডলের সামনের দরজায় খাড়া রইলেন। একজনকে বলিলেন মড়লকে ডাকিবার জন্যে। মড়লের নাম ধরিয়া ডাকিলে পর মড়ল জওয়াব দিবার পূর্বেই পিছের দোয়ার খুলিয়া গেল, মড়লের নিদ্রা ভংগ হইলে বাতি জালিয়া দিল। তখন ডাকাতগণ ভয় পাইয়া গেল।

সামনের দরজা খুলিয়া দিয়া দুই জন ডাকাত বাহির হইলে দেওয়ান সাহেবের ইশারায় তাঁর লোকেরা ডাকাতদ্ধয়কে ধরতে চাইলে তাহারা দস্তাদস্তি আরম্ভ করিল। উভয় দলের দস্তাদস্তির মধ্যখানে পিছনের দরজা দিয়ে আরো কিছু ডাকাত বেড়িয়ে যাওয়ার পায়তাড়ায় সাহেবের লোকজনের সাথে দস্তাদস্তি শুরু হইল। একটা ডাকাত বড় জবরদস্ত জোয়ান ছিল। তাহার বিপক্ষে ৪/৫ জন লোকের দরকার। সে সরিয়া দাড়াইল। দেওয়ান সাহেবের লোকেরা ৪/৫ জন ডাকাতকে ধরিয়া বান্ধিয়া ফেলিল। অর্ধেক ডাকাত ধরা পড়িল। বাকী ডাকাতগুলা ভগ্ন উৎসাহে উঠিয়া গেল। কিন্তু বড় ডাকাতকে কেহ ধরিতে সাহস পাইল না। বড় ডাকাত যখন সাহেবের দুই তিন গজ দুরে দাড়াইয়া আছ্।ে তখন দেওয়ান সাহেব তাহা দেখিয়া এক উচ্চ-শব্দ করিয়া বলিলেন: ‘ধর ডাকাতগুলারে র্ধ। তখন বড় ডাকাতেরর কাছে যাইতে কেহই সাহস পাইল না। একজন বড় ডাকাতকে লাটির আঘাত করিলে সে নিজের হাত দিয়া ডালের মত ফিরাইতে লাগিল। এমনি অবস্থায় সাহেব বড় ডাকাতের ধারে যাইয়া জুরে এক হাক দিয়া দাবানী মারিলেন: “র্ধ হারামজাদা ডাকাতকে”। তখন বড় ডাকাতের হাত হইতে ছোট দুইটি ধারাল দা মাটিতে পড়িয়া গেল। এদেরকে পাকরাও করা হইল এবং বড় ডাকাতকে স্বয়ং দেওয়ান সাহেব ডান হাতের বগলের নীচে ধরিয়া বন্দি করিলে অপরাপর লোকজন যাইয়া বান্ধিয়া ফেলিল। সর্ব শুদ্ধ ১৩/১৪ জন ডাকাতকে ধরিয়া গরুর মত টানিয়া নৌকায় তুলা হইল। তখন ভোর হইয়াছিল। নৌকা শ্রিহট্টের পথে তৈরী হলে মড়ল আসিয়া বক্তে শুরু করিল “ভাগ্যিস মনিব যাইতেছিলেন নইলে আজ ধানগুলা রক্ষা করিতে পারিতাম না। গুলা খালি হইয়া যাইত।

যত নৌকা সিলেটের দিকে অগ্রসর হইতেছিল ডাকাতগন কাঁদিতেছিল। ইহা দেখিয়া দেওয়ান সাহেবের দয়া হইল এবং বড় ডাকাত বীর-পুরুষ বলিয়া দয়া হইল। ডাকাতেরা দেওয়ান সাহেবের পায়ে পড়িয়া ক্ষমা চাইল এবং প্রতিজ্ঞা করিল আর জীবনে চুরি ডাকাতি করিবে না। দেওয়ান সাহেব জানাইলেন যদি আর না করিস, তাইলে আমি মাপ করিয়া দিব। আবার ডাকাতী করিলে তোমাদের উপর মড়ল দিয়া মুকদ্দমা করাইব। ইতিমধ্যে এক ডাকাতকে দিয়ে সাহেব সকলের নাম ধাম ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া নিয়াছিলেন। তাহা তাহারা টের পাইয়াছিল বলিয়া তাহারা সাহেবের পদ ছুইতে ছুইতে পশ্চিম মুখে চলিয়া গেল। তখন আশ্মিন মাস ছিল। নিম্ন ভূমিতে জল ছিল। এই কথাটি শেষ করিয়া ডেংগাই বেটা বলিল রাত্র পোহায়াইছে চলুন আমরা মনু-মুখের রাস্তা লই।” (গনিউর রাজা, ভ্রমন-কাহিনী, মৌলভিবাজার সফর) অপ্র:২৩)

এভাবেই দাদার সাহসিকতার কথা শুনতে শুনতেই সেই রাতে ডাকাতদের কবল থেকে হাসন রাজার জৈষ্ট পুত্র তরুন গনিউর রাজা আবারো সুনামগঞ্জে প্রত্যাবর্তন করতে পারলেন।

গনিউর রাজার লিপিবব্ধ দলিল থেকে এও জানা যায় যে, আলী রাজার দুই বোন ছিলেন। একজন ফাতিমা বানু, যাকে বিবাহ দেয়া হয় জগন্নাথপুর উপজেলার অন্তর্ভূক্ত আতুজান-বড়কাপন পরগনার পিরের গাঁর সৈয়দ পীর বংশের বিখ্যাত ‘বেদস্বার’ রচয়িতা সাধক সুফি অলি মরমী কবি শাহ সৈয়দ হোসেন আলমের বংশধর সৈয়দ নুর আলমের সাথে। আলম রাজা ও আলী রাজার অপর বোন রাবেয়া বানুকে বিবাহ দেয়া হয় কিত্তা পরগনার হাজ্রাই নিবাসী জমিদার গোলাম আহমেদ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র গোলাম হায়দর চৌধুরীর সাথে। তাঁর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় মেয়ে বংশের রেংগা-দাউদপুর নিবাসী বিখ্যাত কোরেশ বংশীয় জমিদার তসিম উদ্দিন চৌধুরী ও খান বাহাদুর গৌস উদ্দিন চৌধুরী পরবর্তীতে এই জমিদারির মালিক হন।

হুরমতজাহান বানু চৌধুরানী ওরফে হুরমতজান বিবি ( ১৮১৯ - ১৯০৪)

গনিউর রাজার তথ্যকথা অনুযায়ী হুরমতজাহান বানু ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন। পরবর্তীকালে লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল হাই (হাসন পছন্দ) লিখেছেন: হাসন রাজার মাতা পরলোকগমন করেন ১৩১০ বাংলায় (আব্দুল হাই, গনি সঙ্গীত পৃ:২) তবে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৩১১ বাংলায় হুরমতজান বিবির উফাতের কথা নির্দেশ করেছেন। তাঁদের দুজনের হিসাবে এবং গনিউর রাজার দেয়া তথ্যকে ভিত্তি করে মনে হয় খুব সম্ভবত: হুরমতজান বিবির মৃত্যু হয়েছে ১৯০৪ সালের জানুয়ারী তথা ১৩১১ বাংলার পৌষ মাসের দিকে। সেই হিসেবে গনিউর রাজার দেয়া বয়স থেকে এ অনুমান করা যায় হুরমতজাহান বানুর জন্ম ১৮১৯ সালে। শ্রী কেদারানাথ মজুমদারের লিখামতে লেম্বোধর সিং (অর্থাৎ হুরমতজাহান বানুর উর্দ্ধতন পুরুষ) রাজস্থানের চিতোর হইতে আগত রাজপুত ক্ষত্রীয়। বিবাহ সুত্রে তাঁদের আত্মিয়তা হোম বংশের শাসকদের সাথে ছিল বলে উল্লেখ আছে। “কালিয়াজুরির পরগনার প্রাচীন ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, কতিপয় শতাব্দী পূর্বে লম্বোধর নামে একজন ক্ষত্রীয় সন্যাসী এতদৎ-প্রদেশে আগমন করিয়া ভাটির শাষনভার গ্রহন করেন। এই সন্যাসীর বংশ এখনও বর্তমান আছেন। দিল্লীশ্বর জাহাঙ্গীর বাদশা হইতে ইহাদের পূর্বপুরুষেরা ভাটি মুল্লুকের পাঞ্জা ফরমান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে ভাটির শাষনকর্তা বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।” (শ্রী কেদারনাথ মজুমদার, ময়মনসিংহের ইতিহাস পৃ: ১৪-১৫)

ঈশা খারঁ মৃত্যুর পর বাজুহার জলকর মহাল অল্পকালের জন্য ঈশা খাঁর পারিষদ মজলিসদের হস্থগত হয়। হাসন রাজার মাতৃবংশের পূর্বপুরুষ মজলিস প্রতাপ ও মজলিস দিলোয়ারও ছিলেন ঈসা খাঁর মজলিশের অন্তর্ভূক্ত। যখন মোগল সেনাপতি খানেজাহান কর্তৃক ১৫৭৮ সালে ভাটি অঞ্চলটি আক্রমন করা হয় তখন তাঁরা ঈসা খা অর্থাৎ বারো ভূঁইয়াদের সাথে মিলিত হয়ে খাঁন জাহানকে প্রতিহত করেন। পরবর্তীতে এই ভাটি অঞ্চলটি হোম বংশের শাসনাধীন থাকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত। বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্তর্ভূক্ত নেত্রকোনা জেলাধীন খালিয়াজুরির বল্লী গ্রামে তাঁদের বর্তমান পারিবারিক অবস্থান। বল্লীর জমিদারীর নিকটবর্তী জমিদারদের দুরভিসন্ধি ও প্ররোচনায় তাঁদের প্রতারক ম্যানেজার সদরজমা আদায় করে নাই। এই অনাদায়ের কারণে জমিদারী নিলামে চড়ে। এই নিলাম ক্রয় করেন ধানকুড়ার জমিদাররা। শেষে দখলপ্রাপ্তির অপারগতায় জমিদারির এক চতুর্থাংশ বিক্রী করতে বাধ্য হন। এই বিক্রীর ক্রেতা ছিলেন করটিয়ার জমিদার সাদাত আলী খান পন্নী। সাদাত আলী খান পন্নী অবশেষে এই অংশ হুরমতজাহান বিবির পিতৃবংশে ফিরত দান করেন।

গনিউর রাজার তথ্যবিবরনী সূত্রে জানা যায়: পরবর্তীকালে ক্ষত্রীয় এই হিন্দু বংশীয় মজলিস দিলওয়ারের এক উত্তরবংশ অর্থাৎ তাঁর পঞ্চম উত্তরবংশ গজরাজ রায়ের দুই পুত্র ছিলেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা লেম্বুধর রায় সিং নুতন নামে ‘বক্তার খাঁ’ নাম ধারন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। তাঁর অপর ভ্রাতার নাম ছিল অদ্বিনাথ রায় সিং। অদ্বিনাথ রায়ের অধ:স্তন দুই নম্বর বংশধর শরৎরায় খালিয়াজুরিতে হাসন রাজা এবং তাঁর পুত্রদের সময় পর্যন্তও জীবিত ছিলেন। বক্তার খাঁ চৌধুরীর পূর্বকালীন সময় পর্যন্ত এই বংশের চৌধুরীগন হিন্দু স্বাধীন রাজা ছিলেন। উক্ত লেম্বুধর রায় সিং ওরফে বক্তার খাঁর দুই পুত্র ছিলেন প্রথম পুত্র এলিম চৌধুরী এবং দ্বিতীয় পুত্র ছলিম চৌধুরী। ছলিম চৌধুরীর এক পুত্র নাম ইমদাদ আজিজ চৌধুরী উরফে তুরন মিঞা এবং এক কন্যা মুছাম্মত হুরমতজাহান বিবি (হাসন রাজার মা)। তুরন মিঞার দুই ছেলে - মফিজুল হুসন চৌধুরী উরফে মফিজ মিয়া এবং আব্দুল জব্বার চৌধুরী উরফে খলিল মিয়া। তাঁদের এক বোন সাজেদা বানু।

খলিল মিয়ার যথাক্রমে তিন পুত্র ও দুই কন্যা। আব্দুস সালাম চৌধুরী, আব্দুল হাই চৌধুরী ও একবালনূর চৌধুরী এবং কন্যাদ্বয়া একলিমুন্নেসা চৌধুরানী ও হাসিনা বানু চৌধুরানী। এই একলিমুন্নেসা চৌধুরানীই পরবর্তীকালে হাসন রাজার সর্বকনিষ্ট পুত্র দেওয়ান আফতাবুর রাজার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তাঁর ঘরে উঠেন।

হুরমতজাহান বিবি অত্যন্ত স্নেহপরায়না মহিলা ছিলেন। যখন তিনি আমীর বক্স চৌধূরীর সংসারী স্ত্রী হিসেবে তিন পুত্র ও এক কন্যাকে স্নেহ আদরে বড় করে তুলছিলেন, তখন কেবল পরম স্নেহরূপী মা-র পরিপূর্নতাই তিনি অর্জন করেননি, বরং গভীর প্রেমানুরাগে স্বামী আমীর বক্স চৌধুরীকেও পরম স্ত্রী-প্রীতিতে আপ্লুুত করে রেখেছিলেন। হাসন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র গনিউর রাজা জানান: ‘স্নেহাপূর্ণা মা হুরমতজাহান বিবি পুত্রের টানে বড়ছেলে সিকান্দর বক্তের ঘোড়াটি হিন্দুস্থানী ফকিরকে দান করিয়া দিতে যেমন মন মানিতেছিল না, ঠিক তেমনি ঐ সন্ধিক্ষনে স্বামী আমীর বক্স চৌধুরীকেও পরম শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অন্তর দিয়ে সুপরামর্শ দিতে কালক্ষেপন করিলেন না’ ।

গনিউর রাজার তথ্যকে ভিত্তি করে এ অনুমিত হয় যে, প্রায় ১৬/১৭ বছরের মত সময়কাল ব্যাপি হুরমতজাহান বিবি আমীর বক্স চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে ঘর সংসার করার পর যখন মাস ছয়েকের ভিতর মহামারীতে চার-চারটি পুত্রকন্যাসহ স্বামীকে মৃত্যুমূখে হারালেন তখনই আনুমানিক ৩৩ কি ৩৪ বছর বয়সে হুরমতজাহান বিবি বিধবা হয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন বলে নি¤েœ বর্নীত ঘটনাটির খবর পাওয়া যায় গনিউর রাজার তথ্যবিবরনী মারফৎ।



লক্ষণশ্রীতে স্ত্রী হুরমতজাহান বানু তখন একমাত্র উত্তরাধিকারীনি হিসেবে সমস্ত জমিদারী ভুস¤পত্তির মালিক। রাজস্থানের চিতোর থেকে আগত ক্ষত্রীয় বংশীয় বল্লীনিবাসী জমিদার মোহাম্মদ ছলিম চৌধুরীর কন্যা হুরমতজাহান বিবি এক রক্ষনশীল ও পর্দাসীন ঘরে বড় হয়ে উঠেছিলেন (গনিউর রাজা, তথ্যকথা বই নং-২) এবং স্বামী আমির বক্সের বাড়ীতে এসে তাঁর অবস্থাটি ঠিক সেরকমই রক্ষনশীল ছিল। সন্তানাদি ও স্বামীবিয়োগের পর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন তিনি। কিছুদিন যেতে না যেতেই ময়মনসিংহ ও সিলেটের বিখ্যাত জমিদার পরিবারের এই ঐশ্বর্যশীলা মহিয়সী মহিলার সাথে বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্খায় নানান সম্ভ্রান্ত ঘর হতে প্রস্থাব আসতে থাকে। বিধবা হুরমত জাহান এ-সমস্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। অবশেষে বছরখানেক পরেই তাঁর একমাত্র ভাই তোরণ মিয়ার পিড়াপীড়িতে স্বামী মরহুম আমীর বক্স চৌধুরীর আপন খালাত ভাই কৌড়িয়ার জমিদার দেওয়ান আলী রাজার সাথে বিবাহ বন্ধনে রাজী হোন এবং বিয়েটি সম্পন্ন হয়।

‘হুরমতজাহান বিবি বড়ো দু:খিনী মানুষ ছিলেন। চার চারজন সন্তান হারানোর পর বুক বেধে সহ্য করে নিয়েছিলেন এতগুলা মৃত্যু। স্বামী আমির বক্স চৌধুরীর ভালোবাসা আর দোয়া-ই হয়তো তাঁকে আলী রাজার সাহেবের সন্ধান দিয়েছিল। হুরমতজাহান বিবি প্রায়ই বলতেন এত বড়ো জমিদার হয়েও আলী রাজা কোনদিন তাঁর সাথে অসদব্যবহার করেননি। বিবির কোথায় যেনো একটি কষ্ট ছিল - তা আলী রাজা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতেন। তাই আলী রাজার সাথে হুরমতজাহানের সতেরটি বছরের সংসার খুবই সুখের ছিল, শান্তিময় ছিল। আগের স্বামীর ঘরভরা সুখের সংসারের অভাব অনেকখানি ঘুচে গিয়েছিল হাসন রাজার জন্মের পর থেকে। বাল্যকালে হাসন রাজার দুরন্তপনার জন্যে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিলনা। হাসন রাজার মাত্র ১৭ বছর বয়সকালে পিতা আলী রাজা মারা যান। সারাক্ষনই ছেলেকে নিয়েই মায়ের ভাবনা ছিল, কিন্তু বুঝলেন পুত্র হাসন রাজা ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিপক্কতা অর্জন করেছেন, জন্ম মৃত্যুর মর্মার্থ তাঁর মধ্যে ঝেকে বসেছে। তখন থেকেই মায়ের মধ্যে একটি স্বস্থি ছিল যে, ছেলের আলোকিত মন, সোনার মত মুখ আর ঘরভরা মানুষ ও ছেলে বউদের মুখরিত কলরবে তাঁর জন্যে সুখের ভান্ডার দ্বারঘোরায় উপস্থিত।

একবার যখন রামপাশায় অনেক তাল্লুক নিলামে চড়ে, হাসিমুখে হুরমতজাহান বানু ছেলে হাসন রাজাকে প্রবোধ দিলেন; ‘মানুষ তো যাচ্ছেনা বাপু, যাচ্ছে জমিজমা। চিন্তা কিসের? তোমার লক্ষনশ্রীর জমিদারী তো রয়ে গেলো!’ মায়ের এই প্রবোদটি হাসন রাজার মাঝে বিদ্যোতের মত কাজ করলো। ১০৯টি মৌজা হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে তাঁর কোনো আফসোস রইল না। বোন সহিফা বানুর জুড়ালো পরামর্শে শেষে ১৮৯টির মাঝে ৮০টি মৌজা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। লবজান চৌধুরীর দৃষ্টিতে তাঁর স্বামী হাসন রাজার বিরাট ব্যক্তিত্ব আকার ধারন করেছিলো তাঁর মায়ের জন্যে। মা হুরমতজাহান ছেলে হাসন রাজাকে বুঝিয়েছিলেন যে, জীবনে অনেককিছু হারানোর পরও জীবন আকস্মিকতায় ভরপুর। জীবনভর যেনো আপনজনের বিয়োগের অন্ত নেই। মায়ের মত হাসন রাজাও স্বজনহারা হয়েছেন বার বার। হাসন রাজা তার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন বলেই তিনি কবি হতে পেরেছিলেন। কবি হতে পেরেছিলেন বলেই কত আপনজনের আকস্মিক মৃত্যুগুলা সামলে নিতে পেরেছিলেন।’

যাইহোক, হাসন রাজার কনিষ্ট পুত্র আফÍাবুর রাজার প্রথম স্ত্রী আকলিমুননেসার এক প্রশ্নের উত্তরে হাসন রাজার কনিষ্ট স্ত্রী লবজান চৌধুরী জানালেনÑ ‘হুরমতজান বিবির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর দিলটি ছিল বড়ো নরম। কোন মানুষই তাঁর কাছে খারাপ ছিলনা। সবাইকে তিনি সহজে গ্রহন করে নিতেন। যেমনি ছেলেবউদেরকে বারবার বরণ করেছেন, ঠিক তেমনি অন্দরমহলে অসংখ্য লোকজনকে আপন করে নিতেন। লবজান চৌধুরী এ বাড়ীতে বিয়ে হয়ে আসার পর তাঁর শাশুড়ি হুরমতজাহান বিবিকে মাত্র নয় বছর পেয়েছিলেন। এই নয় বছরে শাশুড়িকে জানার তাঁর অনেক সুযোগ হয়েছিলো।

শাশুড়ি হুরমতজাহান বানু মৃত্যুর দুই বছর আগের একটি ঘটনা। হুরমতজান বিবি শুনলেন Ñ পাশের নিতাই শেখের বাড়িতে নাকি পুত্রবধুর উপর ভূত চেপেছে। সে নাকি নানান উৎপাত শুরু করে দিয়েছে। ফলে এক মুল্লা নাকি ভুত ছাড়াতে তার নাকে মুখে পুড়া মরিচের তেল ছিটিয়ে দিচ্ছে। এ্ শুনে হুরমতজান বিবি রেগে-মেগে হাসন রাজাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানতেন হাসন রাজা নিশ্চয় এর একটি বিহিত ব্যবস্থা করবেন।

লবজান চৌধুরী স্মৃতিচারন করেন, হুরমতজান বিবি প্রায়ই তাঁকে বলতেন :‘আমার ছেলে হাসন রাজার বিশেষ বিশেষ কিছু গুন আছে যা লোকের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা সম্ভব নয়, তা মনের চক্ষু দিয়েই দেখা সম্ভব। সেজন্যেই তো বৌমা! তুকে বিয়ের ক্ষেত্রে তোর বাবার মন জয় করতে পেরেছিলো, কেড়ে নিয়েছিল তোর মনকেও’। লবজান বিবি তখন হেসে হেসে বললেন, ‘একি বলেন সাহেবানী’।

সেদিন মা হুরমতজান বিবির কথামত নিতাই শেখের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হন হাসন রাজা। সাহেব লক্ষ্য করলেন মুল্লা কিসিমের একজন লোক ভুতেধরা মহিলাটির নাকেমুখে কি জানি তৈলাক্ত কিছু একটা ছিটিয়ে দিচ্ছে। আর এর চারদিকে এক ধু¤্রজালের সৃষ্টি করেছে। মেয়েটি বেজিনিসের মত ভীষনরকম চিৎকার করছিল। হাসন রাজা তৎক্ষনাৎ মুল্লার কাজটি বন্ধ করার জন্যে আদেশ দিলেন। পরক্ষনে মেয়েটি চুপ হয়ে একদিকে বসে রইল। নিতাই শেখের পুত্র হাসন রাজাকে জানাল, ‘বাপের বাড়ি থেকে ফিরার পথে অচিনপুরের নদীর পারে কুল গাছের নীচে আসার সাথে সাথে সে এমন হয়ে গেছে। তাঁর কথাবার্তা কেমন যেনো আলুতালু হয়ে গেছে’। হাসন রাজা তখন তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বললেন ‘এক গøাস পানি মেয়েটিকে পান করতে দাও’। পানি পেয়ে সে গোগ্রসে তা পান করলো। হাসন রাজা কিন্তু ছোটকাল থেকেই বিশেষ কিছু কোরানের সুরা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। আর ঐদিন সেই মুহুর্তে একটি বসার টুল টেনে নিয়ে বসে চোখমুজে সুরা ইয়াসিন জপতে থাকেন। মেয়েটি তখন আটসাট হয়ে কেমন যেনো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরের কোন্ নিতে চাচ্ছিল। এক পর্যায়ে বেশ উচ্চস্বরে সুরার শব্দগুলা জোড়ালোভাবে উচ্চারন করছিলেন হাসন রাজা। দেখা গেলো, মেয়েটি চিৎকার করে বলতে লাগলো আমাকে মাফ করুন। আমাকে সাহেব যেতে দিন। উত্তরে হাসন রাজা শুধু বললেন ‘এই মেয়ে বসে পড়!’ এরপর মেয়েটি এক অদ্ভুত শব্দ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যায়। সুরাটি শেষ করার সাথে সাথে হাসন রাজা তার মাথায় পানি দেবার আদেশ দিলেন। হাসন রাজা নীরব বসে রইলেন। কিছুক্ষন পরে দেখা গেলো মেয়েটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো।’ লবজান চৌধুরীর বর্ননাতে এ ঘটনাটি শুনার পর পাঠক ভাবতে পারেন চক্ষুর অন্তরালে কোনো অন্তর্নিহিত শক্তিতে হাসন রাজার সেদিনকার ঘটনাটিকে সামাল দিয়েছিলেন কিনা ? তা কেউ বলতে পারবে না। তবে ছেলে হাসন রাজার কর্মে মা হুরমতজান সেদিন লম্বা একটি স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে দিয়ে লবজান চৌধুরীকে জানালেন; ‘ভাগ্যিস হাসন রাজা আজ লক্ষনশ্রী থাকায় এ যাত্রায় তা সামাল দেয়া গেলো। না-হয় শেখের বাড়িতে কি একটা কেলেংকারী খুনাখুনি হয়ে যেতো’।

লবজান চৌধুরী তাঁর ভাইঝি ও পুত্রবধু আকলিমুন নেসাকে এও জানালেন ‘আমার সাহেবানি একজন সূচীবাই মানুষ ছিলেন বলে সারাক্ষন আমার শাশুড়ির বেলায় খুব সজাগ থাকতে হতো, সাথে সাথে ঘরদুয়ার তো সবসময়ই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হতো’। তিনি আরো জানালেন; ‘আমার শাশুড়িকে প্রায়ই দেখতাম তিনি যখন রাতের বেলা বিছানায় শুতে যেতেন, তাঁর ঘন্টা অবধি কোন কাপড় ছাড়া কিংবা কোন জুতা ছাড়া খালি পা-দুটি বিছানার বাইরে শুন্যের উপর ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। গরম কি শীত, বছরের সব ক’টা সময়েই তাঁর এই অবস্থাটি। এভাবেই তিনি নিজেকে পরিষ্কার রাখতেন’।

