তিনি দেশের অন্যতম দানবীরে পরিণত হয়েও হাসন রাজা কোন সময়ই এর স্বীকৃতির প্রত্যাশী ছিলেন না। শত শত প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দান করা সত্তেও তিনি সিলেট সুনামগঞ্জে তার নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেননি। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের দু:খ দুর্দশায় হাসন রাজা প্রজাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একজন অভিাভাবক হিসেবে। তার মনে এই ভাবখানা ছিল যেÑ এ যেনো আল্লাহ প্রদত্ত অভিসম্পাত মানুষের ওপর, তার সৃষ্টির ওপর। শুধু তাই নয় এই দুর্যোগ-দুর্দিনে মানুষের কষ্ট-ভোগান্তিতেও হাসন-মন বড় কাতর, বেদনাবিদুর হয়ে উঠতো। তার প্রমাণ মিলে যখন তিনি নিজে একদিকে ছুটে গিয়েছিলেন মানুষের খোঁজখবর নিতে আর তার বড় ছেলে গনিউর রাজাকে পাঠিয়েছিলেন অন্যদিকে। গনিউর রাজা পরে ১৮৯৭ সালের ঐ-রাতের বেলার অভিজ্ঞতাটি লিখেছেন এভাবেÑ ‘ভূমিকম্পের দিন রাত্রে বুড়িরতল হইতে হাসন-নগর হইয়া বাড়ীতে ফিরিতেছিলাম, পিতা সাহেব আমাকে খবর পাঠাইলেন আমি যেনো ঐ রাত্রেই পোদ্দার ঠাকুরের বাড়ী হইয়া খোঁজখবর নিয়া শেষে আমাদের তেঘরিয়ার বাড়িতে ফিরি। অর্থাৎ তেঘরিয়া-নিবাসী সচ্চিদানন্দ ঠাকুরের বাড়ীতে বাবার নির্দেশে সেখানে গিয়া তাহাদের খোঁজখবর নেই। ঐ সময় আশ্চর্যের বিষয় দেখি যে, জীবনের মা প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা বাউলা গান গাহিতেছিল এই বিপদকালীন সময়েও। তখনও ভূকম্পন অনুভূত হইতেছিল। হাসন রাজা যেমনি দুর্যোগের ভয়াবহতায় বিচলিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, ঠিক তেমনি উনার গানের আসরের এক নিবেদিতা প্রাণ ‘জীবনের মা’র খবরটুকু নিতেও তিনি ভুলেননি। এমন মহাপ্রাণই সকল প্রাণের স্পর্শে উদগ্রীব ও উদ্ভাসিত ছিলেন।’
ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে দান করেই তিনি তৃপ্ত ছিলেন না, উপরন্তু উপরের উক্তি থেকে এ-ও জানা যায় যে, বৃহত্তর জনসাধারনের উপকারার্থে আজকের টাকার পরিমানে কয়েকশত কোটি টাকা দান করেছিলেন স্থানীয় সরকারগুলোকে। সুনামগঞ্জ শহরকে এ্কটি সুন্দর জনপদে গড়ে তুলার উদ্দেশ্যে তাঁর সংখ্যাহীন ভূমিদান এ এক উল্লেখযোগ্য সমাজসচেতনতার অধ্যায়। ‘দেওয়ান বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’র এক জায়গায় উলেখ আছে; ‘সুনামগঞ্জ শহরের প্রচুর ভদ্রলোকজনকে ভূমিদান করে তিনি সুনামগঞ্জ মধ্যশহরের এলাকাসহ বিস্তৃত জায়গায় ভদ্রলোকের আবাসস্থল গড়ে তুলার প্রচেষ্টা চালান। একবার বাঙ্গালী কয়েকজন ভদ্রলোক জালশুকার সাহা জমিদারদের কাছ হতে দানসূত্রে বা প্রজাসূত্রে জায়গা গ্রহন করতে অস্বীকার করলে হাসন রাজা তাঁদেরকে উকিলপাড়াস্থ এলাকায় এক হাল পরিমান জায়গা দানপত্র করে দিন। এছাড়া গনিউর রাজার তথ্যে উলেখিত আছে যে, ষোলঘর ও অধূনা নামকৃত হাসননগর এলাকাতেও হাসন রাজা কয়েক হাল পরিমান জায়গা ভদ্রলোক ও শিক্ষিতজনকে বসতি স্থাপনে দান করে গেছেন। উলেখযোগ্যভাবে