হুরমতজান বিবির এই সুচীবাই অবস্থার উপর একটি ছোট্ট ঘটনা জড়িত আছে বলে কথিত আছে। হাসন রাজার বাড়ীর অন্দরমহলের পুকুরখানা। সেই আমির বক্সের আমল থেকে গ্রামের আপামর বৃদ্ধাবনিতা সকল মহিলারা গোসলবুর করতে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করে আসছিল। একবার বাড়ির পিছনের বসতি থেকে এক মহিলা পুকুরে এসে বাচ্চাদের পায়খানাযুক্ত ময়লা কাপড়গুলা ধুতে শুরু করে। নিজের চোখে হুরমতজাহান বিবি দেখার পরে এমন জড়ো-সড়ো হয়ে পড়েন, যে কোনদিন আর এ পুকুরে গোসল করতে সাহস করেন নি। শুবার ঘরের পাশে একটি গোসলখানার ব্যবস্থা হয়। নদী থেকে জল আনিয়ে তাঁর গোসলের ব্যবস্থা হতো। উপোর্যপোরি কোন কাকপক্ষি যদি তাঁর আশপাশে দেখা যেতো, তাইলে তিনি আর ঘরের ভিতর থেকে বেরুতেন না। তাঁর দূর্ভাবনা ছিল, কাকগুলা হয়তো ওপাড়ার থেকেই উড়ে এসেছে ময়লা দুর্গন্ধ চষে। আর সেজন্যে সবসময় একজন লোক ব্যস্ত থাকতে হতো, ঘরের আশপাশ কাকপক্ষীকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে। যে হুরমতজাহান বানু গরীব ধনী নির্বিশেষে সবাইকে খাতির করতেন, সেই তিনিই আবার সূচীবাই রোগের কারনে কোন কোন সময় ময়লা অপবিত্র কিছু চোখে পড়লে যেনো সিটকে পড়তেন।

দেওয়ান ওবায়দুর রাজা (১৮৩২ - ১৮৭১)

দেওয়ান ওবায়দুর রাজা ছিলেন হাসন রাজার তিন ভাইয়ের সর্বজেষ্ট্য ভ্রাতা। তিনি পারিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী ফার্সী, আরবী ও সংস্কৃত ভাষায় গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। ঘরের শিক্ষার পর বাবার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে তিনি সিলেটের সাঈদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তী হন এবং প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর মধ্যে জ্ঞানানুরাগ ও মনের উদ্দিপনা দেখে বাবা আলী রাজা তাঁকে অধিকতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশে পাটনা ও পরে লখনাউ পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি হাইয়ার সেকেন্ডারী এডুকেশন সম্পন্ন করেন। তাঁর বয়স উত্তরনে ফারসি ভাষায় তিনি যথেষ্ট ভূৎপত্তি অর্জন করেন এবং ঐ লখনাউতে তাঁর আজীবন বন্ধু ফতেহ আলী খানের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। শিক্ষা জীবনে তাঁদের ঘনিষ্টতার কারনেই পরবর্তীকালে আমরা জানি যে, পাটনার নওয়াব একবার দেওয়ান আলী রাজার জীবনকালে রামপাশা এসে বেড়িয়ে যান। অত্যন্ত সৌখিনবোধের কারনে আলী রাজার পুত্রগন তদ্রƒপ কোড়া, ঘোড়া হাতি পালনে অতি উৎসাহী ছিলেন।

ওবায়দুর রাজা ছিলেন ‘ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত এবং মৌলিক কাব্য রচনায় পটু। তখনকার দিনের বিদগ্ধ সমাজে তার কেনারা (ঝধঃরৎব) ও হাজির জওয়াবের (জবঢ়ধৎঃবব) জন্যে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তার সম্বন্ধে জনশ্রæতি রয়েছে যে একজন ইংরেজ সেটেলমেন্ট অফিসার তার ডায়রীতে ওবায়দুর রাজার আলোকসামান্য লাবন্যের উচ্চসিত প্রসংশা করেছেন। দূর্ভাগ্যবশত: সে ডায়েরী প্রকাশিত হয়নি। ওবায়দুর রাজাই সর্বপ্রথম এ পরিবারে বাংলাভাষায় কবিতা, গান ও ছড়া রচনা করতে আরম্ভ করেন।’ (দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ, মরমি কবি হাসন রেজা, মঞ্জিল প্রকাশনী, ১৩৮৬ বাংলা, ঢাকা, সূচনা, পৃ: ৭) কেউ কেউ বলতেন ফার্সী ভাষার একজন কবি হিসেবে তিনি শুধু ফারসী ও আরবী ভাষাতেই সুপন্ডিত ছিলেন না, তিনি তখনকার দিনে বিদগ্ধ সমাজে বিদ্রæপাত্মক ব্যঙ্গ কবিতা এবং সরস ও উপস্থিত প্রত্যুত্তর প্রতিভার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর নিজের হাতে লেখা কোরান শরীফখানা তাঁর শিক্ষানুরাগেরই প্রকাশ। হাতে লিখিত এই কোরানশরীফ খানা এখনও কালের আবর্তে টিকে আছে। তাঁর অনেক ফারসী কবিতার কিছু কিছু অংশ আজকের উত্তরসূরীদের কাছেও শুনা যায়। এছাড়া তিনি ভালো ঢোল বাজাতে পারতেন এবং তবলচি হিসেবেও পটু ছিলেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওবায়দুর রাজা তাঁর বাবা আলী রাজার পাশে সহযোগি হয়ে থাকতেন। অন্যদিকে সর্বসাধারনের সাথে মিশতেও তিনি এতটুকু দ্বিধাবোধ করতেন না। তাঁর কিছু প্রিয় সখের জিনিস ছিল।

হাতী ও ঘোড়াকে প্রশিক্ষন দিতে তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। হাসন রাজা অনেক সময় বড় ভাইয়ের ঘোড়া ও হাতীর নাম মূখস্থ করে নিতেন। একবার আলী রাজা তাঁর ছেলে ওবায়দুর রাজার প্রাণীর প্রতি এত বেশী অনুরাগ দেখে বিরক্ত হয়ে তাঁর মেদী হাতীটি বুরুংগার হিন্দু জমিদারের কাছে বিক্রী করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘চম্পা’ না¤œী এই হাতীটি তার মাহুতের হাত থেকে ছাড়া পেলেই রামপাশায় প্রায়ই ওবায়দুর রাজার কাছে ফিরে আসতো। তখন আবার সেটাকে বুরুংগায় ফিরিয়ে দেয়া হতো। মেদী হাতীটির আইনত মালিক বুরুংগার জমিদার অবশেষে বিরক্ত হয়ে একটি কোর্ট মামলা করেন, যেটি ঐ সময়কালের জন্যে সিলেটের সবচেয়ে দীর্ঘতম ‘চম্পা হাতি মামলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সর্বশেষে কোর্টের নির্দেশে কিছু মূল্য ধরে ওবায়দুর রাজার কাছে হাতীটি ফিরিয়ে দেয়া হয়। সিলেটের দরগাহ মহল্লার নজ্ব উদ্দীনের কন্যার সাথে ওবায়দুর রাজার বিয়ের আয়োজন হলো। সেই সময় বাবা আলী রাজা এক বিরাট বরযাত্রার আয়োজন করেছিলেন বলে খবর পাওয়া যায়। আজকে থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও কেউ কেউ এই বরযাত্রাকে স্মরন করতেন এই বলে যে, সিলেটে যেতে যেতে এগার মাইলের দুরত্বে ২৭টি গ্রামে বরপার্টি বিরতি নিতে হয়েছিল। তিনদিন ধরে এসব দাওয়াতীরা ও গ্রামবাসীদের জন্যে প্রচুর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। সাথে ব¥্রম্মনবাড়িয়া থেকে আনীত বেন্ড পার্টি ও গান-বাজনার দল। পুত্রের বিয়ের পূর্বশর্ত অনুযায়ী আলী রাজা মুফতী ও সর্ব সাধারনের জন্যে দরগার দক্ষিণ দিকে একটি সেতু তৈরী করে দেন এবং সিলেট শহরের বিভিন্ন রাস্তায় আলোক-বাত্তি বা লেম্পের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর থেকে অনুমেয় যে, ঐ সময় দরগার মুফতি পরিবারের সেই আর্থিক সংগতি ছিলো না যে, জনকল্যানে তাঁরা প্রচুর ব্যয় করতে পারতেন। যাইহোক ওবায়দুর রাজার এই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর প্রথম পুত্র দেওয়ান আবুল হোসেন আলী রাজা জন্ম গ্রহন করেন ১৮৬১ সনেÑ যে-বছর আমাদের বাংলা বিশ্ববরেন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। মায়ের আতুর ঘরেই আবুল হোসেন মাতৃহারা হয়ে পড়েন। শাহজালাল (রহ:)এর দরগাশরীফে মায়ের দাফনের পর কয়েক বছর মামার বাড়ীতে লালন পালনের পর শিশুপুত্রকে রামপাশায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইতিমধ্যে যখন পুত্র আবুল হোসেন ছয় বছর বয়স, তখন ওবায়দুর রাজা দ্বিতীয় বিবাহ করেন আসামের করিমঞ্জের অন্তর্ভূক্ত কুশিয়ারকুল পরগনার উজানডির গোলাম ইউসুফ চৌধুরীর কন্যা সাজিদা বানুকে। ঐতিহাসিক প্রতাপগড় সরকারের অঞ্চলটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি প্রতাপগড় আর অন্যটি জফরগড়। সাজিদা বানুর আট বছর বয়স্কালে তাঁর প্রথম বিয়ে হয় তাঁর পিতার এজিনে (প্রতিশ্রæতি) জফরগড়ের জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরীর সাথে, যদিও তাদের বয়সের তারতম্য অনেকখানি ছিল। সাজিদা বানু প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে স্বামীর ঘরে যাওয়ার আগেই নওয়াব আলী মারা যান এবং তাঁর কোন সন্তানাদি না থাকায় সাজিদা বানু এই স্টেইটের সম্পূর্ন মালিক হয়ে যান। যখন তিনি সাবালিকা হন, তখন তাঁকে বিয়ে দেয়া হয় ওবায়দুর রাজার কাছে। জফরগড় এস্টেটটিও রামপাশা জমিদারী অর্ন্তভূক্ত হয়ে যায়। সজিদার বানুর গর্ভে পুত্র দেওয়ান আজিজুর রাজার জন্ম হয় ১৮৬৯ সালে। ইনি হলেন ওবায়দুর রাজার দ্বিতীয়পুত্র। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত: তিন বছরের শিশুপুত্র আজিজুর রাজাকে রেখে ১৮৭১ সালে পিতা ওবায়দুর রাজা এই দুনিয়া হতে চিরবিদায় নেন আর এর ঠিক চল্লিশ দিনের মাথায় দাদা আলী রাজাও ছেলেকে অনুসরন করে ইহলোক ত্যাগ করেন। (গনিউর রাজার তথ্যকথা বই নং ২ )

আদম খাঁ জগন্নাথপুরের সৈয়দপুর নিবাসী। তিনি ছিলেন ফার্সী পন্ডিত। প্রায়ই ওবায়দুর রাজার কাছে আসা যাওয়া করতেন। ভাষাচর্চায় তিনি তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুর মত ছিলেন । আদম খাঁ সেই সুদুর সৈয়দপুর গ্রাম থেকে ওবায়দুর রাজার সঙ্গ লাভের জন্যে পায়ে হাটাপথে কষ্টদায়ক ভ্রমন করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। ওবায়দুর রাজার মৃত্যুর পর একবার আদম খাঁ ও হাসন রাজার মাঝে দেখা হয়। হাসন রাজাকে দেখে আদম খাঁ তাঁর অভিমত ব্যক্ত করলেন, বড়ভাইয়ের মতই সুদর্শন হাসন রাজাও। এ শুনে হাসন রাজা বললেন: “আমার ভাই ওবায়দুর রাজা শুধু সুদর্শনই ছিলেন না, তিনি ভাষায় সুপন্ডিত এবং জ্ঞানগরিমা ও চিন্তায় এই মুল্লুকে তাঁর মত আর কেউই ছিল না”। (দাদা আজিজুর রাজার কথা: দেওয়ান আলমনুর রাজা, প্রতি দিনের বহুকথা, ১৯৫৫) ওবায়দুর রাজা খুবই বন্ধুবৎসল ছিলেন। তাঁর বন্ধুগনের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন পাটনার নওয়াব ফতেহ আলী খাঁন, ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনি (নওয়াব আহসান আলীর পিতা) পৃত্তিমপাশার আলী আহমদ খাঁন (আলী আমজদ খানের পিতা) এবং সিলেটের শেখঘাটের জিতু মিয়া সাহেবের চাচা আবদুর রহমান খান ও কাজী ইলিয়াস এলাকার একসময়কার মন্ত্রী কাপ্তান মিয়া সাহেবের পিতা সৈয়দ আব্দুল জলিল।



আলী রাজা তাঁর এক বন্ধু রহমান খানের বিধবা স্ত্রী নুর বিবিকে বিবাহ করে তাঁর এই তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভে-ধরা এক ছেলে এবং এক মেয়েকে সিলেট শহরে রেখেই বড় করে তুলার ব্যবস্থা নেন। কন্যা সন্তান সইফা বানু এবং পুত্রের নাম মুজাফ্ফর রাজা। আগেই বলা হয়েছে, হাসন রাজার নামের বেলায় ‘হাছন’ শব্দের ‘ছ’ উচ্চারনের ক্ষেত্রে আরবি বা ফারসি ‘সিন’ বর্ণের উচ্চারনের অনুরূপ। তাই এযুগে ‘হাছন’ শব্দের পরিবর্তে ‘হাসন’ ব্যবহারে অভিমত দিয়েছিলেন অগ্রজ গবেষক ও হাসন রাজার দৌহিত্র দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। পারিবারিক পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র ‘হাসন’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি একই রকম কারনে ‘ছহিফা’ এর বেলায়ও ‘সহিফা’ বা ‘সইফা’ উচ্চারিত হয়ে থাকে। সহিফা বানুর জন্ম হয় ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ ১২৫৭ বাংলায়। সহিফা ছিলেন ছোট বেলা থেকেই চঞ্চলা আনন্দময়ী বালিকা। বাবার একমাত্র কন্যা আর ভাইদের একমাত্র বোন হওয়ায় সবসময় হাসিখুশীর মধ্যে তাঁর দিন কাটতে শুরু করে। যখন হাসন রাজার ছয় কি সাত বছর বয়স তখন তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে সিলেট যান এবং সেখানেই বছর তিনেক সময়কালের জন্যে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই ও বোনের সাথে বাল্যের কিছুটা সময় কাটে। বোন সহিফা বানু এবং মোজাফ্ফর রাজার কাছে অতি আদরের হাসন রাজা তখন বন্ধুর মতই ছিলেন। ছোটবেলায় “হাসন রাজার কাছে তাঁর বোন সহিফা ছিলেন তাঁর একান্ত আদরের ‘সই’। এ সহিফা বানুর বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় কৈশোরেই দেখা দিয়েছিল।” (দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সোনাঝরা দিনগুলি, রাগিব রাবেয়া ফাউন্ডেশন, জুন ২০০১ ঢাকা পৃ: ১৮)

সহিফা বানুর জীবনচারিতা লেখিকা নুর রওশন চৌধুরীর মতে, তাঁর (সহিফা বানুর) “প্রথম বিবাহ সিলেটের খালপাড় (ছনখাইড় পরগনার) নিবাসী আরজুমান্দ আলী চৌধুরীর সহিত ১২৭৩ বাংলায়। (১৮৬৭ইং সনে)। বিয়ের কিছুদিন পর আরজুমান্দ আলী চৌধুরীর মৃত্যুবরন করেন”। (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ৩১)। কিন্তু দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের লেখা মতে: “তাঁর আব্বা আলী রাজা তাঁকে তাঁর পছন্দ মত এক বরের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিবির সঙ্গে সেই বরের বনিবনা না হওয়ায় তিনি তাঁর কাছ থেকে তালাক নেন।” (দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সোনাঝরা দিনগুলি, রাগিব রাবেয়া ফাউন্ডেশন, জুন ২০০১ ঢাকা পৃ: ১৮)

বাবা আলী রাজা এবং বড়ভাই ওবায়দুর রাজা যতœসহকারে সহিফার প্রথম বিয়েটি দিয়েছিলেন। বিয়েটি ভেঙ্গে যাওয়ায় কিংবা খুব সম্ভবত মৃত্যুজনিত কারনেই অতি অল্প বয়সে স্বামী-বিয়োগে সহিফা বানু মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। বছর তিনেক পর যখন তাঁর বাবা ভাই একই সাথে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান, তাঁর মন আরো অধিকতর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বছর তিন চারেক গত হওয়ার পর সইফা বানুর দ্বিতীয় বিয়ে হয় ১২৮১ বাংলার আশ্বীন মাসে অর্থাৎ ইংরেজী ১৮৭৫ সনে। সিলেটের অতি সম্ভ্রান্ত মোগল আমলের ফৌজদার আবু তোরাব খাঁনের বংশধর হাসান নওয়াজের একমাত্র পুত্র আব্দুল ওয়াহিদ ওরফে হিরন মিয়াকে স্বামী হিসেবে সইফা বানু বরন করেন। তখন বাবা আলী রাজা ও বৈমাত্রেয় বড় ভাই ওবায়দুর রাজা আর জীবিত নেই। এই বিয়েতে ছিল তাঁর আপন ভাই মোজাফ্ফর রাজা ও বৈমাত্রেয় ভাই “হাসন রাজার সম্মতি” (দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সোনাঝরা দিনগুলি, রাগিব রাবেয়া ফাউন্ডেশন, জুন ২০০১ ঢাকা পৃ: ১৯)। এই ফৌজদারের বাড়ী (বর্তমানে দারগা বাড়ী নামে খ্যাত) বিস্তৃত ছিল সিলেটের বর্তমান সমস্ত জেল ও জেলের পূর্বে ধোপাদিঘি পর্যন্ত। এই জেলের ভিতরে এই পরিবারের প্রাচীন অনেকের কবরের চিহৃও বিদ্যমান। জেলের দক্ষিণ পাশের মসজিদটি এখনও “আবু তোরাব মসজিদ” নামে পরিচিত। তাঁেদর বংশধর এই বাড়ীর কিয়দাংশে জেলের পশ্চিম দিকে এখনও বসবাস করছেন। এখানে উল্লেখ্য যে এই দাড়গা বাড়িটি একসময় সিলেটের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার লালনক্ষেত্র হিসেবে কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করেছিল। এই হিরন মিয়ার চাচাত ভাই বৃটিশ কলোনী কালের পুলিশ অফিসার দারগা জনাব আব্দুস সাত্তার পাকিস্থানের সুপরিচিত রাজনিতিবিদ ও এককালিন প্রধান মন্ত্রী শওকত আলীকে উনার সিলেটের নয়াসড়কস্থিত বাড়ীতে আথিত্য দেখাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি কি খাবেন, তিনি জবাব পেলেন: সামান্য খাবার চাইÑ ৪০টি ডিম ও এক জগ কমলা লেবুর রস। পরবর্তিকালে ১৯২৮ সালে আবাদুস সাত্তারের পুত্র জনাব গোলাম মুস্তফা ( সিলেটের এক দৈনিক পত্রিকা এর সম্পাদক ) সুবিখ্যাত বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে উনার সিলেট সফরকালে একই বাড়ীতে আথিতেয়তা দেখিয়েছিলেন। ( ছবিটি দ্রষ্টব্য) গোলাম মুস্তফার ছেলে শেখ আহমেদ হোসেন কুরেশী যাঁর স্ত্রী মোসাম্মত আম্বিয়া খাতুনের কাছে পারিবারিক সুত্রে আসা এই ছবিটি এবং এই তথ্যগুলা সংগৃহিত হয়। সুখের সংসার বাধবার উদ্দেশ্যে সহিফা বানু অনেক আশা ভরসা নিয়ে শুরু করলেন নুতন জীবন, কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, তাঁর জীবনে আর সুখ সইল না। সহিফা বানুর গর্ভধারিনী হওয়ার সম্ভাবনা নেই - লোকমুখে প্রচার হওয়াতে সইফা বানু হিরন মিয়াকে তাঁর চাইতেও সুন্দরী কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিলেন, কিন্তু তাতেও হিরন মিয়াকে বেধে রাখা গেলো না, তিনি ঠিক আগের অভ্যাসমতই নিষিদ্ধ পল্লীতে আনাগুনা এবং মাদক সেবন চালিয়ে যেতে থাকলেন। সইফা বানু এরপর আরেকটি অধিকতর সুন্দরীকে বিবাহ করিয়ে হিরন মিয়ার এই কলুষিত অভ্যাস থেকে দুরে সরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা চালালেন, কিন্তু তারপরেও সফল হলেন না। শেষে যখন “পঞ্চাশ পার হওয়ার পর হিরন মিঞার হিরন্যের মত সৌন্দর্য আস্তে আস্তে কালিমায় ঢাকা পড়লো। স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়ে হিরন মিঞা গর্ভধারিণী মাতার কোলে আশ্রয় গ্রহন করলেন এবং সহিফা বিবি আমৃত্যু কেবল নিজেই বৈধব্য দশাগ্রস্থ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন না, সঙ্গে সঙ্গে আরও দুই সতিনকেও সে দশাগ্রস্থ হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে তুললেন।” (দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সোনাঝরা দিনগুলি, রাগিব রাবেয়া ফাউন্ডেশন, জুন ২০০১, ঢাকা পৃ: ২০)

সুনামগঞ্জ ও বিশ্বনাথস্থিত রামপাশা যাওয়া-আসার পথে মধ্যবর্তী স্থান সিলেটের কুয়াড়পাড়ে হাসন রাজা মাঝে মধ্যে বোনের বাসায় উঠতেন। সেখানে হাজির হলে হাসন রাজা প্রায়ই মরমী ও লোকগান চর্চার একটি সুন্দর সুযোগ পেতেন। এক এক সময় সেই বাসায় উঠলে তিনি একনাগারে চার-পাঁচ দিন কাটিয়ে দিতেন। সেখানে কোন কোন দিন গানের আসর জমে উঠলে হাসন রাজা গানের ভূবনে ডুব দিতেন। বিভোর হয়ে শুনতেন বোনের লেখা গানের কথা, কখনও আবার নিজের গানগুলা সেখানে পরিবেশন করতেন। এতে উপস্থিত সবাই তাঁর গানেও যোগ দিত। সহিফা বানুর বাসস্থানে গানের আসর বা মাহফিলের পরিবেশটির কিছুটা বর্ননা দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেবের অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায়: সেই সময়টা ছিল ১৯১২ইং সন, হাসন রাজার মৃত্যুর প্রায় ১০ বছর আগের কথা: “সেখানে এক শাহী কান্ড! প্রকান্ড একটা হলে কার্পেট পাতা। তার উপরে সাদা ধবধবে ফরাস। কয়েকটা গিরদক বালিশও রয়েছে। হাজী বিবি (সহিফা বানু) একটা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন, সামনে মুরাদাবাদী পানদান। তার পাশে সমগোত্রীয় পিকদানও। ফরাসের দক্ষিনপ্রান্তে একজন যুবক বসে রয়েছে। শ্যামবর্ণ একহারা গঠনের। মুখে গোঁফ, দাড়ি নেই। মাথায় দীর্ঘ টেরি। গায়ে পশমী আলোয়ান। সে এসেছে তার দলবল নিয়ে তার গান হাজী বিবিকে উপহার দিতে। -- সে লোকটি গান শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে তাদের দলের একটা লোক ঢোলকে সঙ্গত করতে আরম্ভ করলো। একটি লোক মন্দিরা বাজিয়ে তাতে রঙ্গ ফলাতে শুরু করলো। গানের সবক’টি পদ আমার মনে নেই। যে-দুটো পদ এখনও স্মৃতির কামরায় পাকা বাসা বেঁধে রয়েছে- তা তুলে দিচ্ছি:




‘আমি যাইমু নিগো আর
সঈফা বিবির বাড়িতে
ছিলহট কুয়ার পার


হাজী বিবি মিষ্টি হাসি হাসছেন এবং পিকদানে পিক ফেলছেন।” (দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সোনাঝরা দিনগুলি, রাগিব রাবেয়া ফাউন্ডেশন, জুন ২০০১, ঢাকা পৃ: ১৬)। এমনি রকম পরিবেশে অনেক সময় দুই ভাইবোন হাসন রাজা ও সহিফা বানু গানের মাহফিলে আসর জমিয়ে মরমী গানের উচ্ছাসে বিভোর হয়ে থাকতেন। প্রায়ই সহিফা বিবি তাঁর গানের আসরে হাসন রাজাকে গানের ভাষাতেই উষ্ণ সম্ভাষন জানাতেন:
“সুনামগঞ্জের হাছন রাজা আলী রাজার নন্দন,
টাকা-কড়ি অন্ন বস্ত্র, সদায় করে বিতরন।
আইস ভাই-ধন, বইস তুমি মসলন্দের উপর” (সহিফা বানু)
সহোদর ভাই মোজাফ্ফর রাজা ১৮৯৯ সনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, উপর্যপোরি স্বামীর মৃত্যু হয় ১৯০৬ সনে। তার পরপর তাঁর দুনিয়ার যাবতীয় সহায় সম্পদের বন্ধন ছেড়ে দিয়ে তাঁর ভাইয়ের একমাত্র বেঁচে থাকা কন্যা “ভাতিজি আলী রওশন বানুকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে মক্কায় বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলে দেওয়ান হাছন রাজা বিষয়টি জানতে পারেন।” (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ২৫)। তাঁর এই অভিপ্রায় আমরা তাঁর একটি গানেও উল্লেখ পাই:
“বাংলাদেশের বড় অলি শাহাজালাল পীর
আনন্দে বিদায় দিয়া আমায় কর স্থির।
আমি তোমার তুমি আমার আর ত কেহ নাই
জন্মের মত বিদায় হইয়ে মদিনাতে যাই।
মাতাপিতা কেহ নাই, নাই ভাতিজা
সিলেট থাকিয়া আমার কোন ফল নাই।
বাংলাদেশে জন্ম লইয়া না হইল সুখ
মদিনাতে গেলে আমার সফল হইবে দুখ
যখনে যাইমু আমি মদিনা শহর
মোমের পঞ্চ বাত্তি দিমু এলাহির নজর।
যদি আল্লাহ দেখায় মোরে রসুলউল্লাহর ঘর
পঞ্চ দুম্বা সির্ন্নি দিমু হেরেমেরে ভিতর।
জীবন থাকিতে যার হইবে মরন
ইহকালে পরকালে সফল তার জীবন।
সহিফায়ে বলে দেশে থাকিয়া কিবা সার
একদিন ত ছাড়তে হবে এই ভবের বাজার


হাসন রাজা সইফা বানুর অত্যন্ত প্রিয় ছোটভাই ছিলেন। তার একটি বিশেষ কারন ছিল, সেটি হলো হাজি বিবি দেখলেন ১৮৭১ সালে বৈমাত্রেয় বড় ভাই ওবায়দুর রাজা ইহলোক ত্যাগ করলেন এবং তাঁর সাথে বাবাও। এরপর বৈপত্রিক বড় ভাই সুলতান খাঁরও ইহলোক ত্যাগ। কয়েকবছর পর আবার তাঁর চোখের সামনে দিয়ে তার সহোদর মুজাফ্ফার রাজাও চলে গেলেন। বাকী প্রায় ১৮টি বছর - হাসন রাজাকে একমাত্র ভাই হিসেবেই আকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, নিজের কাছে তার মৃত্যু আগ পর্যন্ত।

বোনের মক্কার যাওয়ার খবর পেয়ে কিছুদিনের ভেতরেই হাসন রাজা “সুনামগঞ্জ থেকে কুয়ারপাড় হাজিবিবি হাউস-এ এসে হাজির হন। হাসন ‘রাজার ইচ্ছে তাঁর ছেলের বিয়ে দিয়ে আলী রওশনকে দেশে রেখে দেবেন। এ নিয়ে তিনি বোন ছহিফা বানুর সাথে পীড়াপীড়ি শুরু করেন। ছহিফা বানু ছোট ভাইয়ের আব্দার ফেলতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত হাছন রাজার কথা রক্ষা করলেন। হাছন-পুত্র দেওয়ান একলিমুর রাজার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর, আর আলী রওশনের বয়স ছিল মাত্র এগারো বছর। ১৩১৩ বাংলার ১৪ অগ্রহায়ন মোতাবেক ৩০/১১/১৯০৬ খৃ: দেওয়ান হাছন রাজার ইজিনে দেওয়ান একলিমুর রাজার সাথে আলী রওশনের কাবিননামায় পাঁচ হাজার টাকা মোহরানা ও ৬০ হাল জায়গাসহ বিয়ে স¤পাদন হয়।” (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ২৫)।

প্রামান্য সাক্ষ্য কিংবা কোন নথিপত্তর সাক্ষ্যের ভিত্তিতেও নয়, শুধুমাত্র উপরের এই একটিমাত্র বিয়ে সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কারনেই পরবর্তীকালে অনেকের মতানুশারে হাসন রাজা আরোপিত হলেন, রূপান্তরিত হলেন অত্যাচারী, জুলুমবাজী হাসন রাজা হিসেবে। আদতে হাসন রাজা জীবনে কখনোও অত্যাচার অবিচারের আমলও দেন নি কিংবা এধরনের মনোভাব তাঁর কোনজীবনে ছিলও না । হাসন রাজাকে একজন জুলুমবাজী হিসেবে বিবেচনা করা যে ভারি একটি অন্যায় ব্যাপার তা যে কোন সুস্থমস্থিস্কসম্পন্ন লোকের কাছে সহজেই বোধগম্য।

উপরের গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিষয়টি সামনে রেখেই সইফা বানু এমনকি হাসন রাজাও একটি নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েন এবং সইফা বানু এ ক্ষেত্রে একটি কবিতার সৃষ্টি করেন যাকে ভিত্তি করে কিছু লেখক, নাট্যকার কিংবা চলচ্চিত্রকার মনগড়া আজগুবি কল্পনার আশ্রয় গ্রহন করেছেন এবং কোন ভিত্তি ছাড়া দেওয়ান হাসন রাজাকে নারী ঘেষা সাজিয়েছেন।

যুক্তিযুক্ত বা ন্যায়সঙ্গতি নয় বরঞ্চ নিছক পারিবারিক স¤পর্কের এরকম একটি জটিলতাজনিত উদগত এক সমস্যা থেকে সহিফা বানু ভাইয়ের প্রতি আবেগ অভিমান কিংবা নিছক এক আপনজনের উষ্মা প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তাঁর ছোট উর্দ্দু কবিতায় যা পরবর্তীকালের গবেষকদের জন্যে হাসন রাজাকে তথাকথিত এক নেতিবাচক অর্থে অত্যাচারী জুলমবাজী জমিদার হিসেবে দেখা কিংবা সমালোচনা করার একটি বড় উপাদন জুগিয়েছিল।

গানটি ছিল এরকম:

“হাছন রাজানে এয়সা জুলুম-কিয়া
এতিম কু ফুসকে লোক আতশ মে ডাল দিয়া।
ইয়ে দুনিয়া ফানি হায়, এক রোজ জানা হোগা
জোর-জুলুম কা মজা উধার যাকে চাখনা হোগা,
ছহিফা বেকুফনে এয়সা বেওকুফি কিয়া
হাসন কো খাতির করকে, এতিম কো ডুবা দিয়া।
এই কবিতাটিতে স্পষ্ট বুঝানো হয়েছে এই জুলুমটি এক এতিম-প্রসঙ্গ ক্ষেত্রে। আর এই এতিম আর কেহ নন, তিনি সঈফা বানু কিংবা হাসন রাজারই ভ্রাতুষ্কন্যা আলী রওশন বানু। এই ঘটনার পুরো আলোচনার অবতারনা না করে এইটুকু বলা যায় যে, হাসন রাজার এজিনে পিতৃহীন ভ্রাতুষকন্যার বাল্যবিবাহ স¤পন্ন হয়। স¤পত্তি, আশয়-বিষয়ের জন্য স্বামীর (হাসন রাজার পুত্র) তরফ থেকে স্ত্রীর (হাসন রাজার পিতৃমাতৃহীন ভ্রাতুষ্কন্যা) উপর নানারূপ চাপ সৃষ্টি করায় এতিমের ফুফু সহিফা বানু ছোটভাই হাসন রাজাকে দায়ী করলেন উপরের কবিতায়। ১৯৭৫/৭৬ এর দিকে এক তরূন নাট্যকার পুলিশ অফিসার ডিএসপি প¥ীথিকুমার চন্দ্রের উপরের গানের অপব্যাখ্যার প্রতিবাদ করে তখনকার বিচিত্রায় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন;“এতে হাজী বিবি যে অভিযোগ করেছেন তা নিতান্ত পারিবারিক বিষয়।-----যে অভিযোগ করা হয়েছে তাতে প্রমানিত হয় না যে, হাসন রাজা এক জালিম ছিলেন। এর পশ্চাদপদে রয়েছে এক বিয়ে।” (নৃপেন্দ্রলাল দাস, হাসন রাজা, শব্দ নৈ:শব্দ, অনুপম প্রকাশনী, ২০০৪ ঢাকা পৃ: ১৪৬)

সহিফা বানুর জীবনচারিতা লেখিকা নুর রওশন চৌধুরী আরো লিখেছেন “দেওয়ান একলিমুর রাজা ও আলী রওশনের দুটি কন্যা সন্তান জন্ম হয়। তাঁরা হলেন, মাহে জাঁহা চৌধুরী ও হেলাল জাঁহা চৌধুরী। কোন পুত্র সন্তান না থাকায় দেওয়ান একলিমুর রাজা হাজিবিবি হাউসের সকল স¤পত্তি নিজের করে নিতে চাইলেন। এ বিষয়ে জনৈক কটাই বাবু নামের এক নায়েব একলিমুর রাজাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন বলে জানা যায়। এ নিয়ে ফুফু ছহিফা বানু ও স্ত্রী আলী রওশন বানুর সাথে তার কলহ-বিবাদ, মামলা-মোকাদ্দমা শুরু হয়। কবির মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একলিমুর রাজার সাথে এ মামলা-মোকাদ্দমা চলতে থাকে।” (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ২৫/২৬)। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ঐ সময় ষাটের কোটা পার হওয়ার পর হাসন রাজাও পারিবারিক বলয় এবং পারিপার্শিকতা থেকে অনেকটা নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন বলে পুত্র পরিজনের উপর তাঁর প্রভাব খাটানোর মাত্রাও একেবারে শুন্যের কোটায় চলে আসে। সহিফা বানু তাঁর উপরের কবিতাটি যখন সৃষ্টি করেন তখন তাঁর নিজের এবং ছোট ভাই হাসন রাজার বয়স ছিল ষাটর্দ্ধো ।

“১৩১৪ বাংলায় মোতাবেক ১৯০৮ সালে হাজী বিবির প্রাসাদতুল্য বাড়ীর চৌদ্দটি ঘর আকস্মিক আগুনে পুড়ে গেলে কবি ছহিফা বানু সেখানে নুতন দুটি ঘর নির্মান করেন।” (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ৩২)। ভিটার পশ্চিম ও পূর্বদিকে পৃথক পৃথক দুটি কাঠের দ্বিতল ঘর নির্মান করা হয়। ঘর পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে কবি সহিফা কবিতাটি লিখেন:

আমার কেও নাইরে এ ভবের বাজারে
আচম্বিতে ঘটল দু:খ আউয়াল জুম্মাবারে।
স্বপনেতে প্রাণনাথে জানাইছিল আমারে
না বুঝিয়া ভুলিয়া রইলাম আনন্দ নগরে
তেরশ চৌদ্দ বাংলার তিরিশ ফাল্গুনেতে
বাড়ীঘর জ্বলিয়া সব গেল ছারখারে।
এমন বান্দব নাই ডাকিয়া জিজ্ঞাস করে
ভবের মায়ায় ভুলিয়া রইলাম না ভজিলাম তাঁরে।
এইজন্য প্রাণনাথে দু:খ দেয় আমারে।
অপরাধ যাহা করেছি সব ক্ষমা করে
মরন সময়ে যেনো দেখা দেও আমারে।
দরশন ভিখারী হইয়া আছি তাঁর দোয়ারে।
ছহিফায়ে বলে যেন ডাকিয়া আমারে।


লেখিকা নুর রওশন চৌধুরী লিখেছেন “শেষ জীবনে কবি ছহিফা বানু বাতরোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শয্যাগত ছিলেন। একলিমুর রাজা ফুফু ছহিফা বানুকে এ অবস্থায় রেখে কবির সখের দালানকোঠা ভাঙ্গতে শুরু করেন। দু:খে কবি ছহিফা বানু কেঁদে কেঁদে আলী রওশনকে ঐ দালানঘর থেকে তাঁকে সরিয়ে নিতে বলেন। দালানঘরের পশ্চিমে অবস্থিত কাঠের দ্বিতল ঘরে তাকে স্থানান্তর করা হল। বর্তমানে এ কাঠের ঘরটি কালের প্রমাণস্বরুপ দন্ডায়মান অবস্থায় রয়েছে। ছহিফা বানুর আকুতি-মিনতিতে একলিমুর রাজার মন গলেনি বরং তিনি দালানটি পুরো ভেঙ্গে ফেলেন। মহান আল্ল্হাতায়ালার কাছে ফরিয়াদ করা ছাড়া কবি ছহিফা বানুর অন্য কোন উপায় ছিল না।” (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ২৭)। এখন আমাদের বিশ্বাস পাঠকের নিশ্চয় হৃদয়ঙ্গম হয়েছে যে, কোথায় হাসন রাজার অত্যাচারের কথা, কোথায় তার প্রমান, সে তো সহিফা হাজী বিবির উর্দূ কবিতাটি নয়, তাহলে সেটি কোথায়? আমাদের উত্তর: এটি একালের মনগড়া ‘হাসন রাজা’ সিনেমার ছবিটির স্ক্রিপ্ট নির্মাতার আপন মননশীলতা। হাসন রাজা তো কবি, মানুষের দরদী মন হাসনজানের প্রেমাস্পদ। অত্যাচার শব্দটি তাঁর কাছে একেবারেই খাটি দুশমন ছিলো কিংবা অপরিচিত ছিল বলেই বলা চলে।

সহিফা বানু বাংলা এবং উর্দূ এই দুই ভাষাতেই গান রচনা করতে পারতেন। তিনি ছিলেন শ্রীহট্টের প্রথম মুসলমান মহিলা কবি। ছোটবেলা থেকেই সহিফা বানুর মধ্যে কবি-প্রতিভা দেখা দেয়। বাংলা ভাষায় তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়। একটি ‘ছহিফা সঙ্গীত, অন্যটি ‘ছাহেবানের জারি’। তাছাড়া ‘ইয়াদগারে ছহিফা’ উর্দূ ভাষায় তাঁর আরেকখানা রচনা। এই গ্রন্থগুলা এখন একেবারেই দু:¯প্রাপ্য। অনুমান করা হয় তাঁর এই লেখাগুলার ছাপায়িত কপি মুসলিম সাহিত্য সংসদে রক্ষিত আছে। ইদানিং তাঁর বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে ২৫৬ খানা গানসহ আটখানা জারি সংকলিত করেছেন নূর রওশন চৌধুরী তাঁর ‘ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য’ গ্রন্থে।

সহিফা বানুর কাব্যগ্রন্থের একটি কাব্য ‘ছহিফা সঙ্গীত’এর প্রকাশনা বিবরনী পৃষ্টায় লিখা ছিল নিম্নরুপ:

শ্রী শ্রীহক নাম
ছহিফা সঙ্গীত শ্্রীহট্ট সওদাগরটোলা নিবাসী শ্রীযুক্তা মুছাম্মাত ছহিফা বানু সাহেবার দ্বারা প্রনীত।

শ্্রীহট্ট সওদাগরটোলা নিবাসী শ্রী আব্দুল জব্বার কর্তৃক প্রকাশিত। শ্রহীট্ট।

বন্দরবাজার ইসলামিয়া প্রেস শ্রী মহাম্মদ আব্দুল গনি দ্বারা মুদ্রিত। সন: ১৩১৪ বাংলা

আধুনিক মনের শিক্ষিতা বোন সহিফা বানু স¤পর্কে হাসন রাজার মনে একটি গর্ববোধ ছিলো। বোনের কর্মোদ্দিপনা ও কর্ম-তৎপরতা দেখে মনের কোটায় একটি চমৎকার দুর্বলতা ছিলো তাঁরজন্যে। “সহিফা বানুর বিভিন্ন গুনের অধিকারী হওয়ায় ও তাঁর কাব্যিক প্রতিভা থাকায় তাঁর প্রতি হাসন রাজার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্মায়”। (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ২৩)

বৈমাত্রেয় বড়বোন সহিফা বানুকে ইঙ্গিত করে হাসন রাজা প্রায়ই লোকের কাছে বলতে শুনা যেতো “আমার বোনের মত তোমরা তোমাদের স্ত্রী-কন্যাদের শিক্ষিত করে তুলো”। (নুর রওশন চৌধুরী, ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য, পৃ: ২৩)

সহিফা বানু অত্যন্ত পরপোকারী মহিলা ছিলেন। অনাথ এতিম গরীব দু:খীদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। জনদরদী কবি সহিফা সিলেটের লামাবাজার এলাকায় লোকজনের পানির কষ্ট লাঘবে লামাবাজারের গায়েব (রহ:) সাহেবের মোকামের পশ্চিম পার্শ্বে একটি দিঘি খনন করান এবং তার নাম দেন ‘শ্যামসুন্দর দিঘি’। লোকের সুবিধার জন্যে হাটবাজার, রাস্তা, মাদ্রাসা ইত্যাদি নির্মানে উদ্যোগী ভুমিকা পালন করেন। এর মধ্যে ছহিফাগঞ্জ বাজার, ছহিফাগঞ্জ ঈদগাহ, ছহিফাগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছহিফাগঞ্জ সুলতানিয়া দাখিল মাদ্রাসা উল্লেখযোগ্য।

সহিফা বানু অত্যন্ত ধর্মানুরাগী ছিলেন। তিনি কুয়ার পাড়ে একটি মসজিদ তৈরী করান। এই মসজিদটি বর্তমানে পুননির্মিত হয়ে বহুতল ভবনে রুপান্তরিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে উপমহাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক পশ্চাদপদ ছিল এবং যাতায়াত করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। ঐ সময় হজ্জযাত্রীদের জন্যে তিন মাস হাতে নিয়ে পর্যাপ্ত খাবার ও বিশ্রামের সরঞ্জামাদিসহ হজ্ব পালনে বের হতে হত। সিলেট থেকে চাঁদপুর, সেখান থেকে স্টীমারযোগে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, এরপর ট্রেনে করে কলকাতা। সেখান থেকে আবার জাহাজে করে বোম্বে হয়ে সৌদি আরব পৌছাতেন। এত কষ্ট ও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করতে তিনি তিন-তিনবার হজ্জব্রত পালন করেছেন। তাঁর হজ্জ সফর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন সজিদা বানু ও ভ্রাতু®পুত্র দেওয়ান আজিজুর রাজা।

সহিফা ছিলেন অত্যন্ত দানশীলা। অনেক অনাথ মেয়েছেলেদেরকে ভরনপোষন ও প্রতিপালন করে তিনি বিয়ের ব্যবস্থা করেন এবং জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থাও করিয়ে দিতেন। তাঁর বিনয়, নম্রতা, দানশীলতা আর আধ্ম্যাকিতার কিছুটা পরিচয় পাই আমরা তাঁর নিম্নের কবিতাগুলোতেও।

কি করিলে অধিক ফল হয় শুনো হকিকত
দেখ, পার যদি করিও বান্দা দান ছকাওত।
গরিব মজলুম আসে যদি করিও মুদত।
নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়া করিও মহব্বত।
মেহমান মুসাফির আসিলে করিও হেফাজত
বেওয়া বেকচ এতিম এছিরকে করিও রহমত।

আমি যদি হইতাম বাগানের বাগবান।
বাগানসহ যত পু®প করিতাম গো দান।
বুলবুলের হস্থে ধরি ওমনি বলিতাম
যাও তুমি এখান হতে চলে অন্যস্থান।
ছহিফা বলে ভবে কি যে করলাম দান,
কেন সবে মোরে দানী বলে করে অপমান।

ভাইবোনের মাঝে যে একইরকম একটি খাটি মন মানসিকতার মিল ছিলো, সেটি দেখা যায় যখন ধর্মাপরায়না মুসলিম মহিলা কবি অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিতে হাসন রাজার মতই শ্বাশত: হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্র প্রভাবে একটি সুন্দর সমন্বয়ী পরিচয় ঘটিয়েছেন তাঁর নী¤েœর গানটিতে:

চন্দ্রাবলী বলে সখি যাই, চল তরা কৈরে
গকুলেতে গিয়ে শ্যামকে আনি চরণ ধৈরে।
আনিয়ে তারে যতœ কৈরে বসাব সমাদরে
বামে বসাইব সই, প্রানপ্রেয়সী রাধিকারে।
ছহিফায় বলে, বল হরে কৃষ্ণ হরে হরে
রাম কর্ত্তাল বাজায়ে নাম জপ মধু স্বরে।

অন্যদিকে আবার গেয়ে উঠেছেন:
ছাড় ছাড় ছাড়রে মন এই ভবের ফিকির
হুস থাকিতে কর তুমি ই ইল­ালাহর জিকির।
ওমন আর কি তর ফিকির
লাই লাহা ইল­াললাহু অমূল্য রতন।
মহাম্মাদুর রসুলুল­াহ করহে সাধন।

কবি সহিফা বানু ১৯১৭ সালে মোতাবেক ১৩২৫ বঙ্গাব্দে পরলোকগমন করেন। সারা জীব-জগতের মায়া কাটিয়ে হাজি বিবি সিলেটের হযরত শাহজালাল (র:) এর দরগায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। ভেঙ্গে পড়ে হাসন রাজার মন।

আগেই বলা হয়েছে সঈফা বানু যদিও বৈমাত্রেয় বড় বোন তথাপি একমাত্র বোন হিসেবে এবং মাত্র বছর তিনেক বয়সের বড় হওয়ার ব্যবদান হওয়া স্বত্তেও হাসন রাজার কাছে তিনি সবসময়ই একজন অতি আপনজন ও বন্ধুর মতই ছিলেন। ১৯১৭ সালের কথা। সেই বছর সঈফা বানু পরলোকগমন করেন তখন এ সংবাদ পেয়ে কবি হাসন রাজা মর্মাহত হন। ছুটে এসেছিলেন সেদিন সিলেটে। হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার শরীফ প্রাঙ্গনে তখন তার বোনের মরদেহটি কফিনের মধ্যে শুইয়ে আছে। ক্রন্দনরত আত্মীয়স্বজনের মাঝে এমনি এক আপনজনের শেষটুকু অস্থিত্ব দেখার সাথে সাথেই তার দু’গাল বেয়ে বিশাদসিন্ধু থেকে উঠে আসা বারিধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। প্রায় ১২ বছর আগে মায়ের দাফনের পর যেমন একটি অনুভূতি কাজ করেছিল তার মধ্যে, সেই শূন্যতা আর শূন্যতাই যেনো চারদিকে হাসন রাজার মানসচক্ষে ধরা পড়ে। তিনি অনুভব করেন এই মায়াবিনী পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া সবই শূণ্য। হাসন রাজা নিজেকে একটু সামলে নিলেন। যে বোনকে কেন্দ্র করেই প্রায় প্রতিবছরই সিলেট শহরে আনাগোনা, সেই বোনের মৃত্যুর পরপরই যেনো সেদিন হাসন রাজার সিলেটে যাবার স্বাদটা একেবারেই ফুরিয়ে গেলো।

মোজাফ্ফর রাজা (১৮৫৩-১৮৯৯)

কবি সহিফা বানুর সহোদর ছোট ভাই মুজাফ্ফর রাজা সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। যেহেতু তাঁর জীবনের বেশীর ভাগ সময় কেটেছে সিলেট শহরে এবং তাঁর সম্বন্ধে অন্য কোন লেখকের কর্তৃক লিখিত তথ্যাদি খুবই কমই দৃষ্টিগোচর হয়, সেহেতু উনার সম্পর্কে দীর্ঘ কিছু লেখার সুযোগ নেই। তদুপরি হাসন রাজা পরিবারের ভিতর যে সমস্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছে তার উপরই নির্ভর করতে হয়েছে। এছাড়া মোজাফ্ফর রাজার একমাত্র বেঁচে থাকা কন্যা আলী রওশন বানুর মেয়ের ঘরের নাতি নুর রওশন চৌধুরীর লেখা ‘ছহিফা বানু, জীবন ও কাব্য’ গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু ধারনা নিতে গিয়ে তাঁর জীবনের কিছু কথা জানা সহজ হয়েছে। অনেক সৌম্য কান্তির আকর্ষনীয় চেহারার এই মানুষটি যখন অন্যদের সাথে অত্যন্ত বিনয়-সহকারে কথা বলতেন, তখন তাঁর নম্রস্বভাব ও চরিত্রের পরিচয় প্রকাশ পেতো। দেওয়ান আলী রাজার অঢেল জায়গাস¤পত্তি সিলেট শহরের মাঝে এবং সংলগ্ন এলাকায় বিস্তৃত ছিল। যেমন রায়নগর, আম্বরখানা, সওদাগড় টুলা, পাটানটুলা, টুকের বাজার সংলগ্ন এলাকা নিয়ে সুরমা নদী বরাবর একটি বিরাট অঞ্চল তাঁর আওতাধীন ছিল। সিলেট শহরের বুকের উপর তাঁর অসংখ্য ঘরবাড়ীর মালিকানা ছিল, যা কিনা তাঁর বন্ধুবান্ধব ও চেনা-পরিচিতজনের বসবাসের ক্ষেত্রে এবং নানান লোকের ব্যবসা বানিজ্যে ব্যবহৃত হতো। আলী রাজা নুর বিবিকে বিয়ে করার পর থেকেই কুয়ারপাড়ের একটি বাড়ীতে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকন্যাকে নিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ঐ সময় রামপাশা, সুনামগঞ্জ ছাড়াও তাঁর বছরের বেশ কটা দিন এই সিলেটেই সময় কাটাতে হতো। তাঁর ইচ্ছামতে সহিফা বিবিসহ মোজাফ্ফর রাজার লেখাপড়ার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সিলেটে করা হয়। মুজাফ্ফর রাজা শিশুকালে অনেকসময় বৈপত্রিক বড়ভাই সুলতান খাঁর ত্বত্তাবধানে ছিলেন, যিনি তাঁর প্রতি অত্যন্ত স্নেহাপরায়ন ছিলেন। আপন মাতৃভাইয়ের সাথে খাঁ যুক্ত ছিল বলে মোজাফফর রাজাকে কোন কোন সময় ‘মোজাফ্ফর খা’ বলেও লোকে সম্বোধন করতো। অন্যদিকে নিজের বোন সহিফা বানু সবসময় তাঁর কাছে কাছেই ছিলেন। কখনও দু’জন একে অপরকে ছেড়ে থাকতেন না। হযরত শাঁহজালাল (রহ:)র পদদলিত পূন্যভূমি সিলেট শহরের সুন্দর ছিমছাম পরিবেশে থাকতে তাঁরা দুজনই পছন্দ করতেন, তাঁদের পছন্দের এই খবরটি কিন্তু বাবা আলী রাজাও জানতেন। অন্যদিকে ওবায়দুর রাজা, হাসন রাজা সচরাচর সিলেটে তাঁদের যাতায়াত রাখার কারণে কখনও সাহিফা বানু ও মোজাফ্ফর রাজা পরিবার বহির্ভূত বোধ করতেন না। আরবী, ফারসি, বাংলা ছাড়াও ইংরেজী ভাষায় মোজাফ্ফর রাজার দখল ছিল। তিনি একজন সাহিত্যানুরাগী হিসেবে ফার্সী কবিদের কবিতার শেরগুলার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। কথিত আছে তিনি তখনকার সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন। ১৮৭৫ হতে ভারতেশ্বরী, রনরঙ্গিনী, মিত্রবিলাপ ও পদ্যপুস্থক গ্রন্থগুলির লেখক শ্রী প্যারীচরন দাস (১৮৫০-১৮৯৮) আসাম প্রদেশের প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র “শ্রীহট্ট প্রকাশ”র স¤পাদক ছিলেন। তার সাথে মোজাফ্ফর রাজার বিশেষ ঘনিষ্টতা ছিল। শুনা যায় তাঁর প্রকাশনীতে ‘মোজাফ্ফর খাঁর’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তিগণ যেমন, ড:সুন্দরী মোহন দাস, বিপীন চন্দ্র পাল, তারাকিশোর চৌধুরী ব্যক্তিগনের সাথে মোজাফ্ফর খানের ঘনিষ্ট স¤পর্ক ছিল। এরাই সিলেটে প্রথম ব্রম্ম ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন। ওদিকে বিপীন পাল ছিলেন ‘পরিদর্শক’ পত্রিকার স¤পাদক। তাঁর পরে এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রাধানাথ চৌধুরী যাঁর সম্পর্কে হাসন রাজা কয়েকবার তাঁর ‘সৌখিন বাহার’ কাব্যগ্রন্থে প্রশংসাবাক্য উচ্চারন করেছেন। এই পত্রিকায়ও মুজাফ্ফর খাঁকে এক প্রাজ্ঞ লোক বলে অভিহিত করা হয়েছিল। মুজাফ্ফর রাজার এরকম সংািশ্লষ্টতার কারণেই হয়তো তাঁর জীবনে পৈত্রিকস্থান রামপাশায় যাওয়া কম ঘটেছে। দেওয়ান গনিউর রাজার বিবরণীতে জানা যায় যে, একবার তিনি সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সৎমা হুরমতজাহান বিবিকে সালাম করে আসেন। মুজাফ্ফর রাজার বৈপত্রিক ভ্রাতু®পুত্র এবং তাঁর জামাতা আব্দুল আজিজ খান ওরফে সুবা মিয়া বহুবার সুনামগঞ্জ ও রামপাশায় আনাগুনা করেন। গনিউর রাজার তথ্যানুশারে জানা যায় একবার মুজাফ্ফর রাজা সুবা মিয়াকে দিয়ে একটি দামী দোয়েল পাখি হাসন রাজার জন্যে উপহার পাঠান। উল্লেখ্য এখানে একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সিলেটের রায়নগরের রাজা গিরিশ চন্দ্র রায়ের (১৮৪৫-১৯০৮) সাথে পাখি সৌখিনতা নিয়ে তাঁর এক বিশেষ স¤পর্ক ছিল। মুজাফ্ফর রাজার সিলেট শহরে বসবাস থাকলেও হাসন রাজার ভাই বলেই হয়তো তাঁরমধ্যে যথেষ্ট সৌখিনতার লক্ষন ছিল। আর এরজন্যেই হয়তো হাসন রাজার সৌখিনতা শুধুমাত্র রামপাশা সুনামগঞ্জেই সিমাবদ্ধ ছিল না। সিলেটের বহু পথে প্রান্তরে তাঁকে দেখা যেত কখনও কোড়া কিংবা দোয়েল শিকারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর পাশে আছেন মুজাফফ্র রাজা। দেওয়ান গনিউর রাজা তাঁর তথ্যকথা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: হাসন রাজা ও মুজাফ্ফর রাজা দুজনই যেন বন্ধুর মত, কখনও কাজল হাওর অর্থাৎ সেখঘাট হাসপাতালের উত্তরে কিংবা আখালিয়া বাজারের পূর্বউত্তরে বুয়ালিয়া বিলে, কিংবা বন্দরের পূর্বে কাষ্ঠঘরের দক্ষিণে, কিংবা দুবড়ি হাওরে, কিংবা ছড়ারপারের পূর্বে আমন ধানে, বামনউড়া বিলে, কুই নদীর উত্তরে, শাহপরান দরগার পূর্বে ও উত্তর পশ্চিম চিকনাগুলে এবং শাহ পরান(রহ:) দরগার দক্ষিণে দেবপুর গ্রামের পূর্বে এবং হউলা বিলে তাঁরা একসাথে কুড়া ও দোয়েল শিকারে ঘুরে বেড়াতেন। মোজাফ্ফর রাজার একটি বিশেষ সখ ছিলে দুধাল গাভী লালন পালন করা। ভারতের বিভিন্ন দুরবর্তী স্থান হতে আনীত এই সমস্ত দুধাল গাভী মুজাফ্ফর রাজার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল এবং অতি আগ্রহের সাথে তিনি সেগুলার যতœ নিতেন। তাঁর গাভীগুলোকে কাঠের তৈরী মেঝেতে মশারী টাঙিয়ে রাতের বেলা রাখার ব্যবস্থা করা হতো। কথিত আছে, সিলেটে তিনিই প্রথম উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রত্যন্ত এলাকা হতে দুধাল গাভী আমদানী করে পোষার প্রচলন শুরু করেন।