এককালীন সুনামগঞ্জের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্টারিয়ান ও প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব মুনাওওর আলীর পিতা মুশাররফ আলী মুক্তার সাহেবকেও একজন স্বনামধন্য আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁদের বর্তমান ‘আলীমাবাগ’ নামক বাসস্থানের জায়গাটিও হাসন রাজার মাতা মুসাম্মত হুরমতজাহান বিবি কাছ থেকে ৯৯ বছরের লিজ আকারে এক একর পরিমান জায়গা সমর্পিত করা হয়। এরপক্ষে জনাব মুনাওওর আলীর জীবনালেখ্য ‘এক আলোকিত ব্যক্তিত্ত: মুনাওয়ার আলী’ গ্রন্থ থেকে যে সমর্থন মিলে তা হলো: ‘করিমগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক (এ,ডি,ও) যোগেশ চন্দ্র চ্যাটার্জী হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জে তাঁর চাকুরীর মেয়াদকালে মুশারফ আলীর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ট সখ্যতা গড়ে তুলেন। দু’জনেই ছিলেন সঙ্গীতের ভক্ত। এভাবে তাঁদের ঘনিষ্টতা অত্যন্ত গভীরে পৌছায়। ফলে চ্যাটার্জী যখন সুনামগঞ্জে আবার বদলী হলেন তখন তিনি মুশাররফ আলীকে সুনামগঞ্জে যাওয়ার জন্য জেদ ধরলেন। মুশাররফ আলী তাঁর বন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না।
মুশাররফ আলী সুনামগঞ্জ এলেন। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষ তাঁকে সহজেই আকর্ষন করল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এখানেই স্থায়ীভাবেই বসবাস করবেন। মহকুমা প্রশাসক যোগেশ চন্দ্র চ্যাটার্জী লক্ষণশ্রীর জমিদার দেওয়ান হাসন রাজাকে সুরমা নদীর তীরে মুশাররফ আলী ও তাঁর বসতবাড়ী নির্মানের জন্য এক খন্ড উল্লেখযোগ্য পরিমান জমি দিতে সম্মত করান। সুনামগঞ্জ শহরের এই এলাকা অবশেষে মুশাররফ আলীর প্রথম স্ত্রী আলীমুন্নেসা খাতুনের নাম অনুযায়ী আলীমাবাগ নামে পরিচিত হয়।’ তাই দেখা যায় হাসন রাজা এই শহরের গুড়াপত্তনের সময়ে অসংখ্য উকিল, মোক্তার, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার ভদ্রলোকগনকে বসবাসের উপযোগী বিস্তর জায়গা দান করে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে দেওয়ান আলমনুর রাজা জানান তাঁর স্মৃতিকথা ‘প্রতিদিনের বহুকথা’র আলোকে, ‘রমেশ মামার কথা না বললেই নয়। ১৯৫৪ সালের দিকে শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক বুলচান্দ হাইস্কুলের এসিস্টেন্ট হেডমাস্টার। তিনি বাস করতেন উকিল পাড়ায়। তিনি ইংরেজী পড়াতেন। আমরা কজন আত্মীয় ভাইয়েরা তখন জুবিলী হাই স্কুলে পড়তাম। আমাদের ইংরেজী শিক্ষার জন্যে তাঁকে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি আমাদের মামা দেওয়ান উবায়দুর রাজার সহপাঠি বন্ধু ছিলেন বলে তাঁকেও আমরা মামা বলে ডাকতাম। তিনি আমাদেরকে আপন ভাগিনার মত ¯েœহ করতেন। রমেশ মামা ছিলেন বি, এ, অনার্স ইন ইংলিশ। তিনি তখনকার সময়ে ইংরেজীতে একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর চলাফেরা এবং মনোভাবে আধুনিক মনের মানুষ হওয়া সত্তে¡ও সৌখিনতায় তাঁর এতটুকু কমতি ছিল না। ঘরে বাইরে তিনি ছিলেন একজন ‘ফুল বাবু’। অতি ধুমপায়ী বা চেইন স্মুকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি থাকায় একবার আমি তাকে সিলেট থেকে এনে বিদেশী সিগারেট মার্কোপলো দেয়ায় তিনি খুশী আতিশয্যে আমাকে বারবার আশির্বাদ করলেন, তুমি দীর্ঘায়ু হও।’ এবং আমার সিগারেটদানের প্রাপ্তি স্বীকারে উপরন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন মরমি কবির প্রতি যে এই শহরে ভদ্র্রলোকের বসতবাটিগুলা গড়ে তুলার পিছনে হাসন রাজার অফুরন্ত অবদান। এ-পাড়ায় সকলের সাথে আমাদের বাসাটিও হাসন রাজার দানকৃত জায়গায়।’
সুনামগঞ্জের পরবর্তী সময়কালের প্রখ্যাত বিরগাওয়ের মরহুম আবদুল বারী উকিল সাহেবের স্ত্রী মরহুমা রাবেয়া বারী (হাসন রাজার বড়ভাই উবায়দুর রাজার মেয়ে বংশধর) থেকে জানা যায় (২০১১ইং): ‘হাসন নগর এলাকার সমস্ত জায়গাটুকুই সাধারন মানুষকে হাসন রাজার দানকৃত। তাই তাঁরা এই এলাকাকে ‘হাসননগর’ বলে ডাকা শুরু করে। পরবর্তীকালে সেটি আনুষ্টানিক নাম ধারন করে। হাসন রাজার উত্তরকালীন সময়ে হাসন নগরের যত ভদ্রলোক এই এলাকায় বসবাস গেড়েছেন, তাঁরা সবাই-ই এই অল্প আয়ের সাধারন মানুষের কাছ থেকে অল্প দামে জমি বিক্রী করে এই এলাকায় সুন্দর আবাসস্থল গড়ে তুলেন। তারমধ্যে আমরাও অর্থাৎ আমার স্বামী পরিবারও একঘর ছিলেম।’ উল্লেখ্য হাসন রাজার জীবনের শেষ সময়ের দিকে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান হাসিনুর রাজাও এই এলাকায় জঙ্গল পরিষ্কার করে একটি বড় বাড়ি তৈরী করেন যেটি উল্লিখিত ‘দেওয়ান সাহেবের বাসা’ নামে পরিচিত।
দেখা যায় হাসন রাজার এই সম্পত্তি বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারী সিলিং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে সরকারীকরন করা হয়। এরপর যে সমস্ত বংশধরগনের মধ্যে অল্প অবশিষ্টাংশ সম্পত্তি রয়েছিলো, তাও কিন্তু দ্রæত তাঁদের হাতছাড়া হবার একটি কারন রয়েছে। কথিত আছে অত্র অঞ্চলে হাসন রাজা পরিবারের সায়সম্পত্তি, তাঁর লোকজন এবং বাড়িঘরকে সরকারী হিসেবেই ধরা হতো। সেকারনে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ও তাঁর পরিবারের ভূস্বত্তগুলো নিষ্কন্ঠক থাকেনি, বরঞ্চ সর্বজনের কর্তৃক ভূদখলের নামে সরকারী কর্মচারীদের দূর্নীতির জাতাকলে এই সমস্ত সরকারকৃত এবং পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তিÍ এক জটিলতার মধ্যে পড়ে খোয়া যায়। কিছুসংখ্যক স্বার্থান্বেষী লোকের স্বার্থে সরকারী ভূমি কর্মচারীগন অনিয়ম ও অপব্যবহার এর মূলে। হাসন রাজার সম্পত্তি আজ একেবারেই শেষ বিলুপ্তির পথে।