বিয়ে সমূহ:

মুজাফ্ফর রাজার জীবনে তিনজন স্ত্রীর আগমন ঘটে। তিনি প্রথম বিয়ে করেন পীরপুরের গন্ধকপুর নিবাসী ইলিম চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ছারাবানুকে। তিনি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যান। ইলিম চৌধুরীরও পূর্বে এই বংশের লোকেরা সিলেটের মধু-শহীদ এলাকায় স্থানান্তরিত হয়ে এখনও বসবাস করছেন।

একই গ্রামের একই বংশীয় মোহাম্মদ সবদর চৌধুরীর মেয়েকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বরণ করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নাম রাখা হয় নুরন্নেসা খাতুন। এই কন্যাকে তাঁর বৈপত্রিক ভাই সুলতান খাঁর পুত্র আব্দুল আজিজ খান ওরফে সুবা মিয়ার সাথে বিয়ে দেন। এই দ¤পতি নি:সন্তান, উভয়ই বিয়ের কয়েক বছর পর মারা যান। গনিউর রাজার রোজ নামচায় এই সুবা মিয়ার কথা অনেকবারই উল্লেখ আছে।

১৮৯২ সালে তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন মনিপুরের সিংহাসনচুত্য রাজা টিকেন্দ্র জিৎ রায়ের মেয়ে রাজকুমারী নন্দিতা রায়কে। তিনি বিয়ের আগে ধর্মান্তরিত হয়ে ‘সফুরা জাঁহা’ নাম ধারন করেন। মনিপুর রাজ্যের রাজা বীর টিকেন্দ্র জিৎ ব্রিটিশ শাষন থেকে স্বাধিকার লাভে দেশপ্রেমিক হিসেবে যে জীবনদান করেছেন, সেজন্যে মনিপুরের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আজো তিনি সেখানে সম্মানিত।

ব্রিটিশ দখল থেকে মনিপুর রাজ্যকে মুক্ত রাখতে গিয়ে ধরা পড়েন। ১৮৯১ সালের ১৩ আগষ্টে এই ফাঁসি মঞ্চনার পর মহারাজ টিকেন্দ্রজিৎ রুপান্তরিত হন মনিপুরের সর্বশ্রেষ্ঠ অমর বীর সৈনিকরূপে। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি তাঁর বোনের সাথে নিজের কন্যা রাজকুমারী নন্দিতা রায়কে সিলেটে পাঠিয়ে দেন। এই সময় হাসন রাজার বোন সহিফা বানু তাঁদেরকে অফুরন্ত সাহায্য সহায়তা করেন এবং পরে অসহায় রাজকুমারী নন্দিতা রায়কে নিজের ভাইয়ের বউ হিসেবেই ঘরে তুলেন। এই স্ত্রীর গর্ভে ১৩০২ বাংলা মোতাবেক ১৮৯৬ ইং সনে জন্ম নেন আলী রওশন বানু ওরফে মনিরুন্নেসা খাতুন। মোজাফ্ফর রাজা তাঁর মা-হারা এই শিশুকন্যা আলী রওশন বানুকে চার বছরের বয়সে রেখে ১৩০৬ বাংলা (১৮৯৯ইং) সালে পরলোকগমন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর এই কন্যা রওশন বানুই হলেন হাসন রাজার তৃতীয়পুত্র দেওয়ান একলিমুর রাজার প্রথম স্ত্রী।

নিরুদ্দিষ্ট আউলিয়া আবুল হোসেন আলী রাজা

আবুল হোসেন আলী রাজা ছিলেন হাসন রাজার বড়-ভাই ওবায়দুর রাজার প্রথম পুত্র। ওবায়দুর রাজার দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান আজিজুর রাজার প্রপৌত্র দেওয়ান আলমনুর রাজার মতে আবুল হোসেনের আসল নাম ছিল ‘আবুল হাসান’। কিন্তু দেওয়ান গনিউর রাজার লিখিত পান্ডলিপিগুলোতে অনেকবারই তিনি উনাকে ‘আবুল হোসেন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার বিবরনীতে জানা যায় তাঁর নাম ‘আবুল হাসান’ হলেও সমকালে হাসন রাজার নামের সাথে সমোচ্চারিত হতো বলে তিনি নিজে তাঁকে ‘আবুল হোসেন’ বলে ডাকতেন। তাই আমরা এই গ্রন্থে তাঁকে এই নামেই চিনবো। আর তাঁর নামের সাথে পিতার অভিপ্রায়ে দাদার নামটিও যুক্ত করা হয়েছিল ‘আলী রাজা’। তাঁর পূর্নবয়স্কালে তাঁকে অনেকে আউলিয়া মনে করতেন। তাঁর মাতুলালয় সিলেটের দরগাহ মহল্লায়। তাঁর মাতামহের নাম মুফতি নজ্ব উদ্দীন। আগেই বলা হয়েছে ১৮৬১ সনে দেওয়ান আবুল হোসেন আলী রাজার জন্মের পরপরই আতুর ঘরে মাতৃহারা হলে পর শাহজালাল (রহ:)র দরগাশরীফে মায়ের দাফন কার্য্য সম্পাদন হয়। কয়েক বছর মামার বাড়ীতে লালনের পর আবুল হোসেন ছয় বছর বয়সে রামপাশা প্রত্যাবর্তন করেন তখন ওবায়দুর রাজা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। আর তাঁর ১০ বছর বয়স্কালে তাঁর পিতা ওবায়দুর রাজা ইহলোক ত্যাগ করেন। বাবার- মৃত্যুর পর তাঁকে আবারো নানা বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সিলেট শহরেই লেখাপড়ায় মনোযোগী হন। এই সময় ১৭ বছর বয়সের যুবক চাচা হাসন রাজা নিয়মিত ভাতিজার খোঁজ খবর নিতে থাকেন। এমনকি সময় সময় তিনি ভাতিজাকে দেখার জন্যে সিলেটের দরগা মহল্লায় মুফতি বাড়িতে গিয়েও উপস্থিত হতেন। এরকম ভ্রাতষ্পুত্রের প্রতি দায়িত্ববোধের টানে তিনি তাঁর লেখাপড়ার যাবতীয় খরচাদি বহন করেছিলেন এবং নিশ্চিত করেছিলেন ভাতিজার পড়ালিখায় কোনোরূপ ব্যাঘাত না ঘটে। আবার কোন কোন সময় চাচা তাঁর লক্ষনশ্রীর বাড়ীতেও তাঁকে নিয়ে আসতেন। আবুল হোসেন কিন্তু চাচার খুব ভক্ত ও বাধ্য হয়ে উঠেছিলেন। চাচার নির্দেশমত তিনি উচ্চশিক্ষা লাভে কলকাতা যান। তখন হাসন রাজার প্রথমপুত্র গনিউর রাজার বয়সটি মাত্র চার বছর। তাই অনুমান করা যায় এই বছরটি ১৮৭৮ সাল। সেখানে এফ, এ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন বলে জানা যায়। তখনকার সময়ের এই পরিবারের জন্যে তিনি একজন যথাযথ উচ্চ শিক্ষিত লোক ছিলেন বলে ধরা হয়।

পড়াশুনা শেষ করে যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন, তখন হাসন রাজা বিরাট জমিদারী ও ভূস¤পত্তি পরিচালনায় নায়েব-গুমস্থা ছাড়াও আপনজন সঙ্গে থাকা সমীচিন মনে করে ভাতিজা আবুল হোসেনকে রামপাশার জমিদারী, সায়সম্পত্তি দেখাশুনা ও পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পন করেন।

কথিত আছে হাসন রাজার কোনো একটি পরিকল্পনা ছিল যে, মাতাপিতাহীন ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিজের বড় মেয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেবেন। ইতিমধ্যে রামপাশা এলাকায় কিছু লোকের সৃষ্ট এক দাঙ্গাহাঙ্গামা দমানার্থে জমিদার-বিরোধী মজুদদার ব্যবসায়ী মুকুলরাম সাহজিকে সায়েস্থা করতে যেয়ে আবুল হোসেন আলী রাজা এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। গনিউর রাজার তথ্যবিবরনী অনুযায়ী জানা যায় যে, প্রজা উস্কানি দেয়াতে জমিদারের লোকেরা মুকুলরাম সাহজির ঘর পর্যন্ত মাড়ায়। প্রাচীন এক অনুগত ভৃত্য ঝাড়– খাঁর বর্ননায় সুপ্রিয় পাঠকেরা পরিস্থিতির খবরটি নিতে পারেন : “বড় দেওয়ান(হাসন রাজা) আবুল হোসেন সাহেবকে যে বছর ম্যানেজাররূপে রাখিয়াছিলেন, ঐ বছর বড় এক হাঙ্গামা হয় মুলুকরাম সাহজির সঙ্গে।” এই হাঙ্গামা সংক্রান্ত মামলায় সক্রিয়ভাবে হাসন রাজা সয়ং উপস্থিত থাকেননি “বিধায় এইতো দেওয়ান অসন্তুষ্ট হইয়া ফকিরের সঙ্গ লইলেন। অবশেষে ফকিরি গ্রহন করিলেন।” (গনিউর রাজা, তথ্যকথা বইনং ২ পৃ: ৯)

আবুল হোসেন আলী রাজার চারিত্রিক স্বভাব ছিল অতি সৎ কিন্তু মেজাজ খুবই গরম। তিনি সৌখিন ছিলেন হাতী, ঘোড়া, হরিণ ও পশুপালনে। বংশগত স্বভাব-প্রকৃতিতে তিনি শিকারে ছিলেন আসক্ত। তিনি তাঁর পিতার ন্যায় বাজপাখী দিয়ে শিকারে অতি উৎসাহী ছিলেন। রামপাশায় তখন তাঁর কয়েকটি পালিত হরিণ ছিল। এরা সহজেই স্বাধীনভাবে ঘুরাফিরা করতো। এদের মধ্যে শিংওয়ালা একটি বড় হরিণ ছিলো যেটি আবুল হোসেনের অতি প্রিয়-হরিণ। এই হরিণটি সব সময় খুটির সাথে বাধা থাকতো, কেননা এটি ছাড়া পেলেই লোকের মাঠের ফসল নষ্ট করে দিতো। এরকম অবস্থা করলে তিনি এই হরিণটিকে দেখাশুনার জন্যে একজন লোক নিযুক্ত করেন এবং তাকে শাষিয়ে দিতেন কোনভাবেই যেন হরিনটি ফসল নষ্ট না করে। যদি একান্তে জন্তুটি ফসল নষ্ট করলে পরে তিনি তার ক্ষতিপূরণও বহন করতেন। এইভাবে মাঝে মাঝে হরিণটি ছাড়া পড়লেই দেখা যেতো ক্ষেতে নেমে পড়েছে। একদিন রাতে হরিণটি ছুটে গিয়ে শ্রীপুরের জমিতে নেমে পড়লো এবং সারারাত ভর ধানের চারা খেয়ে সেই জায়গাটি উজার করে দেয়। এদিকে রাজাবাড়িতে হরিণটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না দেখে অনেক অনুসন্ধানের পর জানা গেল যে, শ্রীপুরের গ্রামবাসীর ক’জন মিলে এই হরিণটিকে গোপনে জবাই করে নিয়েছে। আবুল হোসেন আলী রাজা এতে মনে মনে খুবই ক্ষুদ্ধ হন এবং ঐ গ্রামের লোকজনকে নায়েব দিয়ে তলব করান। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে যে হরিণটিকে জংলী মনে করে বধ করে এবং পরে বুঝতে পারে যে এটি সাহেব বাড়ির হরিণ। তাই তারা ঘটনাটি গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল। আবুল হোসেন তাদের উত্তরে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। পরিবর্তে নায়েবদের বলে দেন, শ্রীপুরের সকল গরুবাছুরকে রাপপাশায় তৎক্ষনাৎ হাজির করানোর জন্যে। অত:পর গরুগুলার মালিকানা বাজেয়াপ্ত করেন। এই শাস্তির পর দু-চারদিনের ভিতরেই শ্রীপুরবাসীর কয়েকজন লক্ষনশ্রীতে প্রজাবৎসল হাসনরাজা সাহেবের কাছে গিয়ে হাজির হয় এবং আবুল হোসেন আলী রাজার কাজের ওপর নালিশপ্রার্থী হয়। তারা জানায় যে, আবুল হোসেন সাহেব তাঁদের গ্রামের গরু বাছুর আটকে দেয়ায় তাঁদের হাল-চাষ একরকম বন্ধ। (গনিউর রাজা)

হাসন রাজা কিন্তু এরপর কালক্ষেপন না করে কিছুদিনের মধ্যে রামপাশা এসে উপস্থিত হন এবং আবুল হোসেনকে ডেকে পাঠান। নালিশের সত্যতা যাচাই করতে যেয়ে ভাতিজাকে শুধুমাত্র ভৎসর্নাই করেননি, হরিণ হত্যার কারণেই উনার এই তীব্র আচরণে হাসন রাজা অসন্তুষ্টি দেখান এবং সতর্ক করে দেন “আমার জমিদারিতে প্রজাদের প্রতি এরকম আচরণ আমি সহ্য করবো না।” চাচার ভৎসর্নায় অসন্তুষ্ট হয়ে আবুল হোসেন দু:খ-ভারাক্রান্ত মন নিয়েই ঐ রাতেই শরাফত উল্লাহ শাহ নামীয় এক মউজুফ দরবেশের সাথে বাড়ীর বাহির হয়ে পড়েন এবং যাবার কালে কিছু লোককে বলে গেলেন চাচাকে জ্ঞাত করার জন্যে। তাঁর এই বাড়ীত্যাগের পর তাকে অনেক খোঁজাখুজি করার পরও পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার পর কয়েকবছর গত হয়ে গেলো কিন্তু আবুল হোসেন রাজার কোনো খবর আর মিলল না।

এখানে উল্লেখ্য যে বছরে হাসন রাজার জন্ম অর্থাৎ ১৮৫৪ সাল। ঠিক এই বছরই সিলেটে সর্বপ্রথম চা-বাগান ‘মালনিছড়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সিলেটে চা-পাতা চাষের ইতিহাসটি শুরু হয় হাসন রাজার জন্মের সাথে সাথেই। এর পচিশ/চাব্বিশ বছর পর লাক্কারতুরা টি-গার্ডেনের গুঢ়াপত্তন ঘটে। ধুমধামে ইংলিশ কম্পানী তখন এই চা-বাগানের কাজ চালাচ্চিলো।

ওদিকে আবুল হোসেন আলী রাজা নিখোঁজ হওয়ার নয়টি বছর পার হয়ে গিয়ে ১৮৮০/৮১ সালের দিকে যখন সিলেটের এই লাক্করতুরা চা বাগানের মাটি কাটা চলছিল। ১৫ থেকে ২০ জন মাটিকাটা-শ্রমিকের তাবু খাটানো একটি জায়গায় রান্না করা বেশকিছু খাবারের ব্যবস্থা ছিল, হঠাৎ সেখানে দেখা গেল মাথাভরা ঝাকরা চুল, লম্বা হাতের নখ, দীর্ঘ দাড়িওয়ালা সব মিলেয়ে ভীষণকার এক পাগলমত লোক এসে হাজির হয়েছেন।

এই অবস্থায় সব শ্রমিকেরা দৌড়ে পালিয়ে যেতে লাগলো। তৎক্ষনাৎ ১০/১২ জনের খাবার এই পাগলপ্রায় ফকির একাকী খেয়ে নিলেন। লোকেরা গিয়ে যখন লাক্কাতুরা বাগানের ইংলিশ ম্যানেজারকে জানালো। ম্যানেজার সাহেব তরিৎ বেগে একটি বন্ধুক হাতে নিয়ে পাগলের মুখোমুখি হলো। ম্যানেজার সাহেব দেখলো এই লোক অনর্গল উর্দু ও ইংলিশ ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। এই পাগল যে একজন সু-শিক্ষিত মানুষ তা সহজেই তার কাছে বোধগম্য হলো।

তাঁর কথার সার বুঝে নিয়ে সাহেব সিলেটের দরগাহ মহল্লায় পাঠিয়ে দিবার ব্যবস্থা করলো। দরগাহ মহল্লায় তাঁর মামার বাড়ী। সেখানে পৌছে মাথার চুল ছেটে নেয়া হল। গোসল সেরে নিয়ে তিনি বর্তমান আলিয়া মাদ্রাসায় কাছে সারা দুপুর বিকেল ঘুরাফিরা করতে থাকেন। রাতের বেলা তাঁর পাশের টিলার উপর যেখানে ডিস্ট্রিক্ট সিভিল-সার্জেনের আবাসস্থল, সেখানে গিয়ে ঢুকে পড়েন। ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে সিভিল সার্জেন পুলিশের হাওলা করে দিলে তাঁকে হাজত-বন্দী করা হয়। পরের দিন কোর্টে হাজির করার সময় রামপাশার কয়েকজন লোক তাঁকে চিনে ফেলে। তখনি হাসন রাজা সাহেবের কাছে তরীৎ বেগে রামপাশায় খবরটি নিয়ে যাওয়া হয়। হাসন রাজা দেরী না করে সিলেটে এসে আবুল হোসেনকে উদ্ধার করেন। এরপর আরো ১৪ বছর রামপাশা ও লক্ষনশ্রীতে কাল কাটানোর পরও দেখা যায় কোনদিন আর তাঁর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। এই দীর্ঘ সময় দেখা যায় যে তিনি পুকুর আর নদীর পানির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন কাটাতে থাকেন। এই অবস্থায় জোঁকে, মশায় আক্রান্ত হলেও সেদিকে যেনো তাঁর কোন ভ্রক্ষেপ ছিল না। একদিন হাসন রাজার জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত রামপাশা থেকে আড়াই মাইল দুরত্বে কান্দিগায়ের এক বাড়ীর পিছন দিয়ে আবুল হোসেন সেই গ্রামে ঢুকে পড়েন। পুকুরে ব্যস্ত মহিলারা আকষ্মিকভাবে এমনি অবস্থায় এই পাগলপ্রায় লোকটিকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করতে থাকে এবং চিৎকার শুনে একজন পুরুষ লোক বেড়িয়ে এসে গাছের ডাল দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। আবুল হোসেন আলী রাজা অপরদিকে “আগুন আগুন” বলে সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হন। হাসন রাজা তাঁর এই অবস্থাটি জানতে পেরে মনোকষ্ট পেলেন। ওদিকে গ্রামের লোকেরাও জানতে পারলো তিনি হাসন রাজা সাহেবের ভাতিজা। গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নিল, তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস - কোন এক অজানা কারণে ঐ সন্ধ্যায়ই এই গ্রামের একটি ঘরে আগুন লাগে এবং সমস্ত গ্রামটি পুড়ে যায়। তাঁর জীবনে এই ধরনের অসংখ্য কেরামতি ঘটনা রামপাশা ও সুনামগঞ্জ এলাকায় কিংবদন্তি হয়ে আছে। ফলে এই এলাকার লোকেরা মনে করেন যে, নিরুদ্দেশ হওয়া এই আবুল হোসেন আলী রাজা একজন উচ্চস্থরের দরবেশ ছিলেন।

লক্ষণশ্রী ও রামপাশার বাড়ীতে সবসময়ই তাঁর শেষ প্রস্থানের কাহিনীটি এরকম কথিত আছে। আজো অবধি মুখেমুখে শুনা যায়, যেদিন আবুল হোসেন আলী রাজা নিরুদ্দেশ হন, মোহন পুরের চৌধুরী বাড়ীর কয়েকজন, বিশেষত: আজাদ বক্ত চৌধুরী এবং উনার পরিবার আতœীয় স্বজন মুর্শিদ আবুল হোসেন আলী রাজার সাক্ষাৎ পেতে লক্ষণশ্রীতে হাসন রাজার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। এসময় আবূল হোসেন আলী রাজাকে নিয়ে হাসন রাজার একটিমাত্র দু:শ্চিন্তাই ছিল যে, কখন আবার উনি গায়েব হয়ে পড়েন। এলাকায় যত্রতত্র বাঘ ভাল্লুকের ভয় ছিল বলে তাঁকে হাসন রাজা লক্ষনশ্রীর বাড়িতে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করতেন।

সেদিন কেউ-ই ধারনা করতে পারেনি এমন-ই একটি ঘটনাটি ঘটে যাবে। হাসন রাজার বাড়িতে রান্নাঘরের চুলোয় বসানো হয়েছে সন্দেস। একটার পর একটা সন্দেস তেলে ভাজা হচ্ছে আর আবুল হোসেন মুখে পুরছেন। হঠাৎ করে কেউ একজন তাকে এমন খাওয়া থেকে থামিয়ে দিলেন। আর একমুহুর্ত আবুল হোসেন সেখানে দাড়িয়ে নেই। মুর্শিদের সাক্ষাৎ পাওয়ার আকাঙ্কায় আসা মোহনপুরের আজাদ বক্ত যখন হাসন রাজা সাহেবের দর্শন নিতে এগিয়ে যান, এই সময় তাঁর সোওয়ারি ঘোড়াটির পিটের উপর চড়ে বসে আবুল হোসেন অচিনপুরের খেয়ার ঘাটের দিকে ধাবমান হন। খেওয়ানী বিহারী লালের নৌকায় উঠার উদ্যোগ নিলে ঘোড়াকে নৌকায় তুলতে খেওয়ানি অনিহা প্রকাশ করে। এতে তিনি রাগ করে ঘোড়ার পিটে চড়ে বসেন। ঘোড়াকে যখন হাক দিয়ে পা নাড়া দেন তখনই ঘোড়াটি নদীতে ঝাপ দিয়ে পড়ে এবং নদী পাড় হয়ে যায়। খেয়ানির মারফতে হাসন রাজার কাছে খবরটি গেলে তিনি এরপর ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন অনুসরন করে উত্তরমুখী খাসিয়া পাহাড় সংলগ্ন লাউরের গড়ের দিকে লোকজনকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এলাকার পর এলাকা, বনাঞ্চলের পর বনাঞ্চল এমন কি শাহ আরফিন (র:)এর দরগা পর্যন্ত অনেক খোঁজাখুজির পরও ঘোড়া কিংবা ঘোড়-সওয়ারকে আর পাওয়া গেল না। নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া জিন-লাগাম পরিহিত ঘোড়াটি কিন্তু ঠিক তিনদিন পর লক্ষণশ্রীর হাসন রাজার বাড়িতে ফিরে আসে কিন্তু আবুল হোসেন আর ফিরে এলেন না।

আবুল হোসেন আউলিয়ার কেরামতি তখনি লোকমূখে ফিরছিলো যখন, ঐ সময় সম্পর্কে গনিউর রাজা লিখেছেন ‘১৩০৫ বাংলা মোতাবেক ১৮৯৮ সালে জেঠাত্ব ভাই আবুল হোসেইন তখনই নিরুদ্দেশ ছিলেন’। গনিউর রাজার প্রথম বিয়ের বছর খানেকের ভিতরেই তাঁর স্ত্রী মারা যান। স্ত্রীর বিয়োগান্তে শোকাভিভূত হয়ে তিনি উদ্দেশ্যবিহীনভাবে যখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তখন তিনি এক রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেন আউলিয়া আবুল হোসেইন বলছেনÑ‘বদমাস্, আমি তোর জুতা (অর্থাৎ স্ত্রী) নিয়া গিয়াছি ও তুই বদমাসি করার জন্য এতদুর আসিয়াছিস?’ বলিয়াই মোটা এক ঠেঙ্গা হাতে লইলেন। আমি দৌড়াইতে লাগিলাম। তিনি ঠেঙ্গা হাতে আমাকে মারিবার জন্য দৌড়াইতে লাগিলেন। আমি ঘর্মাক্ত কলেবরে জাগিয়া উঠিয়া বসিলাম ও স্বপ্ন বৃত্তান্ত চিন্তা করিতে লাগিলাম।’

লক্ষণশ্রী ও রামপাশায় আবুল হোসেনের নামে কোন দলিলপত্র খুব কমই দেখা যায়, লক্ষণশ্রী রামপাশার বাড়ীতে আবুল হোসেন আলী রাজার স্বহস্থে দস্তগতকৃত শুধুমাত্র হাতেগুণা ক’খানি দলিল পাওয়া গিয়েছে। এর একটি এখন হাসন রাজা ট্রাষ্ট লন্ডন চেয়ারম্যান দেওয়ান আলমনূর রাজার কাছে গচ্ছিত আছে আর আরেখখানা সুনামগঞ্জে হাসন রাজা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এখনো বয়োবৃদ্ধ লোকমুখে শুনা যায় যে, হাসন রাজার জানাজাতে আবুল হোসেন আলী রাজাকে অনেকেই উপস্থিত থাকতে দেখেছিলেন। জানাজার শেষে আবার লোকভীরে অদৃশ্য হয়ে যান।

হাসন রাজার বিয়ে পর্ব

কলকাতার লেখক ও গবেষক অমিয়শঙ্কর চৌধুরী এই তথ্যটি প্রকাশ করেছেনÑ ‘হাসন রাজা বিবাহের ব্যাপারে শরিয়তের আদর্শ মানেননি। শরিয়ত অনুসারে মুসলিমদের চার স্ত্রী গ্রহণ চলতে পারে। কিন্তু হাসন রাজা চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি কোনোদিন কোনো মেয়েকে জোর করে তার অন্দর মহলে নিয়ে আসেননি।’ একাধিক বিয়ে থাকা সত্তে¡ও তার জীবনে কোনো সময়ই তিনি বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেননি। তাছাড়া লক্ষণীয় বিষয় যে তার প্রথম বিয়ে পার্শবর্তী গ্রাম আরপিন নগর নিবাসী ভুরজানবানু হাসন রাজার স্ত্রী হলেও মূলত আরপিননগরে তাদের পিতৃনিবাস ছিল না। মূলত হাসন রাজার সবক’টি বিয়েই দুরদুরান্ত থেকে নিয়ে আসা। হাসন রাজা বিয়ে সম্পাদনে কোনসময়ই উৎচ্ছৃঙ্খল যথেচ্ছাচারী ছিলেন না। তার বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে অনেকেই মনগড়া কথা বলেছেন।

প্রথম বিবাহ : হাসন রাজার মাতা হুরমতজাহান তার একমাত্র সন্তানকে বুকে আকড়ে ধরে তিলতিল করে বড় করে তুললেন। হাসন রাজা যখন পনের কি ষোল বয়সে পা দিলেন, ঠিক তখন থেকেই মা হুরমতজান বিবি ছেলেকে বিবাহ করানোর জন্যে মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করেন এবং প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। বিবির চাচাত ভাইয়ের এক ফুটফুটে কন্যা। হুরমতজাহান বিবির মনের কথাটি ছিল ঐ ভাইঝিকে নিজের পুত্রবধু করে ঘরে তুলবেন। কিন্তু এরই মধ্যে স্বামী দেওয়ান আলী রাজার মৃত্যুবরণ হলে হুরমতজানের মনের তাগিদে কিছুটা ভাটা পড়ে।

হাসন রাজার বয়ষ ১৯ পেরুতেই হুরমতজাহান বিবির মনের খায়সটিতে লাগল চোরাবালী। পার্শবর্তী আরপিন নগর-নিবাসী মোহাম্মদজান ধীর সুদুর পাঞ্জাবের শিয়ালকোট নগরী থেকে এসে এই এলাকায় বসত গড়েন। কথিত আছে যে, এই মোহাম্মদজান পরিবার মূলত পাঞ্জাব সংলগ্ন ধীর রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। পরে তারা পাঞ্জাবের শিয়ালকোট নগরীতে স্থানান্তরিত হয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। পিতা পীর গোল মোহাম্মদ ধীরের নির্দেশে আহমদজান ধীর এবং মোহাম্মদজান ধীর হজ্জব্রতী মুসলমান যাত্রীদের সাহায্যার্থে বাংলা-আসামে পাড়ি জমান। এলাকার মুসলমানদের হজ্জ-যাত্রা আয়োজন এবং সরঞ্জাম-ব্যবস্থাদির সাথে তাঁদের একটি ব্যবসায়িক সম্পর্কও জড়িত ছিল। আহম্মদজান সিলেট সদর থানার জলালপুরে আনসারী পরিবারে বিবাহ করেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করেন। আর মোহাম্মদজান ধীর সুনামগঞ্জের আরপিন নগরের আব্দুস সামাদ তালুকদারের বোনকে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই আব্দুস সামাদের বংশধররা এখনও সুনামগঞ্জের আরপিন নগরস্থ তালুকদার বাড়িতে বাস করছেন। মোহাম্মদজান ধীরের এক কন্যাসন্তান ছিলেন। নামটি ছিল তাঁর ভুরজান বানু। হাসন রাজার বয়সটি ছিল তখন মাত্র ১৯ বছর। মোহাম্মদজানের কন্যা পরমাসুন্দরী ভুরজান বানুকে দেখে তরুন হাসনের মনে এক প্রেমের জোয়ার বইয়ে যায়। এই যেনো তাঁর দ্বিতীয়বারের মত প্রেমে পড়া। ভুরজান বানুর দেখা হাসন রাজা কিভাবে পেয়েছিলেন তা সঠিক করে বলা কঠিন। তবে জাবিদউল্লাহ মোড়লের কনিষ্টপুত্র এনাম উল্লাহর দেয়া তথ্য থেকে একটি অনুমিত ধারনা পাওয়া যায়। লক্ষণশ্রীর বড়পাড়া, তেঘরিয়া ও আরপিন নগর মিলে এই এলাকায় সবে একটিমাত্র মসজিদের অস্থিত্ব ছিল। সেই মসজিদের অবস্থান ছিল আরপিননগর তালুকদার বাড়ি সংলগ্ন। এই সময় হাসন রাজার ঈদের জামাতে যোগ দেয়ার জন্যে ঐ মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ ময়দানে যাতায়াত ছিল প্রায় প্রতিবছরই। আর অন্যদিকে ১৮৭১ সালে একই সাথে বাবা-ভাইয়ের মৃত্যুকালে মর্মাহত দীলে মরন-চিন্তা তাঁকে চার পাশ থেকে ঘিরে ফেলে। তখন কোমল মনটিতে প্রভুভীরু হাসন আল্লাহকে ডাকার জন্যে নামাজ পড়ার ঝোক তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। আরপিন নগরের উক্ত মসজিদে তখন ঘনঘন যাতায়াত ছিল, তাঁর পিছনে অবশ্যি ধর্মপ্রানা মা হুরমতজান বিবিরও তাগদা ছিল অনেক। অনুমান করা হয় ১৮৭২/৭৩ সালের দিকে অপূর্ব ষোড়ষী ভুরজান বানুকে দেখার তাঁর সুযোগটি ঠিক তখনি হয়ে উঠে । মোহাম্মদজান ধীরের বাড়ির অবস্থানটিও ছিল ঐ মসজিদ সংলগ্ন।

হাসন রাজার মায়ের বংশসম্ভূত উপন্যাসিক নুরুজ্জামান চৌধুরীর লেখা ‘মা-মামা-হাসন রাজা’ গ্রন্থে ভুরজান বানুর সাথে হাসন রাজার দেখাটি এভাবে সাজিয়েছেনÑ ‘একদিন বিকেল চারটার পর উদাই মোড়ল ও মন্তাজ নামে একটি লোককে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরপিন-নগরের পথ দিয়ে এগুচ্ছিলেন। হঠাৎ করে দেখলেন এক বাড়ির পেছন দিকে আ¤্রবৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে একজন মধ্যবয়সী মহিলা ও একজন ষোড়ষী কথা বলছেন। প্রথম দর্শনেই হাসন রাজা ষোড়ষী সুন্দরীর মায়াজালে আকৃষ্ট হয়ে নিবিড়চিত্তে তাকে দেখলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে মুহাম্মদজান প্রথমত রাজি হননি, কিন্তু পরে যখন শুনলেন হাসন রাজার সুখ্যাতি, তখন তার সম্মতি দিতে দেরি আর হলো না। মা হুরমতজাহান বিবির অনুমতিতে ১২৭৯ বাংলার মোতাবেক ১৮৭৩ সালে হাসন রাজা ও ভুরজান বানুর মাঝে বিয়ে স¤পন্ন হয়।

পরের বছর ১৮৭৪ সালে প্রথম পুত্র গনিউর রাজা র জন্ম। পরে তিনি খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজাতে ভূষিত হয়েছিলেন। এই স্ত্রীর গর্ভে দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান হাসিনুর রাজা ১৮৭৬ সালে এবং এক কন্যা রওশন আক্তার বানু জন্ম হয় ১৮৭৯ সালে। হাসন রাজার জীবদ্দশায় ১৯০৫ সালে রওশন আক্তার বানু মাত্র ২৬ বছর বয়সে তার তিন কন্যা ও একপুত্র রেখে মারা যান। এই কন্যা বিয়োগে বহুদিন হাসন রাজা একরকম উন্মাদের মত ছিলেন। ওদিকে একমাত্র মেয়ের অপ্রাপ্ত বয়সে চির-বিদায় ভুরজান বানুর জীবনধারাতে নিয়ে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। নিজেকে ইসলামিক অনুশাসনে নামাজ রোজাতে একেবারে বেধে নিলেন। মরমি ভাবধারায় পুষ্ট হয়েই তিনি হাসন রাজাকে ‘মাটির রাজা’ বলে ডাকতেন আর নিজে চিরদিনের অভ্যাসমত মাটির মধ্যে ঘুমোতে যেতেন। পরে হাসন রাজা তার জন্যে তার ঘরের ভিতরে মাটি দিয়ে উঁচু করে একটি ‘মাটির চৌকি’ তৈরি করে নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাকি জীবনের প্রায় ৩০ বছরের মত সময় তিনি এই মাটির চৌকিতে রাতের বেলায় গুমাতেন। আর এ কারনেই ঘরের লোকেরা ও পাড়া-প্রতিবেশীরা তাঁকে ‘মাটির চৌকির বিবি’ বলে সম্বোধন করতো। হাসন রাজার মহাপ্রস্থানের পর তিনি আর বেশীদিন বেঁচে থাকেননি। তাঁর কবর স্থানটি হাসন রাজার কবরের পাশেই।



দ্বিতীয় বিবাহ : ১২৮৪ বাংলা ২৯ শে বৈশাখ হাসন রাজা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। স্ত্রী হবিগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত নবীগঞ্জের র্কুশা খাগাউরার প্রসিদ্ধ দেওয়ান পরিবারের দেওয়ান মোহাম্মদ আছির সাহেবের কন্যা আজিজা বানু। এই স্ত্রীর গর্ভে হাসন রাজা সাহেবের দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। তারা যথাক্রমে রওশন হুসন বানু (১৮৭৮-১৯৫৪) ও রওশন হাসন বানু (১৮৮১-১৯৫০)। রওশন হুসন বানুই প্রখ্যাত দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ সাহেবের মা। হাসন রাজার মৃত্যুর প্রায় বছর ছয়েক পর আজিজা বানু মারা যান। তার মরদেহ সুনামগঞ্জে তার স্বামীর কবরস্থানের পাশেই শায়িত করা হয়।

তৃতীয় বিবাহ : সুনামগঞ্জের ছাতক থানার অন্তর্গত পীরপুরের অতি পুরাতন চৌধুরী পরিবারের মোহাম্মদ-হোসেন চৌধুরীর কন্যা সাজিবুন নেসা চৌধুরীর সাথে ১২৮৮ বাংলা মোতাবেক হাসন রাজার তৃতীয় বিবাহ স¤পন্ন হয়। এই পক্ষে কোনো সন্তানাদি ছিল না। হাসন রাজার জীবদ্দশায় এই স্ত্রী ইহলোক ত্যাগ করেন।

চতুর্থ বিবাহ : মাত্র বছর চারেক পাঁচেক উবায়দুর রাজার ঘর সংসার করার পর যখন সজিদা বানু বিধবা হয়ে পিত্রালয়ে পাড়ি জমালেন, এরপর কয়েকবছর গত হয়। ইতিমধ্যে অল্প বয়স হেতু সিলেটের নানান সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার হতে তার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। বড় ভাই জুয়াদ আলী চৌধুরী বয়স বিবেচনায় বোনের বিবাহ দেওয়ার জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেন কিন্তু সজিদা বানুর অরাজী থাকার একমাত্র অজুহাত তার শিশু পুত্রধন আজিজুর রাজাকে নিজের কাছে থেকে সরিয়ে কোথাও দূরে বিবাহে অনিচ্ছুক। এমনি পরিস্থিতিতে ভাই জুয়াদ আলী চৌধুরী বোনকে বিবাহ দিতে অপারগ থাকায় তার মনে শান্তি পাচ্ছিলেন না। এদিকে রামপশাতে হাসন রাজার অনুপস্থিতিতে প্রজাবিদ্রোহের ধুম্রজাল বইতে শুরু করে। খাজনা অনাদায়ে জমিদারীর বিরাট অংশ ঋণগ্রস্থ ও নিলামে বিক্রি হওয়ার উপক্রম হয়। এই ঋনের বোঝা কাঁধে নিয়ে হাসন রাজার জমিদারী যাত্রা শুরু হয়। ১৮৭৭ সাল থেকে আরম্ভ হয় সুনামগঞ্জে প্রশাসনিক পরিবর্তনের পালা। ১৮৮৩ সনের দিকে রামপাশার সমস্ত স¤পত্তি নিলামে উঠার উপক্রম হয়। এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে হাসন রাজার ডাক পড়ল বোন সহিফা বানুর কাছে। ইতিমধ্যে বোনের জানতে বাকি রইল না যে হাসন রাজা ভীষণ বিপদের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। বোন এগিয়ে এসে পরামর্শ দিলেন- ‘যদি আপত্তি না থাকে তাহলে বড়ভাইয়ের স্ত্রী সজিদা বানুকে বিবাহ করা অত্যন্ত সমিচীন হবে। কারণ তাকে বিবাহ করলে জফরগড়ের জমিদারী স¤পত্তি বিক্রি করে বাবার স¤পত্তি রক্ষা করা সম্ভব।’ প্রথমে হাসন রাজা এবং সজিদা বানু উভয়ই এরকম একটি স¤পর্ক স্থাপনে কেমন যেন বাধ-বাধ সাধছিলেন, কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং সহিফা বানুর যুক্তিপরামর্শে তারা উভয়ই রাজী হলেন। উবায়দুর রাজার পুত্র আবুল হোসেন আলী রাজাকে কর্নমধুতে পাঠিয়ে সজিদা বানুকে নিয়ে এসে ১২৯০ বাংলা সনের ২১ শ্রাবণ সিলেটে কুয়ারপার সহিফা বানুর বাড়িতে এই বিবাহ স¤পন্ন হয়। কিছুদিন পরই ১২৯৮ বাংলার পৌষ মাস নাগাদ অর্থাৎ ১৮৯২ ইংরেজি সনের জানুয়ারি মাস নাগাদ জফরগড়ের জমিদারী সম্পত্তি লংলার বিখ্যাত পৃত্তিমপাশার আলী আমজদ সাহেবের সাহেবের কাছে বিক্রি করেন। ওই টাকার দিয়ে ১৮৯টি মৌজায় বিস্তৃত কৌড়িয়ার জমিদারীর মাত্র ৮৮টি মৌজা রক্ষা করতে সমর্থ হন। এর একটি মৌজার অন্তর্ভূক্ত ছিল রামপাশা এবং এই স¤পত্তি আজীবন তার অধীনে ঠিকে থাকে। সজিদা বানুর গর্ভে দুই পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আনুমানিক ১৮৮৫ সনে জন্ম নেন শিশুপুত্র দেওয়ান আলীনূর রাজা এবং ইনি শিশু অবস্থাতেই মারা যান। পরে জন্ম নেন ১৮৮৯ সনে হাসন রাজার বেঁচে থাকা চারপুত্রের মধ্যে তৃতীয় পুত্র। পরবর্তীকালে তিনি কাব্যবিশারদ খানবাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা নামেই পরিচিত ছিলেন। হাসন রাজা সাহেবের চতুর্থ স্ত্রী সাজিদা বানু ১৮৯২ সালে তার পূর্ব-পক্ষের পুত্র দেওয়ান আজিজুর রাজাকে সঙ্গে নিয়া হজ্বব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফে গমন করেন। প্রথম হ্জ্জ পালন করার পর পুরো একটি বছর মক্কায় অবস্থান করে দ্বিতীয় হজ্ব পালন করেন। হাসন রাজা সাহেবের বৈমাত্রিক ভগিনী ছহিফা বানুও তার হজ্জসঙ্গী ছিলেন। এই হজ্জকালে তিন বছরের একলিমুর রাজাকে বাবা হাসন রাজার কাছেই রেখে যান। এরপর অতি ধর্ম-পরায়ণা সজিদা বানু দেশে ফিরে এসে আজীবন তিনি আল্লাহর এবাদতে মশগুল ছিলেন। হাসন রাজা তার স্ত্রীর এই ধর্মীয় অনুশীলনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলেই স্থানীয়রা তাকে অদ্যাবধি পীরানী বিবি বলে সম্বোধন করেন।

পঞ্চম বিবাহ : সুনামগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত দিরাই থানার ভাটিপাড়া নিবাসী জমিদার পরিবারের মোহাম্মদ খুরশেদ চৌধুরীর কন্যা ফখরুননেসা বানু চৌধুরীকে বিবাহ করেন ১২৯৫ বাংলা সনে। এই স্ত্রী লক্ষণশ্রীতে এসে ঠিক পারুয়ার বিবির মত গান বাজনার পরিবেশে নিজেকে বেশিদিন খাপ খাওয়াতে পারেননি। হাসন রাজার তা সহজেই বুঝে নেন এবং সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে বুঝানোর চেষ্টা করেও অপারগ হলে এই বিবির সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

ষষ্ট বিবাহ : ১২৯৯ বাংলা মোতাবেক ১৮৯৩ সালে হবিগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত নবীগঞ্জের কুরশা পরগনার অন্যতম জমিদার দেওয়ান মজুম হোসেন চৌধুরীর কন্যা জুবেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। এই পক্ষে এক কন্যা সন্তান লাভ করেন। নাম রওশন আলী হোসেন বানু (১৮৯৪-১৯৫৮)। ইনিই হলেন হাসন রাজার সর্বকনিষ্ট কন্যা সন্তান। কন্যার বিবাহ দেন সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার অন্তর্ভুক্ত সেলবরস গ্রামের খান বাহাদুর আব্দুল হান্নান চৌধুরীর সাথে। আব্দুল হান্নান চৌধুরী ছিলেন খ্যাতনামা খানবাহাদুর আব্দুল মন্নান চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র।

সপ্তম বিবাহ : আসামের লাউর অঞ্চল থেকে আগত সুরেমাপাড়ে অচিন্তপুরের অন্তর্গত সদরগড় অধিবাসী সমির চৌধুরীর কন্যা লবজান চৌধুরীকে ১৩০২ বাংলা বিয়ে করেন হাসন রাজা। তার এই স্ত্রী ‘অসাধারণ সুন্দরী ও ব্যাক্তিত্বস¤পন্না’ ছিলেন। লবজান চৌধুরী হাসন রাজার জীবনের শেষ দিনগুলাতে সেবা সুশ্রসার এক বড় অবলম্বন ছিলেন। তারই গর্ভে স্বনামখ্যাত দেওয়ান আফতাবুর রাজার জন্ম হয় ১৩০৩ বাংলা সালে। হাসন রাজার বয়স যখন একচল্লিশ তখন লবজান চৌধুরীর বয়স মাত্র সতের বছর। লবজান চৌধুরী ও হাসন রাজার মধ্যে বয়সের এত তারতম্য থাকা সত্তেও শোনা যায় এই স্ত্রীর কাছেই নাকি হাসন রাজা অফুরন্ত সুখ আর সেবা পেয়েছিলেন। বয়সের শেষ সীমা পর্যন্ত তার কাছে কাছে থেকে লবজান চৌধুরী তার স্বামীর যতœ নিয়েছিলেন বলে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। এই লবজান চৌধুরীকে বিয়ে করতে গিয়ে হাসন রাজা যৌবনোত্তীর্র্ণ বয়সে বেশ কিছুদিন অপেক্ষায় ছিলেন। কেননা অন্য সতিনদের ঘরে কন্যার দুর্ভোগ পোহাতে হবে এই আশংকায় লবজানের পিতা সমির চৌধুরী এই বিয়েতে সম্মতি দিতে নারাজ ছিলেন। যখন হাসন রাজার কাছ থেকে তার কন্যার সুখ-সাচ্ছন্দ্যের আশ্বাস পেলেন তখন তিনি মেয়েকে বিয়ে দিতে সম্মত হন। এই প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ দিক উল্লেখ করতে হয় যে, লবজান চৌধুরীর নিজের ছেলে/তার ছেলেবউ কিংবা নাতি নাতনিদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, হাসন রাজা লবজান চৌধুরীকে তার ১৬/১৭ বছর বয়সে দেখতে পেয়েছিলেন বলেই তার সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য্যে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তার পিতার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েই কুমারী লবজান চৌধুরীকে বিয়ে করতে সমর্থ হন। অন্যদিকে হাসন রাজা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই একটি বিশাল উদার মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। নিজের বিয়ে-জীবনেও এরকম একটি সহজ মনোভাব ছিল। যেমন-বড়ভাইয়ের বংশধরগণকে প্রটেকশন দিতে গিয়ে তার নিজের বয়স থেকে অধিকতর চার বছরেরও বেশি বয়স্ক বিধবা ভাবি (সজিদা বানু )কে যেমন বিয়ে করেছিলেন তেমনি তার সহজিয়া জীবনে তার থেকে অর্ধেকের চাইতেও কম বয়সী লবজান চৌধুরীকে বিয়ে করেন। তাঁদের দীর্ঘ ২৭ বছরের সুখের জীবনকাল কাটিয়েছিলেন। দীর্ঘ সান্নিধ্যের কারণেই লবজান চৌধুরী ও তার গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হয় তারা এখনো হাসন রাজার জন্ম-ভিটেতে বসবাস করছেন। এই গুণসম্পন্না নারী তার খ্যাতিপূর্ণ স্বামী হাসন রাজার এতখানি অন্তরের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন যে তাকে অফুরন্ত সেবাসুশ্রসা দান করতে জীবনে এতটুকু কার্পন্য করেননি। তেমনি হাসন রাজাও সর্বশেষ স্ত্রীকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপ্রাণ ভালোবাসতেন এবং দোয়া করতেন। এখনো সুনামগঞ্জ এলাকায় তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘লবজান চৌধুরী উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে’ অমর হয়ে আছেন।

নানান সম্ভাবনাময় দিকগুলো বিবেচনা সাপেক্ষে ধরা যায় যে, হাসন রাজার বয়স্কালে তার চিন্তা শক্তির প্রখরতা ছিল অনেক উর্দ্ধে। ভারতবর্ষজুড়ে তখন স্বদেশী আন্দোলনের ডাক পড়েছে। ষাটর্দ্ধ হাসন রাজার তখন একটি প্রেরণাই ছিল তার গানের খাতা গানে গানে ভরিয়ে দেয়া। সে-কারণে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, হাসন রাজা যে পরিমাণে গানের সম্ভার লিখেছিলেন সেই পরিমাণ গান আজও উদ্ধার করা যায়নি। যা-ই হোক দুনিয়ার আর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, সবকিছুতে নির্লীপ্ত থেকে তিনি তার নিবিষ্টমনে ধ্যামগ্নতায় চলে যান। আর এমনি অবস্থায় বাইরে-ভিতরে স্বজন-পর সবলোকের কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে যেন তিনি সম্পূর্ণ একাকী হয়ে যান। প্রশ্ন আসে তার এই নির্লিপ্ততার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তার গানের ভূবনে এত কাছে থেকে কারা সুরের জলসার পরিবেশটি জিইয়ে রেখেছিলেন?