আমরা এই পর্যায়ে আশাবাদ ব্যক্ত করবো সর্বসাধারনের উপকারার্থে জাতীয় সম্পদ হিসেবে হাসন রাজার সম্পত্তির শেষ কপর্দক Ñ সুনামগঞ্জের জন্মস্থান লক্ষনশ্রী তেঘরিয়ার বাড়িটি এবং পিতৃস্থান রামপাশার বাড়ি দুটি দৃশ্যমান জায়গা। এসবজায়গাকে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী মিউজিয়াম কিংবা মরমী সঙ্গীত-প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করলে অবশ্যি দেশের মানুষ সেটিকে স্বাগত জানাবে বলে আমার বিশ্বাস। আস্থাশীল এবং সন্তুষজনক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অবদানের লক্ষ্যে এই প্রতিষ্টানগুলা পরিচালনা ও তত্ত¡াবধানের ক্ষেত্রে জরুরভাবে সংশ্লিষ্ট বংশধরগন ও সরকার যৌথ উদ্যোগ নিলে অনায়াশে তা রক্ষা করা সম্ভব।
হাসন রাজা অন্যদিকে খেয়ালি দাতাও ছিলেন এ প্রসঙ্গে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হাসন রাজা প্রায়ই সুনামগঞ্জের নদী-হাওরে ঘুরে বেড়িয়েছেন কুড়া শিকার করতে। এক বর্ষাকালে এক তান্ডব ঝড়ের সম্মূখীন হলেন। ঝড়ে হাসন রাজার নৌকা বিপদগামী হয়। ঝড়ের পর এক গ্রামের কিনারা ধরে হাওড়ের পাড়ে একজন মহিলা হাসন রাজার সম্বিতহারা দেহ দেখতে পেলো। কাছে এসে দেখলেন এক গৌড়াঙ্গের মতো চেহারার এক পুরুষ মাটিতে শায়িত। সে তৎক্ষনাৎ হরি হরি, গৌড় গৌড় বলে গ্রামের দিকে ছুটলো। গ্রাম থেকে লোকজনকে নিয়ে এসে গৌড়াঙ্গকে উদ্ধার করে তারা নিজ বাড়িতে নিয়ে গেল। অতি সেবা শুশ্রæষা করার পর হাসন রাজার সম্বিত ফিরে এলো। হাসন রাজা জ্ঞান ফিরলে জানতে পারলেন এই মহিলাই তাকে উদ্ধার করেছে, তখন তার উপরে খুশী হয়ে জানালেন- ‘তোমার চোখ যতদূর যায় ততটুকু পর্যন্ত জমির মালিকানা তোমাকে দান করে দিলাম।’ পরবর্তীকালে দেখা যায়, হাসন রাজার জমিদারের অন্তর্ভ‚ক্ত ছাতক উপজিলার অন্তর্ভূক্ত এই এলাকাটিকে ‘বেটির গাঁও’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এখনও এই গ্রামের অস্তিত্ব রয়েছে। এই মহিলা পরবর্তীকালে হাসন রাজার গান বাজনার এক বিমোহিত ভক্ত ছিলেন। তাঁর নামটি ছিলো ফুলাউরা। গানের সাথে সম্পৃক্তি রেখে নিবেদিতা এই প্রান ফুলাউরা হাসন রাজার কাছে বহুকাল যাওয়া আসা করেছেন। সাদিয়া পরাগ চৌধুরীর লেখায় অবশ্যি এই ঘটনাটি একটু অন্যরকম চিত্রায়িত করে বলেছেন, হাসন রাজা এক গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর খুব ক্ষুধা লাগে এবং এক প্রৌঢ়া মহিলা মহিলার সম্মূখীন হন। হাসন রাজাকে দেখে সে গৌরাঙ্গ বলে মনে ঠাই করে নিয়েছিল তার মনে। তাই সময় নষ্ট না করে সে ফিরে এলো ‘একদল প্রৌঢ়-বৃদ্ধ-যুবক-যুবতী বালক-বালিকাসহ। তাঁরা সদলবলে উলুধ্বনি দিতে লাগল ও শাখ বাজাতে বাজাতে বলল, “নদীয়ার গৌরাঙ্গ ফরগট’ করছে রে...”। স্থানীয়ন ভাষায় ‘ফরগট’ শব্দের অর্থ পুনর্জন্ম লাভ করা। সঙ্গের লোকজন যতই বলতে লাগলÑ তাইন দেওয়ান হাসন রাজা...। তারা ততই উলুধ্বনি ও শাঁখ বাজাতে লাগল এবং ছিড়া, মুড়ি, খৈ, কলা দিয়ে নৌকা বোঝাই করে তুলল। পরবর্তীকালে দেওয়ান হাসন রাজা উক্ত প্রৌঢ়া মহিলাটির কথা মনে রেখেছিলেন এবং তিনি এই অশ্রæত পল্লীটির তালুক উক্ত মহিলার নামে কিনে দিয়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামখানি “বেটির গাও” নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে।’