হাসন রাজার সাধনপথে দুজন স্ত্রী কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত তারা তালাকপ্রাপ্ত হন। উদার হাসন রাজা তালাকের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছাই পুরণ করেন এবং তিনি তার গানের আপন ভূবনে ফিরে যান। বড় স্ত্রী ভুরজান বানু চিরকালই হাসন রাজার গানের সমজদার ছিলেন। কোনোদিন তিনি স্বামীর গান, কাব্য কিংবা গান-চর্চা সম্পর্কে কোনো দ্বিধাদন্ধের মধ্যে ছিলেন না। তবে তাঁর জীবন-ধারার একটি বিশেষ ধরন বা টাইপ ছিল, যা সহজ সরল মহিলা হিসেবে তার নিজস্ব প্রাত্যাহিক জীবনপথে অনায়াশে খাপ খাইয়ে নিত। তার চলাফেরায় কোনো ধরনের মারপ্যাচ ছিল না বলে হাসন রাজা তাকে আদর সহানুভূতি দিয়ে দেখতেন। গান চর্চা নিজে করতেন না কিন্তু ভুরজান বানু এই বাড়িতে যত মহিলা গায়িকাদের আনাগুনা হতো, তিনি তাদের খোঁজ খবর নিতেন, সমাদর করতেন।

হাসন রাজার দ্বিতীয় স্ত্রী আজিজা বানু বিবাহিত হয়ে এই বাড়িতে আসার পর থেকে তিনি ঘর সংসারের সমস্ত কাজেরই তদারকি শুরু করেন। এই সুযোগে ভুরজান বিবি ধর্মকাজে আত্মনিয়োগ করেন। আজিজা বানুর এই তদারকি দায়িত্বের পরিচয় পেয়ে পরবর্তীকালে শেষ স্ত্রী লবজান চৌধুরীও এই দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। বাড়িতে হাসন রাজার ভক্ত গায়ক গায়িকাদের ভিড় জমলে অন্দরমহলে গায়িকাদের সাথে খোঁজখবর নেওয়ার ব্যবস্থা থাকত। এদিকে সজিদা বানু একলিমুর রাজার জন্মের পরপরই তখনকার দিনে দু’দুবার হজ্জ সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। সিলেটের রামপাশায় তাঁর নিয়মিত অবস্থানকে হাসন রাজা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সাজিদা বানুর কাছে কিছু লোক তালকিন নেওয়া শুরু করে। তার এমনি অবস্থা পরিলক্ষণ করে হাসন রাজা রামপাশায় তার সাধনপথের ধারাটিকে খুবই সহজে মেনেই নিয়েছিলেন।

সুনামগঞ্জে লক্ষণশ্রীর বাড়িটি ছিল হাসন রাজার বেঁছে নেওয়া চিরদিনের জন্যে তার সংগীত সাধনার কেন্দ্র। পরবর্তীকালে দিলারাম (হাসন রাজার গানের একজন সাথী) একদিনের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন এভাবেÑ ‘এক মধ্যরাতে হাসন রাজা সাহেব এবং আমরা প্রায় দশ-বার জন মহিলা গায়িকা হাসন রাজা সাহেবের দু’টি গান নিয়ে বিভোর হয়ে আছি। জমে উঠেছিল গান দু’টি। আসরটি চলছিল অন্দরমহলের বারান্দায়। হঠাৎ শোনা গেল ঘরের ভিতর থেকে হৈহুল্লুর চিৎকার। আমাদের গানের পর্ব বন্ধ হয়ে গেল। সাহেবের নির্দেশে আমি ভিতরে গেলে কবুতরি আমাকে ঘরের পিছনের ধাইরে নিয়ে গেল। আমি তো অবাক, ঘরের পিছনের পেয়ারা গাছের তলায় এবং ডালে বসে বাতাশে উড়ে এমন পাতলা শরীরের পাঁচ ছ’জন পেতিœ জটলা পাকিয়েছে এবং অদ্ভুত রকম কিচির-মিচির শব্দ করছে। সাহেবকে তাড়াতাড়ি আমি খবর দিলাম। সাহেব এসে দেখলেন কিছুই নাই।’ দিলারামের ভাষ্যে জানা গেল এসব অদ্ভুত জিনিসগুলো নাকি বিদঘুটে এক আওয়াজ তুলে তার গানের আসরকে প্রায়ই পন্ড করতে চেষ্টা করতো। অন্যদিকে হাসন রাজার নাতিগনের কাছ থেকে জানা যায়Ñ ঐ রাতগুলোতে খুব সম্ভবত: ঘরের পিছন থেকে যে গোলযোগ হয়েছিল তা কোন ভূত পেতিœর কাজ নয়, সেটি তাঁর দুসম্পর্কীয় কমবয়সী কয়েকজন নাতনি কর্তৃক ঘটনা। উদ্দেশ্যÑহাসন রাজার সাধনক্ষেত্রে কিছুটা বিঘœতা সৃষ্টি করা। শেষে অবশ্যি জৈষ্ট্যপুত্র দেওয়ান গনিউর রাজা এদেরকে একবার শাষিয়ে শতর্ক করে দিয়েছিলেন। আসলে প্রকৃতপক্ষে জীবনের শেষকালে তাঁর ষাটের কুটায় যেতে না যেতে কবি অনেকটা নি:সঙ্গ হয়ে পড়েন। সেখানে তাঁর সাথে আর কেউ বড় হয়ে দাড়ায়নি, সাধনপথই হয়ে দাড়িয়েছিল জীবনের চলার পথ। হাসন রাজা আর কোনকিছুই তোয়াক্কা করতেন না। চিরাচরিত রকম স্রষ্টা-সৃষ্টির রহস্য খুঁজে বেড়াতে তিনি তাঁর আপন ভূবনে ডুবে থাকতেন, হারিয়ে যেতেন ভাবনালোকে, সুরের মাঝে প্রেমময় সন্ধানে।

সঈফা বানুর মৃত্যুর পর কবি মাত্র পাঁচ বছরের মত বেঁচেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি শুধু একবারই সিলেট এসেছিলেন। সে-বছরটি ছিল ১৯২০ সাল। কবি ভীষণ অসুস্থ। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের থেকে জানা যায়, হাসন রাজা শেষ ক’টি বছর বিমর্ষ নির্লিপ্ত অবস্থায় ছিলেন। সঈফা বিবির মৃত্যুর পর থেকে বেশ অসুস্থ ও আনমনা হয়ে পড়েন। শুধুমাত্র বার্ধক্যজনিত কারনেই হাসন রাজা অসুস্থ ছিলেন না, দীর্ঘদিন ধরে তিনি ‘গীন্নি বেরাম’ (আঞ্চলিক ভাষায়) বারংবার মলত্যাগ করার প্রবনতায় আক্রান্ত ছিলেন। একেবারে খাটি বাঙালির মত হাসন রাজার খাওয়া দাওয়াতে একটি জবরদস্ত অভ্যেস ছিলো ‘ঝাল’ খাবার সেবন করা। তিনি মাছ ভাতের সাথে শুধুমাত্র কাচামরিচ খেতেই পছন্দ করতেন না, সাথে সাথে অনেকসময় তিনি নাগা মরিচ খেতেও বসে যেতেন। এই একটি অভ্যেসের কারণেই তার উপরের রোগটি দেখা দেয়।

হাসন রাজার সংগীত-চর্চার বিষয়াদি যেমন লোকমুখে ঘুরে বেড়াতো, ঠিক তেমনি তার ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেশকিছু বিষয়াদি অনেকের নজর কেড়ে নেয়। তার গানে সে কথাই উল্লেখ হয়েছে

ইলশা রান্ধ, কইলশা রান্ধ আরও রান্ধ রউ
ভালো করিয়া ভাজ বাঈজ্ঞন সুনাপুতের বউ।
মরিচ দিও থুরাথুরা হলইদ দিও বেশাইয়া বেশাইয়া
বাগার চড়াইয়া দেও চেত চেত করিয়া।
বাগার শুনিয়া হাসন রাজায় আইসব তার ঘরে
ভাত খাইব ছালইন লইয়া আমার পুতের বউরে।


গানটির পরিচয় তুলে ধরে হাসন রাজা বাংলার ভিন্ন রকম খাবারের সাথে কতটুকু পরিচিত তাও যেনো বলে দিয়েছেন। তিনি মাঝে মধ্যে কোরমা পোলাও খাবারও পছন্দ করতেন। কিন্তু সচরাচর মাছ ডাল ভাতই তার প্রিয় ছিল। তার খাবারের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শুকনো ও কাঁচা মরিচের আধিক্য থাকত। হারিয়ে যাওয়া অনেক খাদ্য পাত্রের সংখ্যাগুলো বাদ দিলেও হাসন রাজা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত তার বাড়িতে ব্যবহৃত কয়টি পাত্রের চিহ্ন এখনো তার ভিন্ন স্বাদের তরকারির সমজদারিত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। হাসন রাজার নানান ধরণের পছন্দনীয় খাদ্যের তালিকা পরিশিষ্টে দেয়া গেলো এপেনডিক্স নম্বর।

হাসন রাজার বাড়িতে এখনও তার সময়কার একটি গোলাঘর আছে। এই গোলাঘরে নানা জাতের ধান, সরিষা মজুত থাকতো। তার গোলাঘরে নানান জাতের আউস, আমন ও বোরো ফসলের মধ্যে রাজভোগ, মধুমাধব, বিরুসাইল, কালিজিরা, টেফি, গছি, গছিসাইল, রাতা, সোনারাতা, রাতা বিরুন, কালাবিরুন, চেংরিবরুয়া, বালাম, মালা, পঙ্কিরাজ, ঘোটক, বিরই, মুক্তাসাইল, গোপালভোগ ও আখনি সাইল ইত্যাদি ধানের সন্ধান পাওয়া যায়। তার মানসপটে সাদামাটা একটি ধানের গোলাঘরের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলেই সেখানে তার সাধনালদ্ধ জীবন জগতের খোঁজ পেয়েছিলেন। তাইতো বলতে পেরেছিলেন

রঙ্গের বাড়ই রঙ্গের বাড়ইরে

বিষম উন্ধুরায় নাগাল পাইল।
উগার ভইরা থুইলাম ধান
খাইয়া তুষ বানাইল
উন্দুরা মারিবার লাগি
বিলাই আনলাম ঘরে ২
বিলাই আর উন্দুরা বেটা
এক টাইলে বাস করে \ ২
হাছন রাজায় কয়রে বাড়ই
ভিতরের উন্দুর মার
সবকিছু ছাড়িয়া দিয়া
বন্ধুর চরন ধর\ ২
হাছন রাজা কয়রে বাড়ই
তোর নাই যে আকল
পরারে সার খাওয়াইয়া
তুই খাইলি বাকল \


মহিষের দুধ থেকে তৈরি পনিরের ভোজন রুচিও তার মধ্যে খুব বেশি ছিল। একটার পর একটা পনিরের টুকরো খাওয়া যেনো তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল। হাসন রাজার বাড়িতে দুধাল গরু পালন সর্বদাই চলতো। এজন্যে বাড়ির দক্ষিণপূর্ব অংশে একটি গোয়াল ঘরের অবস্থান ছিল, যেটি লক্ষণশ্রীর মৌজা ম্যাপেও অনায়াসে আজও খুঁজে পাওয়া যায়। হাসন রাজা আরেক সখের খাদ্য ছিল দুধ ভাত, সাথে আম কলা। তার সময়ে বাড়িতে প্রচুর আম, জাম, কাঠাল ও বরই (কুল) গাছের অস্থিত্ব ছিল।

হাসন রাজার সময় কোনো পারফিউম বা সেন্টের প্রচলন এখনকার যুগের মত ছিল না। জানা যায় ‘অতি প্রাচীনকালে সিলেট থেকে সুগন্ধী আগর কলকাতা, সুদূর আরব ও তুরস্কে রপ্তানী হতো। এই সম্বন্ধে হ্যামিলট্ন সাহেব লিখেছেন, ওহ ঢ়ধঃধযধৎরধ ধ শরহফ ড়ভ অঃযধৎ রং ঢ়ৎবঢ়বধৎবফ ভৎড়স ঃযব ড়িড়ফ পধষষবফ ‘অমড়ৎ’ যিরপয রং ভড়ঁহফ ড়হ ঃৎববং পধষষবফ চবঃযধৎধ’. সিলেটের পাথারিয়া পাহাড় আগর গাছের স্থান। সেখানকার এ মূল্যবান গাছ হতে আতর প্রস্তুত হয়ে পৃথিবীর বহুস্থানে যায়। খুবই মূল্যবান এ আতর। মূল্যবান সুগন্ধীতে তৈরিতেও এ আতর দেওয়া হয়।’ হাসন রাজাও ছিলেন আতরের সমজদার। তার প্রিয় আতরটি ছিল চন্দন কাঠের বেশ সুগন্ধি। মাঝে মধ্যে তিনি তার গান বাজনার পরিবেশে আতরের সুগন্ধী সুবাস ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করাতেন। তার গানের আসরের কোনো কোন মুহূর্তে তিনি ভক্তজনকে আতরের খুশবু তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। আতরের প্রতি তার এতই আকর্ষণ ছিল যে, কথিত আছে একবার আগর অথবা আতর অনুসন্ধানে সিলেটের পাথারিয়া পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত তার যাওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রেমাষ্পদের সন্ধানে, অতিন্দ্রীয় অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ অনুসন্ধানের পাশাপাশি পবিত্র সুধাময় আতর বা আগরের মতো সুগন্ধীরও একটি অস্থিত্ব ছিল বলে মনে হয়।

হিন্দুবংশীয় পূর্বপুরুষেরা থাকার কারণে নয় বরঞ্চ হাসন রাজা ব্যক্তিগতভাবে সন্ধ্যা এবং রাতের প্রথমার্ধে ধুপের ধোঁয়া তার ঘরময় সুগন্ধি ছড়াতো। কবুতরির কাছ থেকে জানা যায় যে, ‘প্রতিদিনই হাসন রাজা তার সান্ধ্যকালীন সময়ে ধুপের আয়োজনে একটি মহিলা নিয়োগ করেছিলেন। ধুপের ধোঁয়ায় মাঝেমধ্যে সাহেব বেশ কিছুটা মাতোয়ারা হয়ে তার মরমী গানগুলো গুনগুন করে গাইতে শুরু করতেন।’ অনেকের মনে প্রশ্ন জাগেÑ হাসন রাজা দিনের বেলার কোন অংশে অথবা রাতের কোন ভাগে তার গান চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন! অনুসন্ধানে এই সময়ের ভাগটা নির্ণয় করতে গিয়ে জানা যায়, হাসন রাজা রাতের বেলা যখন ন’টা/সাড়ে ন’টার সময় থেকে গানের আসর বসাতেন এবং গানের দলবল নিয়ে মশগুল থাকতেন অর্ধরাত পর্যন্ত। দিনের বেলা হাসন রাজা কখনও কখনও বিকেলের দিকে ঘন্টা দুয়েকের জন্যে ভক্তকুলের মধ্যভাগে থেকে গানের চর্চায় মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন।

হাসন রাজার গানের আসরগুলো বিশেষত কোন্ কোন্ জায়গায় বসতো, আর কোন্ কোন্ ভাব পরিবেশেই বা তার গান চর্চা হতো! তার গানের চর্চার সময়টা ছিল লোকে লোকারণ্য। এক গোত্র মানুষকে সাথে নিয়ে গানের রচনা, গানের কলি আর সুরের ঝংকার সৃষ্টির আলোকজ্জল মুহূর্ত। কেউ হাসন রাজার সাথে গলা মিলাচ্ছে, কেউবা তবলায় চাটি মারছে, বাঁশিতে কেউ সুরের ঝর্নাধারা বইয়ে দিচ্ছে। সেই পাগল করা সুরের তালে চুটকি আর ছন্দময় তালির মাঝেই অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তে। তাইতো তার সেই সুরের রশ্মি আজও আলোকিত করে প্রতিটি মানুষের হƒদয়কে। তার আসরে অন্ততপক্ষে ষোল জন মহিলা গায়িকা এবং দশ জন পুরুষ গায়ক নিয়মিত গান করতেন। তার আসরে অন্ততপক্ষে ষোল জন মহিলা গায়িকা এবং দশ জন পুরুষ গায়ক নিয়মিত গান করতেন। শিল্পীদের গানের আসর বসত বাড়ির বৈঠকখানায় সুরমা নদীতে ভাসমান বজরায়, অচিন্তপুরের বাউল আসরে, সদরগড়ের সবুজ বাগান বাড়িতে, আবার কখনো কখনো খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে।

বসতবাটিতে গানের আসরে একটি টুলের মতো টেবিলে ছড়ানো কিছু কাগজপত্র নিয়ে হাসন রাজা ডুব দিতেন ভাবজগতে, বুনতেন কথার জাল আর মেলাতেন সুর। এ ছিল তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তিনি যেন গানের দলের মাঝ থেকে এক ভীষণ খেলায় মত্ত হতেন। অনেকের মাঝে থেকেও কখনো কখনো হারিয়ে যেতেন ভাবনালোকে। তখন দু’গাল বেয়ে অঝোরে ঝরত অশ্রæধারা। জন্ম, জীবন আর মৃত্যুর নিগুঢ় বাস্তব সত্যগুলো নিয়ে হাসন কথা, সুর ও তাল সৃষ্টির খেলায় যখন আকুল তখন তার চারপাশে ঘিরে থাকত গ্রাম্য এই গায়ক গায়িকাদের অতিন্দ্রিয় এক ভাব ও সুরের মূর্চ্ছনা। সুর আর লয়ে শুধু নয়, গানের কথায়ও যেন তাদের মনপ্রাণ উদ্বেলিত হয়ে উঠতো।

জানা যায় হাসন রাজার বেশিরভাগ সময়ই ছিল সরব মুহূর্ত, কোলাহলে পূর্ণ ছিল তার সারাটা দিন। কেননা গান বাজনা লোক লস্কর, পাইক পেয়াদা এবং ভক্তকুলকে নিয়েই হৈ-হুল্লোরে দিন কাটতো তার। কিন্তু এরপরও তার বিশেষ কিছু কিছু সময় ছিল যখন তিনি নিরব নিস্তব্ধ সময় কাটাতেন। গনিউর রাজা সূত্রে জানা যায়, হাসন রাজা তার বাড়ির অন্দরমহল ঘরের পিছনে পুকুরপাড়ে যে ঘাটটি রয়েছে সেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে চাইতেন। পুকুরের ঘাটে বসে হাওর ও নিঃস্তব্দ রাতের চন্দ্রবোলকন তথা প্রকৃতির ভিতরে নিজেকে বিলীন দেখতেন। এই পুকুর ঘাটে বসেই উত্তর-পশ্চিম কোনা দিয়ে সুরমা নদী বরাবর নীল পাহাড়ের হাতছানি তাকে বিভোর করে রাখতো। সবুজ জঙ্গল পরিবেষ্টিত নিস্তব্ধ পুকুর পরিবেশে দোয়েল ও সারসের ডাক তাকে বিমূঢ় করে রাখত। যে ঘাটটিতে বসে তিনি তার একান্ত সময়গুলো কাটাতেন তা আজ হাজারো পর্যটকের কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে এই পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত মন্তব্য করেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আমি যেন হাসন রাজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কেমন জানি তার সাথে আমি এখানে দাঁড়িয়ে একটি টেলিপ্যাথিক কানেকশন বোধ করছি। একি অপূর্ব পরিবেশ।’



হাসন রাজার উত্তরসূরী কতিপয় পরিবার-পরিজনের পরিচয়-পর্ব

(ক) হাসন রাজার পুত্রগন

১. খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা, ২. দেওয়ান হাসিনুর রাজা, ৩. দেওয়ান একলিমুর রাজা এবং ৪. দেওয়ান আফতাবুর রাজা

১ম পুত্র Ñ খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা

খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা হাসন রাজার প্রথম পুত্র। তাঁর মায়ের নাম ভুরজান বিবি। তিনি ৫ নভেম্বর ১৮৭৪ বৃহষ্পতিবার ২০ কার্ত্তিক ১২৮১ বাংলা সুনামগঞ্জে জন্ম গ্রহন করেন। ২০ জানুয়ারী ১৯৩২ এবং মৃত্যু ৬ মাঘ ১৩৩৮ সাল বুধবার । ছোটবেলা থেকেই বাবা হাসন রাজার মতোই মাঠে ঘাটে হাওরে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর দারুন শখ ছিল তাঁর। আর দশটা ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরা, সাতাঁর কাটা, বৃষ্টিতে ভিজে হাডুডু খেলাÑ এসব প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে তিনি বেঁছে নিয়েছিলেন। গনিউর রাজা বার তেরো বছর বয়স থেকেই দুর্দান্ত সাহসীরূপে বাবার দেয়া বিভিন্ন ঘৌড়দৌড় বাজিতে ঘোড়সোওয়ারী হতেন এবং অত্যন্ত পটু সোওয়ারী হয়ে বিজয়ী হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। একবার সিলেটে ইংরেজ ডেপুটি কমিশনারের সাথে এবং ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহর ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বাবার ঘোড়াকে জয়ী করিয়েছিলেন। এই খ্যাতি ছাড়াও তিনি অসাধারন শারিরীক শক্তির অধিকারী ছিলেন। কথিত আছে তিনি তাঁর এক হাত দিয়েই একটি হাতির বাচ্চা উত্তোলন করতে পারতেন। গনিউর রাজার নানান রকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। একদিকে তিনি আশাবাদী অন্যদিকে তিনি নিরাশবাদীও ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার গোড়াতে গনিউর রাজা কিছুটা লেখপড়া শিখেন। কিছুদিন তিনি সিলেট শহরে সাঈদিয়া মুফতি স্কুলে পড়াশোনা করেন। একবার উচ্চ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে হাসন রাজা তাঁকে কলকাতা পর্যন্ত পাঠিয়েছেলেন। আর একবার এই লেখাপড়ার বিষয়ে যখন তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হলো তার কিছুদিন পরেই বাড়ির টানে আবার সুনামগঞ্জে ফিরে এলেন। পরে হাসন রাজা তাঁকে বছর ছয়েক সিলেটে তার বোন সইফা বানুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। তার রোজনামচা থেকে জানা যায়, তিনি সিলেট গর্ভমেন্ট হাইস্কুলে যাতায়াত করেছিলেন। “বিদ্যালয়ের অঙ্গনে লেখাপড়ার ব্যাপারে বেশিদূর অগ্রসর হইতে না পারিলেও বাংলা ভাষা ও কাব্য সঙ্গীতে তিনি বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিতে সক্ষম হন। তাঁহার রচিত গানগুলো এই কথার সাক্ষ্যবহন করে।” হাছন পছন্দ, গনি সঙ্গীত (সম্পাদকের কথা) / পৃষ্ঠা-০১) গনিউর রাজার নিজের তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তার রেখে যাওয়া বিভিন্ন রেকর্ডপত্রাদির মধ্য থেকে এই প্রমান মিলে। তাঁর কর্মকান্ডে সব সময়ই আশা সঞ্চার করার মতো একটি ব্যাপার ছিল। কিন্তু পাশাপাশি তিনি নিরাশবাদীও ছিলেন। প্রথম স্ত্রী শ্যামাবিবির মৃত্যুর পর পরেই বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন। তার ভ্রমন রোজনামচা থেকে জানা যায় যে, তিনি তখনকার সময়ের ঢাকার অস্পৃশ্য পাড়ার পরিবেশে হতাশার সাগরে তলিয়ে যান। হাসন রাজার প্রথম পুত্র গনিউর রাজার একটি পরিপক্ক মন ছিল বলে আমরা বিভিন্ন সময় তার বিভিন্ন রেকর্ড দলিলে নিজ বর্ননায় লক্ষ্য করি। জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষের পরিবেশ সংক্রান্ত একটি সামগ্রিক চিত্র দেখতে পাই। এ কারনেই হয়তো তিনি পরবর্তীকালে নিজেকে সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত রাখতে পেরেছিলেন। দেখা যায় বেশ কয়েক বছর পর ১৩৩২ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯২৪ইং সনে ইংরেজ সরকার কর্তৃক তিনি খান বাহাদুর উপাধিতে ভ‚ষিত হন। ১৯২০-১৯৩২ সাল অর্থাৎ ১৩২৭-১৩৩৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর তিনি সুনামগঞ্জ আদালতে অনাররী ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিগতভাবে গনিউর রাজা একজন উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করার পর বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘকাল তিনি সুনামগঞ্জ লোকাল বোর্ড মিউনিসিপালটি’র সদস্য হিসেবে কাজ করেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতে নেই তা তিনি স্পষ্টতঃ অনুধাবন করতে পারতেন। তাই তার বিচার কার্যে তিনি কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না এবং সকল শ্রেনীর মানুষকে তিনি সমানচোখে দেখতেন। গনিউর রাজা ছিলেন একজন জন্মগত কবি। তিনি প্রায় চারশ খানেক গান রচনা করে গিয়েছিলেন। লোকগান হলেও তা ছিল ভাষা এবং চিন্তায় অতি উচ্চমানের। যেমন একটি গানে আমরা শুনি ঃ

“দেহতরী কর্মফল ধইরাছে গো এতইদিনে
যেমন কর্ম তেমন ফল সেকি সে জানে..”


আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গনিউর রাজা রীতিমত পর্যটক ছিলেন। ভারতে যখন প্রথম পর্যটন শিল্পের মাত্র ছোঁয়া লাগতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই পর্যটনের দিকে এই মানুষটির প্রবনতা দেখা যায়। তার বিশালাকার পর্যটন রোজনামচা আমাদেরকে সেকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘হাসন রাজা জাদুঘর’ কর্তৃপক্ষ বর্তমানে এ ‘পর্যটন ডায়েরী’ বইটি প্রকাশিত করার জন্য উদ্দ্যোগ গ্রহন করেছেন। বলা যেতে পারে, গনিউর রাজাই বাংলার পর্যটক ইতিহাসের প্রথমভাগে জন্ম নিয়ে একজন প্রথমসারির পর্যটক হিসেবেই নিজেকে পরিচিতি দান করেছেন তাঁর ভ্রমনকাহিনীতে।

হাসন রাজার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তথ্য এবং রেকর্ডপত্রাদি রেখে গেছেন তিনিই। সে প্রসঙ্গ আমরা পূর্বেই আলাপ করেছি। তিনি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাবা হাসন রাজার উচ্চানুভূতি ও দর্শনের পরিচয় পেয়েছিলেন। আর সে কারনেই ১৯২৬ সালে হাসন রাজার “হাসন উদাস” বইটি পুনঃপ্রকাশিত করার জন্যে তাগিদ অনুভব করে কাজটি সম্পাদন করেন। তাঁর সুচারু রক্ষনাবেক্ষনের কারনেই আজকে হাসন রাজার স্বহস্তে লিখিত পান্ডুলিপিগুলো আমাদের হস্তগত হয়েছে। অনেকে মতান্তর করেন যে তাঁর উদ্যোগের কারনেই হাসন রাজার কয়টি গান রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে পৌছতে পেরেছিল। এ লক্ষ্যে তিনি প্রভাতকুমারকে উৎসাহিত এবং সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন। সামাজিকভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন মানুষ। গনিউর রাজার ছিল এক প্রবল আত্মসম্মানবোধ। একবার কনিষ্ট ভাই আফতাবুর রাজার সাথে তাঁর একটি তালুক মামলা চলছিল। সে মামলায় আদালতে নিজে উপস্থিতি দিয়ে তাঁর তালুকটিকে আটকাবার প্রয়োজণীয়তা ছিল। ঘোড়া চড়ে তিনি কোর্ট প্রাঙ্গনের সামনে উপস্থিত হবার ঠিক আগ-মুহুর্তে লক্ষ্য করেনÑছোট ভাই আফতাবুর রাজা তাঁকে পিছন রেখে আদালত ঘরের সামনে লম্বা একটি সিগারেট টানছেন, এমনি পরিবেশে ছোট ভাইয়ের নিকটে পৌছলে তাঁর সম্মান-হানি ঘটবে বোধ করে সেদিন তিনি তাঁর ঘোড়াটির গতি ফিরিয়ে নেন এবং ফলশ্রæতিতে মামলাটির শেষপর্যায়ে পরাজয় মেনে নিয়ে সেদিনকার মতো তাল্লুকটি হাতছাড়া করেন। যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ঠিক তার প্রাক্কালে অনুভব করেন হাসন রাজার বাড়িতে হাসন রাজার বংশধররাই যেন বসবাস করেন। যেহেতু তার কোন পুত্রসন্তানাদি ছিল না সেজন্য তিনি নিজের কন্যাসন্তানদেরকে হাসন রাজার বাড়ির অধিকার না দিয়ে তার কনিষ্ট ভাই আফতাবুর রাজা ও তার বংশধরগনকে দান করে দিয়ে যান। এখন পর্যন্ত তাঁরাই এই বাড়িতে বসবাস করে যাচ্ছেন।

দেওয়ান হাসিনুর রাজা
(১৮৭৬-১৯৪৪)

দেওয়ান হাসিনুর রাজা ছিলেন গনিউর রাজার সহোদর। হাসন রাজার দ্বিতীয় পুত্র হিসেবে গনিউর রাজার জন্মের দুইবছর পর ১৮৭৬ সালে সুনামগঞ্জে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তিনি ভাইয়ের মতোই ছোটবেলা থেকে পশুপাখি এবং নৌকাভ্রমনে অতি উৎসাহী ছিলেন। তেরো বছর বয়স থেকেই বাবার বিভিন্ন ঘৌড়দৌড়ে অংশগ্রহন করেন। গনিউর রাজার রোজনামচা থেকে জানা যায়, একবার হাসন রাজা তাকে দুটি ঘোড়া কেনার জন্য ঢাকা পাঠান কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার পর তার কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে হাসন রাজা ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমনি অবস্থায় তিনি গনিউর রাজাকে ভাইয়ের খোঁজে ঢাকা পাঠান। এরপর তার সন্ধান মিলে। দেওয়ান হাসিনুর রাজাও ভ্রমনবিলাশী ছিলেন, যার কারনে দেখা যায়Ñ হাসন রাজা তার এই আগ্রহের কথা জানতে পেরে তাঁকে তখনকার সময় কলিকাতায় পড়াশোনার জন্য পাঠান। নূর উদ্দীন নামে হাসন রাজার পারিরাবিক জমিদারী বিষয় সংক্রান্ত একজন উকিল কলিকাতার ইটালী মুল্লা পাড়ায় বাস করতেন। হাসিনুর রাজা কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল নূর উদ্দিনের কলকাতার এই মুল্লাপাড়ার বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছেন। ঐ উকিলের বাড়িটি হাসন রাজা পরিবারের জন্যে নিজের আপন আত্মীয়ের বাড়ির মতোই ছিলো।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেবের লেখা থেকে জানা যায়, হাসিনুর রাজা নদী-নালা, খাল-বিলে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে খুবই পছন্দ করতেন। বাবা হাসন রাজা সে কথা জানতেন বলেই ছেলেকে তার সখের বজরা নৌকাটি উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠা হবার পর প্রাথমিক বছরগুলোতে যখন হাসন রাজা সুনামগঞ্জ শহরে ভদ্রজনকে বসতি স্থাপনে বিভিন্ন উৎসাহ ও সাহায্য করে যান, তাঁদের মধ্যে স্বনামধন্য মুক্তার সাহেব মোশারফ আলী ছিলেন অন্যতম। আগেই বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের আসাম প্রদেশের একজন মন্ত্রী মনোয়ার আলীর পিতা। হাসিনুর রাজা উক্ত মোশারফ আলীর কন্যাকে বিবাহ করেন। এই বিবাহে হাসন রাজার সম্মতি ছিল কিনা তা জানা যায়নি। তবে এ কারনেই হাসিনুর রাজা শশুর মোশারফ আলী মুক্তার সাহেবের বাসগৃহে সন্নিকটস্থ একখানা বড় ভূমি বাবার কাছ থেকে চেয়ে একটি বসবাসপোযোগী বাড়ি তৈরী করেন। সেটি বর্তমানে সুনামগঞ্জে হাসন নগরস্থিত ‘দেওয়ান সাহেবের বাড়ি’ নামে পরিচিত। এই বাড়িতে স্থানান্তরিত হওয়ার পরও গান বাজনার টানে উৎসাহী হয়ে লক্ষèনশ্রীর বাড়িতে তিনি নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন এবং এলাকার বিভিন্ন মানুষকে জড়ো করে তিনি গানের আয়োজনে মেতে উঠতেন। শেষ বয়সে হাসন রাজার দ্বিতীয় পুত্র হাসিনুর রাজা অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন, নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং নিভৃতচারী হয়ে পড়েছিলেন। হাসন রাজার ছেলেগনের মধ্যে তিনিই সুশ্রæমন্ডিত (দাড়িওয়ালা) হয়ে উঠেন। তাঁর বংশধররা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৪ সালে তিনি হাসন নগরাস্থিত বাড়িতে পরলোকগমন করেন।



দেওয়ান একলিমুর রাজা
(১৮৮৯ -১৯৬৪)

দেওয়ান একলিমুর রাজা হাসন রাজার তৃতীয় পুত্র। তিনি জন্ম লাভ করেন ১৮৮৯ সনে। তাঁর মা ছিলেন হাসন রাজার চতুর্থ স্ত্রী সজিদা বানু। তাঁর মা পীর ানী বিবি নামে খ্যাত ছিলেন। একলিমুর রাজা পিতার মতো নিঃসন্দেহে একজন কাব্য প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। সিলেট শহর কেন্দ্রিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার সরব পদচারণা ছিলো। কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ নবদ্বীপের ‘সারস্বত সমাজ’ তাঁকে ‘কাব্যবিশারদ’ উপাধি দেয়। ১৯২৯ সালে ইংরেজ সরকার নিযুক্ত আসামের গর্ভণর লর্ড আরউইন তাঁকে খান বাহাদুর উপাধি দেন। হাসন রাজার জীবদ্দশায় ১৩১৩ বাংলার ১৪ অগ্রহায়ন মোতাবেক ৩০/১১/১৯০৬ইং সালে একলিমুর রাজা আপন চাচাতো বোন আলী রওশন বানুকে বিবাহ করেন। আলী রওশন বানু ছিলেন হাসন রাজারই ভাই মোজজফর রাজা ও ত্রিপুরা রাজ্যের রাজকন্যা নন্দিতা রায় ওরফে ‘সফুরা জাঁহা’ দম্পতির একমাত্র সন্তান। মাত্র সতের বছর বয়সে একলিমুর রাজার এ বিবাহটি হাসন রাজা এবং সইফা বানুর সম্মতিতে সম্পন্ন হয়। স্ত্রী কিছুটা প্রাপ্তবয়স্কা হবার পর এ সম্বন্ধে তিনি দুই কন্যা লাভ করেন। একলিমুর রাজার আরো কয়েকটি বিবাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিবাহটি ছিল পারুয়ার চৌধুরী বাড়িতে। এ তরফায় তাঁর চারপুত্র দেওয়ান তৈমুর রাজা, তালেবুর রাজা, তওয়াবুর রাজা, সইফুর রাজা ও এক কন্যা ।

খান বাহাদুর দেওয়ান একলীমুর রাজা চৌধুরী জমিদারি পেশার সাথে সাথে ব্যবসা ও রাজনীতির সাথে কিছুটা জড়িয়েছিলেন। যদিও তার নেশা ছিল সাহিত্য সাধনা এবং জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত তিনি অজস্র কবিতা, গান, উপন্যাস ও ছোট গল্প লিখে গেছেন, তথাপি হাসন রাজার মতোই তাঁর কিছু অভ্যাস ছিল। যেমন- গান-বাজনা আয়োজন করা এবং তাঁর নিজের গানকে গায়ক-গায়িকা দিয়ে গাইয়ে নেয়া। কথিত আছে যে, বিশ্বনাথের রামপাশায় তিনি নানান রকম অনুষ্ঠানাদি আয়োজন করতেন। সেখানে গাজির গীত, জারিগান, ভাটিয়ালী, পীরমুর্শিদী গানের অনুষ্ঠান হত। দেওয়ান শমসের রাজা ‘একলীমুর রাজার আত্মজীবনী’ সম্পাদনায় উল্লেখ করেন- যারা এ-সমস্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতেন ‘তাদের মধ্যে বিখ্যাত গায়ক আব্দুল করিম, কালা শাহ, দুরবীন শাহ অন্যতম।’ (শমসের রাজা) পালাগান ছাড়াও এসব অনুষ্ঠানে নাটক ও যাত্রাগানের পালাও থাকতো। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় যেমন সিলেট শহরে, বিশ্বনাথ ও সুনামগঞ্জ এলাকায় লোকসংস্কৃতি ধরে রাখা বা এর চর্চায় হাসনা রাজার পরেও তাঁর পুত্রগন এবং প্রণিধানযোগ্যভাবে একলিমুর রাজা লালন পালন করেছেন, তাঁকে অনুসরন করতে গিয়ে হাসন রাজার নাতিরা যেমন; তৈমুর রাজা কিংবা আনোয়ার রাজা এবং পরবর্তীকালে প্রপৌত্ররা যেমন; দেওয়ান শমসের রাজা, দেওয়ান মমিনুল মউজদীন কিংবা আজ পর্যন্ত গ্রন্থকার সামারীন দেওয়ান এই লালন পালন কার্য্যরে সাথে জড়িত রয়েছেন।

একলিমুর রাজা তাঁর অনেকগুলো অমূল্য কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি রেখে গেছেন। সেগুলো তাঁর বংশধরদের কাছে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। আমরা আহŸান জানাই যে সে-সমস্ত পান্ডুলিপিগুলো যেনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত করা হয়।

তাঁর প্রকাশিত “প্রানের কথা গানে”, “গীতি মেঘলা” কাব্যগ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। “আমার সাহিত্য জীবনের অভিজ্ঞতা” পান্ডুলিপিটি দেওয়ান শমসের রাজার হাতে পড়ায় তাঁর সম্পাদনায় তার জীবনের অনেকটা আমরা জানতে সক্ষম হয়েছি।

একলিমুর রাজার আত্মজীবনী গ্রন্থে শমসের রাজা তাঁর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, “তিনি একাধারে আসামের আলীযান কয়লার খনি, ত্রিপুরাতে সোনমুখী ও রূপামুখী চায়ের বাগান এবং সিলেটের মৌলভী বাজারে মেীলভী চা বাগানের মালিক হন। তিনি তদানিন্তন আসামের বিভিন্ন ব্যাংকের ডাইরেক্টর ছিলেন। এছাড়াও শিলচর, শিলং করিমগঞ্জ ও সিলেট এবং ঢাকায় অনেক জায়গাজমি, বাড়ীঘর ও দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। একলীমুর রাজা ব্রিটিশ যুগে একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ১৯৩৭ ইং হতে ১৯৪৬ ইং পর্যন্ত আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি সদর মহকুমার লোকেল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট, মাছমিলাটারী কেমপেইন হয়ে ও ঋনসালিশী বোর্ডের ডাইরেক্টর ছিলেন। আসাম সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সাদউল্লাহ মন্ত্রীসভায় মিনিস্ট্রিয়েল পার্টির চেয়ারম্যান এবং আসাম টেক্সবোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি শিক্ষা অনুরাগী হিসেবে দেখা যায় সিলেটে শিক্ষা প্রসারে নানারকম উদ্দ্যোগের সাথে জড়িত ছিলেন। সিলেট শহরে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠাতা আহŸায়ক এবং সর্বপ্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।

খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ সি আই-ই ইন্তেকালের পর তিনি সিলেটের আঞ্জুমানে ইসলামিয়ার সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি রামপাশা ইউনিয়নের বৈরাগী বাজারে একলীমিয়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ভ্রমনপিয়াসী ছিলেন বলে তিনি তখনকার যুগে সময় পেলেই কাশ্মীর, লখনৌ, পুরী, দার্জিলিং, মাদ্রাজ এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটন করেছেন। তাছাড়া নিজস্ব পানশি নৌকা দিয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন বিল, হাওর ও নদীতে মাছ শিকারে বের হতেন।

সিলেটের জিন্দাবাজারস্থিত রাজামঞ্জিলের বাসায় তিনি অনেক জ্ঞানী, গুনী শিক্ষাবিদ, কবি, গায়ক, গায়িকাদেরকে মাঝেমধ্যে নিমন্ত্রন করে নিয়ে আসতেন। তাদের মধ্যে প্রনিধানযোগ্য হলেন- কবি কাজী নজরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে জাতীয় কবি),পল্লীকবি জসিম উদ্দিন, সুসাহিত্যিক ডাঃ এনামুল হক চৌধুরী, গায়ক আব্বাস উদ্দিন, নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং দার্শনিক জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, কবি দিলওয়ার প্রমুখ।

দেওয়ান আফতাবুর রাজা
১৮৯৬-১৯৫৫

দেওয়ান আফতাবুর রাজা হাসন রাজার চার পুত্রের সর্বকনিষ্ট পুত্র। ১৮৯৬ সালে দেওয়ান আফতাবুর রাজা চৌধুরী জগৎ বিখ্যাত মরমী সঙ্গীত সাধক, জমিদার দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর ওরসে প্রসিদ্ধ লক্ষনশ্রীতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল লবজান চৌধুরী। হাসন রাজার ৪১ বছর বয়সে তিনি লবজান চৌধুরীকে বিয়ে করেন। লাউড়ের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের জনাব ছমির চৌধুরীর কন্যা লবজান চৌধুরী ছিলেন হাসন রাজার সর্বকনিষ্ট স্ত্রী। এ বিবির গুন ও সেবাদানে হাসন রাজা এতই মুগ্ধ ছিলেন যে নিজপুত্র দেওয়ান আফতাবুর রাজাকে অছিয়ত করে যানÑতার নামে যেন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে তাঁর মায়ের নাম ধরে রাখা হয়। মা লবজান চৌধুরীর নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে লক্ষণশ্রীতে একখানি জায়গা বরাদ্ধ করে যান আফতাবুর রাজা। তারই পুত্র দেওয়ান আনোয়ার রাজা তাঁর দাদীর নামে “লবজান চৌধুরী বালিকা বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। আজকে সুনামগঞ্জের একটি উল্লেখযোগ্য একটি প্রতিষ্টানে রুপান্তরিত করেন।

সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সত্তে¡ও দেওয়ান আফতাবুর রাজা বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টিকোন নিয়ে বড় হতে থাকেন। পুত্রদের মধ্যে তিনি সেই ব্যক্তি যিনি নিজেকে সবসময় হাসন রাজা পুত্র-জ্ঞানে সচেতন থাকতেন। তিনি অন্য ভাইদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রমধর্মী ছিলেন এ কারনে যে তাঁর মধ্যে সৗখিনতার প্রবনতা যথেষ্ট কম ছিল। উনার জীবনে পাখী বা পশু পালনের প্রতি ঝোক লক্ষনীয় নয়। হাসন রাজার সর্বশেষ স্ত্রী লবজান চৌধুরীর কাছে শেষ বয়সে দীর্ঘকাল সেবাশুশ্রæষা পাওয়ার কারনেই তার মৃত্যু-অবধি এই স্ত্রী ও পুত্র আফতাবুর রাজার সন্নিকটেই কবির জীবন কেটেছে। আফতাবুর রাজা “হাসন রাজার সাহচর্যে সুনামগঞ্জেই বড় হয়েছেন। তার মধ্যেও সাহিত্যিক গুনাবলী লক্ষনীয় ছিল।” পিতা হাসন রাজার পুত্র হিসেবে আফতাবুর রাজাও সঙ্গীত সাহিত্যে প্রভাবিত ছিলেন।

তার সৃষ্ট প্রায় একশত গান বর্তমান ‘হাসন রাজা জাদুঘর’ কতৃপক্ষ প্রকাশ করার উদ্দ্যেগ নিয়েছেন। তাঁর এই বিশেষ গানগুলোর বিশেষ সাহিত্যিক মূল্য রয়েছে। হাসন গবেষক আবদুল হাই বলেছেন, আফতাবুর রাজার গানের একটি বই ছিল “আফতাব সঙ্গীত” নামে। এ সকল গানগুলো আধ্যাত্মিক এবং মরমী ধারায় লিখিত তবে তাতে আধুনিক কথার ছোঁয়া আছে। তাঁর জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে তারই পৌত্র সামারীন দেওয়ান একটি পুর্নাঙ্গ বই লিখছেন।

সুনামগঞ্জে আফতাবুর রাজা বহু বৎসর যাবৎ হাসন রাজার মতোই স্থানীয়বাসীদের জন্যে অবৈতনিক বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। একজন সুবিচারক হিসেবে তিনি আদালতের দায় দায়িত্বের মতোই নিরপেক্ষ বিচার-আচার পরিচালনা করেন। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে পাওয়া দেওয়ান আফতাবুর রাজা সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। তাঁর সময়ে ভারতের দূর-দূরান্ত থেকে আগত প্রখ্যাত কন্ঠ শিল্পীরা সুনামগঞ্জ সফরকালে তাঁর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে উপযুক্ত মর্যাদা ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

জানা যায়, হাসন রাজা তার পুত্রগনের শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে কোন কাপর্ন্য করেননি। আফতাবুর রাজাকে তাঁর অন্যান্য ভাইদের মত পড়াশুনার উদ্দেশ্যে বড় শহর শিলং এবং কলিকাতায় পর্যায়ক্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অল্প বয়সে দেওয়ান আফতাবুর রাজা একাকি ভাবনায় এ দূর দুরান্তের পরিবেশে ঠিকে থাকতে পারেন নি। আপন ঘরের টানে আবারো তিনি অল্পদিনের মধ্যে সুনামগঞ্জে ফিরে আসেন। মা লবজান চৌধুরীর পীড়া পীড়িতে পিতা হাসন রাজা বেশ কিছুদিন দেওয়ান আফতাবুর রাজার জন্যে একজন মৌলভী সাহেবকে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ছোটবেলা থেকে গৃহশিক্ষকের কাছে বাংলা, উর্দু, ফার্সী এবং কিছু ইংরেজী শিক্ষালাভ করতে সক্ষম হন। তার একসময়কালীন গৃহশিক্ষক ছিলেন নওফত উল্লাহ যিনি পরবর্তীকালে শরাফত উল্লাহ মাষ্টার সাহেবের পিতা। আফতাবুর রাজাকে একসময় সিলেট শহরে পাঠিয়ে দিয়ে হাইস্কুলের শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করেন হাসন রাজা। এছাড়াও কয়েকবছর আফতাবুর রাজা সুনামগঞ্জ জুবিলী হাইস্কুলেও শিক্ষাপাঠ নিয়েছিলেন।

দেওয়ান আফতাবুর রাজা অসংখ্য কল্যানমূলক কাজ করে গেছেন। সুরমা নদী বরাবর সুনামগঞ্জ শহরের ভাঙ্গনরোধে তিনি পাথর ও মাটির কাজ করান। এক সময় দেখা যায় যে, নদীর তীরবর্তী এলাকার ভাঙ্গনের আশংকা তীব্র হয়ে দেখা দেয়ার কারণে তিনি স্থানীয় গর্ভমেন্টের সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিছু কিছু জায়গায় পাঁকা বাঁধ দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তার প্রচেষ্টায়ই সুনামগঞ্জ শহরকে সুরমা নদীর ভাঙ্গন থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে প্রতিরোধ গড়ার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। তার সময়কালে তাঁর নিজের একতিয়ারাধীন এবং স্থানীয় প্রসাশন আওতাধীন অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ডে পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। এর মধ্যে ছিল সুনামগঞ্জ কলেজ, সুনামগঞ্জ হাসপাতাল, কিছু কিছু স্কুল প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তাঘাট। হাসন নগরের পাশাপাশি জঙ্গল আবাদ করিয়ে তিনি আরো দুটি এলাকা সৃষ্টি করেন। যেখানে নব আগন্তুক শহরবাসীরা স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে পারেন। এ লক্ষ্যে তাঁর গড়া হাসন বাহার ও আফতার নগর নামে দু’টি এলাকা সেই সাক্ষ্যবহন করে। শহর সংলগ্ন এই দুই গ্রমের পাশাপাশি অসংখ্য গ্রামে জনসাধারনের বসতিকরন করান এবং পতিত জমি চাষবাসের আওতায় নিয়ে আসেন। একারনে অত্র এলাকার লোকেরা উক্ত অঞ্চলে একটি ইউনিয়নের নামককরন করে আফতাবনগর ইউনিয়ন এবং ১৯৫২ সাল থেকে এ যাবৎ এই নামেই ইউনিয়নটি পরিচিত ছিল। বর্তমানে এসব অঞ্চলে পৌরসভার সব সুবিধাদি রয়েছে। ইদানীং শুনা গিয়েছে, আফতাবনগর গ্রামটির নাম পরিবর্তন করে নুতন নাম দেয়া হয়েছে কুরবান-নগর। লক্ষ্য করা যায় নামটি পরিবর্তন করার পিছনে যে যুক্তি দেয়া হয়েছে,তা হলো বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত যেনো এ দেশের কোন ইতিহাস ছিল না। শুনা যায় বাংলাদেশ স্বাধীনতার বেয়াল্লিশ বছর পর এই পরিবর্তনের পক্ষে পাশাপাশি গ্রামের বসতকারী এক হুমড়াচুমড়া ব্যক্তির মদতে নাকি সম্ভব হয়েছে। এ্ নিয়ে এলাকাবাসী আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই মনে হয় প্রকৃত ইতিহাসের সত্য পাতাগুলার পরিবর্তন ভবিষ্যতে আরো আমাদের দেশের কপালে জুটবে বলে আশংকা রয়েছে, এতেকরে আগামী সত্য ইতিহাস জানতে বঞ্চিত হবে। আর এভাবেই ইতিহাস সমৃদ্ধির দীনদশার অবস্থা ঘটবে।

বাইশ বছরেরও ছোট ভাই আফতাবুর রাজাকে গনিউর রাজা যেমনি ¯েœহ করতেন ঠিক তেমনি তার প্রাপ্ত-বয়সকালে তাঁর সাথে জমিদারি সম্পত্তি নিয়ে মামলা মুকদ্দমা হয়। বয়সে সবচেয়ে ছোট থাকায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে আফতাবুর রাজা সহায়-সম্পদে বঞ্চিত হওয়ারই আশঙ্কা অনুভব করেন। তখন হাসন রাজার বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি। সেই সময়কাল থেকেই হাসন রাজার পুত্রগনের মধ্যে জমিদারী তাল্লুকাদি এবং বিষয়আশয়ের উত্তরাধিকার নিয়ে মামলা মোক্কদমা প্রায়ই চলতো। আফতাবুর রাজা ও গনিউর রাজা অবশ্য বাবার মৃত্যুর কয়েকবছর পরই বুঝতে পেরেছিলেন ভাইয়েরাও পরস্পর পরিবারে যথেষ্ট সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন। এই অনুধাবন থেকেই গনিউর রাজা একবার তাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সে চিঠির মর্মাথ থেকে বোঝা যায় হাসন রাজার মৃত্যুর পর এই গুরুত্বপূর্ন বিষয়টি বুঝতে পারলেন এবং ভাতৃত্ত¡-বন্ধনের মধ্যে আপন পিতৃপরিচয় উচ্চে তুলে ধরা সম্ভব। তখনই হাসন রাজার পুত্রগন সমাজ ও পরিবেশে বাবার গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হন। ফলশ্রæতিতে দেখা যায় ১৯৩০ সালের দিকে গনিউর রাজা বাবার (হাসন রাজা) কাছ থেকে প্রাপ্ত হাসন রাজার মূল বাড়িটি বৈমাত্রেয় কনিষ্ট ভ্রাতা দেওয়ান আফতাবুর রাজাকেই সমজিয়ে দেন। আফতাবুর রাজা ১৯১৩ সালে আকলিমুন নেসা চৌধুরানীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯১৬ সালে তার পুত্রসন্তান আনোয়ার রাজার জন্ম হয়। প্রথম স্ত্রী আকলিমুন নেসার গর্ভে তার আরো দুজন সন্তানলাভ করেন- জগলুল রাজা এবং এক শিশুকন্যা, জন্মের পরপরই মারা যান। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন তার দাদীর বাড়ির কালিয়াজুড়ি বল্লিতে। আফতাবুর রাজা আরো তিনটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার শেষের বিবাহ ছিল সুনামগঞ্জ শহরতলী বড়পাড়ার পীর বাড়িতে। এ বিয়ে করার পর তিনি শহরতলীতে একটি বাগানবাড়ি তেরী করেন এবং সেখানে এই বউয়ের সন্তানাদিকে রাখার ব্যবস্থা করেন। এই বাড়িটিকে আজও ভুল করে অনেকে হাসন রাজার বাগান বাড়ি নামে আখ্যায়িত করে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আফতাবুর রাজার বাগানবাড়ি।

দেওয়ান আফতাবুর রাজার জীবনে কিছু রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতনতা ছিল। তিনি মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন আল্লাহ যেন আমাকে জমিদারী তুলে নেয়ার আগে দুনিয়া থেকে তিনি নিজেকেই যেনো তুলে নিয়ে যান এবং শেষপর্যন্ত তা-ই তাঁর কপালে জুটেছিলো।

শোনা যায়, আফতাবুর রাজা তাঁর সমকালের ডাকে রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৩৬ সালে যখন একবার কংগ্রেসের প্রখ্যাত নেতা এবং পরবর্তীকালের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা জওহার লাল নেহেরু রাজনৈতিক প্রচারণার উদ্দেশ্যে সুনামগঞ্জে রাজনৈতিক সফর করেন তখন আফতাবুর রাজা পন্ডিত নেতাকে সাদর সম্ভাষণ জানান। নেহেরুকে সম্মানের সাথে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য তিনি নিজ ছেলে দেওয়ান আনোয়ার রাজা চৌধুরীকে ঘোড়া সওয়ার বাহিনীসহ জয়কলশের নিকটবর্তীস্থানে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর জীবনে একটি জিনিস লক্ষ্য করা যায় যে, অখন্ড ভারতের পক্ষে তাঁর বাবার দৃষ্টিভঙ্গীকে অনুসরণ করার কারনেই তিনি পাকিস্তান হওয়ার পক্ষে ছিলেন না। পাকিস্তান হওয়ার প্রাক্কালে তিনি তার বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার পরিজনকে এও বলেছিলেন যে, “পাকিস্তান হওয়ার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।” কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর বিশেষত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তান প্রশাসনের নীতিজ্ঞানহীন নানান ধরনের রাজনৈতিক অপকর্ম-তৎপরতায় আফতাবুর রাজা বিচলিত হয়ে উঠেন। তখনকার সময়ে সুনামগঞ্জে কট্টরপন্থী মুসলিমঘেষা রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস মনোভাবে তিনি স্বেচ্ছায় বছর দুয়েক নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পট-পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আফতাবুর রাজা তার পিতার সম্পত্তির রক্ষনাবেক্ষনে এক বেশামাল অবস্থায় পতিত হন। তার কিছুদিন পরেই ১৯৫৫ সালে তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান।

এতদঞ্চলের সমাজ উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রেই তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ তাঁরই দানকৃত ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মায়ের নামে লবজান চৌধুরী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নীতি নির্ধারন করেন। অসংখ্য দিঘি-পুকুর, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করে তিনি জনহিতকর কাজের এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন্ অনাগতকাল ব্যাপী গরিব-দুঃখী মানুষের সাহায্যার্থে ও জনহিতকর কাজের উদ্দেশ্যে তিনি আফতাবুর রাজা ওয়াকফ্্ স্টেট প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাঁর বাবা হাসন রাজার পরামর্শে । উক্ত ওয়াকফ্্ স্টেটের বিশাল জায়গা সম্পত্তি তার পুত্র-পৌত্রগণ দেখাশোনা করেন। সুনামগঞ্জস্থিত লক্ষণশ্রীর ‘হাছন রাজার বাড়ি’Ñতে দেওয়ান আফতাবুর রাজাই কেবল বসবাস করতেন। আমি লেখক সামারীন দেওয়ান সেই বাড়িতে আমার শেষকাল কাটাচ্ছি।

(খ) হাসন রাজার কন্যাগন
এখানে হাসন রাজার মেয়েদের দিকগুলোকে তুলতে গিয়ে পাশাপাশি তাঁদের স্বামী-বংশ পরিচয় তুলে ধরা হলো: চার কন্যাগনঃ
১. রওশন হুছন বানু, ২. রওশন আক্তার বানু, ৩. রওশন হাছন বানু এবং রওশন আলী হোসেন বানু
হাসন রাজা তাঁর কন্যাগনকে ভীষনরকম ভালোবাসতেন। তাঁর নিজের মেয়েদের বেলায় তিনি একরকম পাগলপ্রায় ছিলেন। ¯েœহের আবেগে আপ্লুত হয়ে থাকতেন সর্বদা। মেয়ের জন্ম হওয়ার পর তাঁর মেয়ের নাম কি রাখবেন- না রাখবেন তা নিয়ে যেনো তাঁর ছিলো শত ভাবনা। হিন্দু মুসলিম পন্ডিত-চিন্তাবিদদেরকে নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা চলতো তাঁর নানান জল্পনা কল্পনা। মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়ার সময় হাসন রাজার রই রই মহাসমারোহ। তখন মেয়ের বিয়েতে শুধু বরপক্ষ খাওয়া দাওয়া করলেই চলবে না, পাঁড়া-প্রতিবেশী এমন কি সারা এলাকার লোককে একবেলা খাওয়াতে হবে। তাই এত সরঞ্জাম। এদিকে খাওয়া-দাওয়া প্রস্তুতির জন্যে চাউল, ডাল, তেল, ঘি, মাছ, মাংশ এমন কি চুলার আগুনের জন্যে স্তুপের পর স্তুপ লাকরি জমা করা চাই। এসব করার পর মেয়েদের বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দেবার এক বিরাট পালা। রাতের পর রাত দাওয়াতিদের লিস্ট তৈরী করা। একবার হাসন রাজার ভাবনা হলো তিনটি মেয়ে যেনো হঠাৎ করে বড় হয়ে গেলো। এক এক করে একেকজনকে বিয়ে দিলে পর হাসন রাজার যে কষ্ট পোহাতে হবে এই কষ্ট তিন তিনবার সহ্য করতে পারবেন না বলেই তিনি একই সাথে তিন মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্যে উদ্যোগ নিলেন। ১৮৯৪ সালের সেই খবরটি গনিউর রাজা তাঁর লেখায় এরকম পেশ করেনÑ ‘ সম্ভবত: সেই বৎসরটি ছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস। ভগ্নীত্রয়ের বিবাহ-বাজার নিমিত্ত দ্বিতীয় বারের মত আমার ঢাকা ভ্রমন। এই ভ্রমনে আমরা চার ব্যক্তি ছিলামÑ দেওয়ান গনিউর রাজা, মশ্রব আলী ওরফে উদাই মিঞা, শ্রীহট্টের সদাগরটুলা নিবাসী আব্দুল আজীজ খাঁ ওরফে সুবা মিয়া এবং তেঘরিয়া নিবাসী সেখ কলন্দর। তখনকার সময়ে ঢাকায় কোন মটরগাড়ী ছিল না। ঘোড়ার গাড়ী করিয়া সমস্ত শহর প্রদক্ষিন করা যাইত।’ (গনিউর রাজা, ঢাকা-দ্বিতীয়-ভ্রমন, গনিউর রাজার ভ্রমন রোজনামচা, ১৩০০ বঙ্গাব্দ) মেয়েদের বাল্যকালে শুধু নয় এমন কি তাঁরা যখন বড় হয়ে উঠেন তখনও তো তাঁদের নানান আব্দার-আহ্লাদে হাসন রাজা কাতর হয়ে উঠতেন। এর একটি কাহিনী আমরা আগেই শুনেছি হাসন রাজার সৌন্দর্য্যবোধ এবং প্রকৃতিপ্রেম অধ্যায় থেকে যেখানে দেখা যায় মেয়েদের বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে পাহাড় দেখার আব্দার তিনি উপেক্ষা করেননি। নৌকাভ্রমনে বেড়িয়ে তাঁরা বন-জঙ্গল মাঁড়িয়ে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশ দেখতেও খুব একটা কঠিন হয়ে উঠেনি। লক্ষ্য করা যায় যে মেয়েদের বিয়ে সময়ে হাসন রাজা বিশেষ এক কৌশল নীতি অবলম্বন করেন। জানা যায় মেয়েদের কাবিন নামায় রওশন হোসেন বানুর ক্ষেত্রে দশ আনা সম্পত্তি, মেঝ মেয়ে রওশন আখতার বানু ক্ষেত্রে ষোল আনা সম্পত্তি, এবং ছোট মেয়ে রওশন আলী হোসেন বানুর ক্ষেত্রে ষোল আনা সম্পত্তি স্বামীদের কাছ থেকে আদায় করে নেন। সেজ কন্যা রওশন হাছন বানুকে নিজ ভাতিজার কাছে বিবাহ দিয়ে তাঁর নিজের দানকৃত সম্পত্তিটি নিজ কন্যার নামে ওয়াকফ আওলাদ করে দেন। এই কাজগুলোর পিছনে তাঁর মূল লক্ষ্যটি ছিল যে কন্যাগনের বৈবাহিক জীবনে নিরাপত্তা বিধান করা। অর্থাৎ কোনো ক্রমেই যেনো কন্যাগন স্বামীর বাড়িতে স্বামীর অবহেলার পাত্রি না হন।

১) জৈষ্ঠ কন্যা
রওশন হুছন বানু : স্বামী দেওয়ান মোহম্মদ আসফ
তথ্যসুত্র: দেওয়ান আসাদুজ্জামান, পিতা দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ থেকে প্রাপ্ত
সংগ্রহ: দেওয়ান আলমনুর রাজা
বংশ পরিচয়

দেওয়ান মোহম্মদ আসফ, হাসন রাজা সাহেবের জৈষ্ঠ কন্যা রওশন হোসন বানুকে বিবাহ করেন। উদার প্রকৃতির এই কন্যাসন্তান লোকজনকে অত্যন্ত সমাদর করতেন ছোট বড় নির্বিশেষে। তাঁর বিনীত ভাব আর দান খয়রাতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে অনেক সময় পরোপকার্থে উদ্ভোদ্ধ করতো। তিনি যদি একবার একটি গান শুনতেন পরক্ষনেই তা তাঁর মুখস্ত হয়ে যেতো। গানের কলি সহজেই তাঁর প্রানে গেথে যেতো। কোরান, আরবী, উর্দু ভাষায় তিনি পারদর্ষীনী ছিলেন। যদিও বাবার বাড়ি হতে মাত্র ১২ মাইলখানেক দুরে স্বামীর বাড়ি। কিন্তু বাবা হাসন রাজার বাড়ি ঘুরে যেতে তাঁর মন সবসময় উসখুস করতো। লক্ষণশ্রীতে গেলে পর বাবার কাছে কুরকমই আবদার থাকতো। স্বামী মোহম্মদ আসফের হিন্দুবংশীয় পূর্বপুরুষ প্রেমনারায়ন চৌধুরী ধর্মান্তরিত হয়ে মুহাম্মদ ইসলাম নাম ধারন করেন। মুহাম্মদ ইসলামের পূর্বপুরুষ রাজা শ্রীমন্থ রায় মাগুরার পানাইল অঞ্চল থেকে হবিগঞ্জের সিনান ঘাট অঞ্চলে এসে বাসস্থান গড়েন। তার কয়েক পুরুষ পরে সুনামগঞ্জের ছাতক এলাকায় এসে পানাইল গ্রাম নামে একটি অঞ্চলের গোরাপত্তন করেন। এই পানাইল গ্রাম দোহালিয়া পরগনার অন্তর্গত। রাজা শ্রীমন্থ রায়ের অধস্তন সপ্তম পুরুষ প্রেমনারায়ন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এই দোহালিয়া অঞ্চলেই।

২) হাসন রাজার দ্বিতীয় কন্যা
মোসাম্মত রওশন আক্তার বানু : স্বামী দিলওয়ার রাজা চৌধুরী
তথ্যসুত্র: ‘গনিউর রাজার তথ্যকথা’ থেকে প্রাপ্ত


১৩০০ বঙ্গাব্দে গনিউর রাজা ও হাসিনুর রাজার একই মায়ের গর্ভে জন্মপ্রাপ্ত তাঁদের আপন বোন রওশন আক্তার বানুর আরো দুই সৎবোনের সাথে একই দিনে বিয়ে হয়। রওশন আক্তার বানুর স্বামী ছিলেন দিলওয়ার রাজা চৌধুরী। তিনি খাসিয়া ধেনু রাজার নবম উত্তরসুরী পুরুষ। দেলাওয়ার রাজা ওরফে মিজু মিয়া, দেওয়ান হাসন রাজা সাহেবের দ্বিতীয় কন্যা রওশন হাসন বানুকে বিবাহ করায় তিনিও হাসন রাজার অত্যন্ত প্রিয় ও ¯েœহভাজন হয়ে দাড়িয়েছিলেন। গনিউর রাজা জানিয়েছেন বাবা হাসন রাজা এই কন্যাজামাতাকে একটি অতি ভালো জাতের হাতি বিয়ের উপঢৌকন হিসেবে দান করেন । রওশন আখতার বানু অত্যন্ত সদাশয় ও ¯িœগ্ধ স্বভাবের ছিলেন। হাসন রাজার এই কন্যা ছিলেন তাঁর ¯েœহ-পুত্তুলি। হাসন রাজা যখন ঘরে থাকতেন তখন এই ¯েœহধন্য কন্যা তার অতি কাছে কাছে অবস্থান নিতেন। তাঁর শান্ত স্বভাবের চরিত্র হাসনরাজাকে প্রায়সই মোহিত করতো। বিয়ে দেয়ার ১২টি বছর পর ১৩১২ বাংলার ১২ই ভাদ্র এই মেয়ের অকাল মৃত্যু হাসন রাজাকে বিশেষভাবে শোকে বিহŸল করে তুলে। মাত্র বারটি বছরের স্বামীর ঘর-সংসারে রওশন আক্তার বানু ওরফে বাদশার মা চামতলা পরগনার হরিনাপাটী গ্রামে শুধু এক উজ্জল তারকার মতো হঠাৎ করে জ্বলে উঠে নিভে যান, তিনি বাবা হাসন রাজার লক্ষণশ্রীর বাড়িতেও উজ্জল প্রদ্বীপ হয়ে দেদিপ্যমান ছিলেন বহুদিন। এক ছেলে ও তিন মেয়েকে রেখে অল্প বয়সে রওশন আক্তার স্বগারোহন করলে পর হাসন রাজা গভীর শোকে ভেঙ্গে পড়েন। এত আদরের মেয়ের মৃত্যুর পর লক্ষণশ্রীতে তাঁর বাস ঘরের বারান্দার পাশেই মেয়েকে কবরস্থ করেন। অধিক শোকাহত হাসন রাজার কান্না কলরবে অস্থির হয়ে উঠেন দেখে জেষ্ট্যপুত্র গণিউর রাজা কবরটিকে পুকুরপারে সরিয়ে নিন। শেষে দেখা যায় হাসন রাজার তাতেও কোন পরিবর্তন আসেনি এবং পুকুরপাড়টি যখন ধ্বসে পড়া শুরু করে তখন কবরটি খুড়ে বাক্সবন্দী কংকালসার মরদেহটি শেষে পারিবারিক গুরুস্থান গাজির দরগায় স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তীকালে হাসন রাজা, মা এবং মেয়ের মাঝখানে তাঁর নিজের কবরটির কাজ করিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও সেখানে সমাহিত হন।

বংশ পরিচয়

দিলওয়ার রাজার সপ্তম উর্দ্ধতন পুরুষ ধেনু রাজা খাসিয়া রাজা হলেও জাতিতে তিনি খাসিয়া স¤প্রদায়ের ছিলেন না। তাঁর পূর্বপুরুষেরা হিন্দু আর্য বংশসম্ভূত। এই ধেনু রাজা সম্পর্কে একটি কিংবদন্তী আছে যে, ১৬০০ শতাব্দির দিকে যখন খাসিয়ারা নিজেদের মধ্যে অবিরত গৃহযুদ্ধ ও দাঙ্গাহাঙ্গামায় লিপ্ত হয়ে পড়ে তখন তাঁদের রাজবংশের কোন উত্তরসুরী নির্ধারনে ব্যর্থ হওয়াতে একসময় চেরাপুঞ্জির পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে লাউর রাজ্যের পূর্ব সীমা পর্যন্ত খাসিয়া অধিবাসীরা অশান্ত গৃহযুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজবংশের কোন নারী বা পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায় গুত্রাধিপতি নারী বা পুরুষগন আপন আপন চেষ্টায় রাজা বা রানী হওয়ার প্রত্যাশায় গৃহযুদ্ধে অবতীর্ন হয়। এমনি অবস্থায় একদিন তারা দেখতে পায় তাদের অঞ্চলে একজন অশ্বারোহী সুপুরুষ রাজ্যের জঙ্গলের ভিতরে ঘোরাফেরা করছেন। তাকে তারা বন্দী করে নিয়ে এসে রাজ্যে অনুপ্রবেশের কারন জিজ্ঞেস করে। সুপুরুষ এই ব্যক্তিটি তার আত্মপরিচয় দিলেন যে তিনি মিথিলার রাজকুমার। বন্ধুবান্ধবসহ মৃগয়াতে এসে পথভ্রষ্ট হন। এই সুযোগে খাসিয়া গুত্রগুলো মিলিত হয়ে পাহাড় হতে নেমে এসে সমতলে চামবৃক্ষের নীচে সমবেত হয় এবং ধেঁনু রাজাকে তাদের রাজ্যের রাজা হিসেবে অভিসিক্ত করে। এই সময় থেকে এই অভিষেকের জায়গাটির নামকরন হয় ‘চামতলা’। পরে এলাকাটি চামতলা পরগনায় রূপ লাভ করে। এখানে এই রাজবংশের বিদ্ধস্ত ‘শকুহরমহল’ নামে এক প্রাসাদের ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায়।

ধেনু রাজার জন্ম হয় আনুমানিক ষোলষ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে। শুনা যায় যে, কম্পানী যুগ পর্যন্তও এই খাসিয়া রাজ্য সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলো। ধেনু রাজা তাঁর যুদ্ধে নিপুনতার কারনে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজার তথ্যকথায় জানা যায় যে, এই ধেনু রাজা দুহালিয়ার জমিদারদের সংগে এক যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাঁদেরকে পরাজিত করে তাদের অতি সুন্দরী জমিদার কন্যা চন্দ্রকলা দেবীকে বিবাহ করেন। সুরমা নদীর একটি অবস্থানে দুয়ারা ও দোহালিয়া সংশ্লিষ্ট চন্দ্রকলার বাকটি স্থানীয়বাসিদের মুখে মুখে এখনো প্রচলিত আছে।

৩) হাসন রাজার তৃতীয় কন্যা
রওশন হাছন বানু : স্বামী দেওয়ান আজিজুর রাজা চৌধুরী (হাসন রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র)
তথ্যসূত্র: দেওয়ান আলমনুর রাজা
বংশপরিচয়
দেওয়ান আজিজুর রাজা, হাসন রাজার তৃতীয় কন্যা রওশন হাসন বানুকে বিবাহ করেন। দেওয়ান আজিজুর রাজা হলেন দেওয়ান হাসন রাজার জৈষ্ঠ ভ্রাতা দেওয়ান ওবায়দুর রাজা সাহেবের কনিষ্ঠপুত্র। হাসন রাজার এ তৃতীয় কন্যা পুরোমাত্রায় একজন সংসারী জমিদার কন্যা ছিলেন। চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়াতে তার সাংসারিক দায়িত্বের সীমারেখা ছিল না। নিজ বাবা হাসন রাজা থেকে অঢেল সম্পত্তি লাভ করেন। শশুর ওবায়দুর রাজা মৃত্যুকালে কোন পুত্রের জন্য কোন কিছু রেখে না যাওয়ায় বাবা হাসন রাজা নিজ কন্যাকে বাতিজার কাছে বিবাহ দিয়ে কৌড়িয়া সম্পত্তির প্রায় অর্ধেক মালিকানাই এই কন্যার নামে লিখিত করে দেন। এতে করে লক্ষ্য করা যায় যে রওশন হাছন বাবু পিতার সম্পত্তি লাভ করে পুরোপুরি একজন মহিলা জমিদারে পরিনত হন। তিনি এমনই এক ব্যাক্তিত্ব ছিলেন যে তার জমিদারাধীন সমস্ত নায়েব থেকে শুরু করে পাইক পেয়াদা এবং প্রজাকুল তার মুখাপেক্ষী থাকতো। প্রজাদের সাথে তার ব্যবহার ছিল অনেকটা মায়ের মতো। সে কারনে প্রজারা তাকে অতি সমীহ ও প্রীতির চোখে দেখতো। রামপাশার একই বাড়িতে একলিমুর রাজার পাশাপাশি থাকাকালীন সময়ে ছোটভাই একলিমুর রাজাকে যেমনি সেহ্ন করতেন, ঠিক তেমনি তার সাথে ক্ষনে ক্ষনে ঝসড়া বাঁধতো। ভাই-বোনের এরকম সেহ্ন ভালোবাসা আর অভিমান আবদারের সম্পর্ক চিরদিনই ছিল। এটি শুরু ব্যক্তিগত পর্যায়ে না জমিদারী বিষয়েও। এর জন্যে প্রায়ই হাসন রাজ স্বয়ং লক্ষèশ্রী থেকে রামপামা এসে ঝগড়িা বিবাদের মীমাংশা করে দিতেন। আগেই বলেছি রওশন হাছন বানু ছিলেন অতি বয়সী একজন মহিলা। যার কারনে তিনি হাসন রাজা কর্তৃক দানকৃত এক বিরাট রওশন হাছন বানু ওয়াক্্ফ এস্টেট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম ছিলেন। তার স্বামীভক্তি এতটুকু ছিল যে, তার স্বামী আজিজুর রাজা কোন সময়ই একের অধিক বহুবিবাহে আবদ্ধ হননি।

উল্লেখ্য, আজিজুর রাজার পিতা দেওয়ান ওয়াবদুর রাজা হাসন রাজার বড়ভাই থাকার কারনে তারা একই বংশধারার।

৪) হাসন রাজার চতুর্থ কন্যা
রওশন আলী হোসেন বানু : খান বাহাদুর আব্দুল হান্নান চৌধুরী
বংশপরিচয়
খান বাহাদুর আব্দুল হান্নান চৌধুরী হাসন রাজা সাহেবের চতুর্থ কন্যা আলী হোসেন বানুকে বিবাহ করেন। কনিষ্ঠ কন্যা হিসাবে তিনি হাসন রাজার অত্যন্ত প্রিয় কন্যা ছিলেন। আব্দুল হান্নান চৌধুরী ময়মনসিংহ এলাকার রাজা গোবর্ধনের পুত্র রাজা নারায়ন বল্লব বংশধর। নারায়ন বল্লবের পুত্র রাজা রাধাবল­ব ইসলাম ধর্র্ম গ্রহন করেন এবং মোহাম্মদ জামান নাম ধারন করেন। মোহাম্মদ জামানের অধ:স্তন চতুর্থ পুরুষ হলেন জনাব আব্দুল হান্নান চৌধুরী। তিনি আসাম প্রাদেশিক পার্লাামেন্টের একজন নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষনতা ও মানুষের সাথে সম্পর্ক তাঁকে বহুল পরিচিত করে তুলেছিল। রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিমন্ডলে বাবার আব্দুল মন্নান চৌধুরীর মতো ভূমিকার রাখার কারনেই ঠিক বাবার মতোই তিনি খান বাহাদুর উপাধি লাভ করেন।


৬. হাসন রাজার প্রয়াণ
১৯২০ সনে হাসন রাজা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময় চিকিৎসার আশায় তিনি সিলেট সফরকালে অবস্থান নিয়েছিলেন শেখ ঘাটের সেই কুয়ারপারের বাড়ি, বোনের স্মৃতিবিজরিত আবাসস্থলে। এই সময় ছিল বাড়িটি তার তৃতীয় পুত্র একলিমুর রাজার তত্ত¡াবধানে। আর সেজন্যেই সৈয়দ মুর্তাজা আলী নির্দিষ্ট করে বলেছিলেন যে ঐ বাসা বাড়িটিতেই যখন হাসন রাজাকে দেখতে যান, তখন কবি অসুস্থ অবস্থায় শায়িত ছিলেন। সিলেটে এসে যে চিকিৎসা লাভ করলেন তা তার শরীরের জন্যে কিছুতেই কাজ দিল না। সেদিন যখন তাঁর বোন সঈফা বানুর সিলেটের বাসগৃহ থেকে বাহির হয়ে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা দিন তখন তাঁর মন স্বাস্থ্য নানান কারনে ভেঙ্গে চৌচির অবস্থা। দিলারামের স্মৃতিচারনে শুনা যায় : রামপাশার পথে যেতে যেতে বলরিয়ার কন্ঠে সেদিন কবি নিজের সেই গানটি শুনার ইচ্ছা জাগায় তাকে গাইতে বলেন :


“আর কতিদন ভাঙ্গা বজরা ঠেলিব
বজরা যে পুরান হইছে,
রুককাঠ পচে গেছে,
হুতারগিরি নাহি জানি
কেমনে গড়িব \
বজরা যে পুরান মোর,
কেমনে থাকি তার আন্দর
বজরা দেখি লোকে হাসে, ছাড়িয়া যাইব \”


হাসন রাজা জীর্ণ দেহতরী পরিত্যাগের কথা শুনে শুনে যখন বজরাখানা নিয়ে কবি সুরমা ভাটি দিয়ে খাজাঞ্চি হয়ে ঢুকে পড়েন তাঁর প্রিয় নদী কাপনায় এবং বজরা যখন রামপাশার ঘাটে ভিরান, তখন সারা গ্রামের মানুষ ছুটে আসে হাসন রাজাকে এক নজর দেখার জন্যে। বজরা থেকেই তাঁর অসংখ্য লোকজনের সাথে আলাপচারীতা হয়। বিদায়কালে উপস্থিত হাজারো মানুষের সাথে তার কন্যা ও ভ্রাতুষ্পুত্র জামাতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সেদিন।

রামপাশাকে শেষবারের মত একনজর দেখে গেলেন। বস্তুত এই ছিল তাঁর রামপাশা হতে শেষ বিদায়।

দেওয়ান আজিজুর রাজা গনিউর রাজাকে জানান যে কবির রামপাশার এই শেষ বিদায়ের কয়েক বছর আগে কবি এক পূর্ব-বাক্যালাপে বলে যান যে ‘যদি রামপাশায় আমার মুত্যু হয় তাহলে আমাকে যেন আমার ভাই ওয়াবদুর রাজা ও বাবা আলী রাজার পাশে দাফন করা হয়। আর যদি সুনামগঞ্জ লক্ষণশ্রীতে মৃত্যু হয়, তাহলে আমাকে যেন আমার মা ও মেয়ে আখতার রওশন বানুর পাশে দাফন করা হয়।’ শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়টিই তার ভাগ্যে জুটেছিল। নিজের হাতে গড়া সেই লক্ষণশ্রীর তেঘরিয়া গ্রামটির কবরস্থানেই তার চিরদিনের জন্যে শয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

১৯২২ সালে যখন একটি মাইল্ড স্ট্রোক জনিত কারণে হাসন রাজা মুমুর্ষ অবস্থায় পড়ে রইলেন বিছানায় তখন তার স্ত্রী লবজান চৌধুরী ও পুত্রদ্বয় আফতাবুর রাজা ও গনিউর রাজা যথাসাধ্য সেবা করেন। ওই বছর ভাদ্র মাসে জেষ্ঠ্যপুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার ‘খান বাহাদুর’ উপাধি ঘোষণার খবরটি এসে উপস্থিত হলো হাসন রাজার বাড়িতে। খবরটি পেয়ে দেওয়ান হাসন রাজা অসুস্থতা থেকে যেন সেরে উঠলেন। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠার মত অবস্থাটি হলো এবং উচ্চস্বরে বলে উঠলেন ‘ও! গনিউর রাজা, ও! আফতাবুর রাজা, তোমরা সারা এলাকা ডেকে সিন্নি সালাতের ব্যবস্থা কর।’ তাঁর নিজের প্রথম জীবনে ইংরেজ কর্তৃক সম্মানজনক উপাধি প্রাপ্তিতে এতখানি খুশি হননি, বরঞ্চ এক রকম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেদিন। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে জেষ্ঠ্য পুত্রের সামাজিক সংহতি ও সুবিচার প্রতিষ্টার প্রচেষ্টায় ‘খান বাহাদুর’ উপাধি হাসন রাজাকে যেন অতি উৎসাহিত করে তুললো।

ঐ একই বছর ভক্ত, অনুরক্ত, বন্ধু, পোষ্য, প্রজা এবং প্রকৃতিকে ছেড়ে দেওয়ান হাসন রাজা তার একান্ত কাঙ্খিত সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করেন। তার মৃত্যুর খবর চতুর্দিকে প্রচারিত হলে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মের অসংখ্য মানুষ তাকে শেষবারের মত দেখার জন্য ছুটে আসে। তার তিরোধানে আত্মীয় স্বজনসহ সকলেই শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে। হাসন রাজার মৃত্যুকালীন সময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একটি খবর পৌঁছাতে অনেক লম্বা সময় কিংবা কয়েকদিনের মতো সময় লেগে যেতো। অদ্ভুত হলেও সত্য যে সেদিন হাসন রাজার মৃত্যু-সংবাদটি ছড়িয়ে পড়তে তুলনামূলক বিচারে খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে তার তিরোধানের পরপর সত্যি সত্যি অলৌকিক কিছু লক্ষণ দেখেছিলেন বলে কেউ কেউ দাবী করেন ।

১৯৬৫ সালের দিকে হাসন রাজার জমাদার উদাই মিয়া ওরফে মশ্রব আলীর প্রথম পুত্র মোবারক আলী (১৮৯৬-১৯৭২) জানান, ‘সাহেব হাসন রাজা শুধু কবি ছিলেন না, তিনি দরবেশও ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ঘন্টা দু’চারেকের ভিতর অন্তত গোটা কয়েক লোক তাকে সুরমা নদী পার হতে দেখেছে। আরেক ব্যক্তি এসে বললো লাউরের গড়ের জঙ্গলে নাকি সে হাসন রাজা সাহেবকে কুড়া শিকার করতে দেখেছেÑ যেদিন ছিল তার উফাতের দিন।’ এ ঘটনার একটি আভাস পাওয়া যায় সিলেটের এক জনপ্রিয় বাউল কবি কামাল উদ্দিনের রচিত একটি গানে।

হাছন রাজায় করে গেছেন ফকিরী ফিকিরী

রামপাশাতে প্রেমের খনী আসন হয় যার লক্ষণশ্রী \
---------------------------------------
কামাল বলে এ-সংসারে
প্রেমিক যারা নাহি মরে
কোরআনে যা প্রমান করে কায়া ছেড়ে যায় উড়ি \
মরার পরে কবরেতে
লাশ পছেনা এই জগতে
পাঁচ-জনে পাইলো রাস্তাতে সুরমা নদী দেন পাড়ি \


আসলে এরকম আলৌকিক ঘটনার অবতারনা হয়েছিল কিনা তা প্রমাণ করা বেশ কঠিন। তবে স্বাভাবিক মৃত্যু সংবাদের মতই হাসন রাজার মৃত্যুর খবরটি যখন তার বাড়ি থেকে দেশ দেশান্তর ছড়িয়ে পড়লো তখন এই ভাবুক মনের কবিকে হারিয়ে সেকালের সুনামগঞ্জ এলাকা ছাড়াও সমগ্র সিলেটের লোকেরাই একটি গভীর শোকের ছায়া দ্বারা আবৃত হলেন।



তথ্যনির্দেশ ও টীকা

১. খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা, বই নং ২, তথ্যকথা
২. দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা সম্পাদিত হাছন রাজা সমগ্র
৩. দেওয়ানআনোয়ার রাজা, আমার প্রতিদিনের ডাইরি অপ্রকাশিত