দেওয়ান হাসন রাজা (সূফি, দার্শনিক ও মরমি কবি )
পিতা: দেওয়ান আলী রাজা (বাংলা: ১২০৭-১২৭৮) (ইংরেজি: ১৮০০-১৮৭১)
মাতা: মোসাম্মত হুরমতজান বানু (বাংলা: ১২৩৫-১৩১০) (ইংরেজি: ১৮২৮-১৯০৪)
ভাই: দেওয়ান ওবায়দুর রাজা (ইংরেজি: ১৮৩২-১৮৭১)
দেওয়ান মোজাফ্ফর রাজা (ইংরেজি: ১৮৫২-১৮৭৯)
বোন: মোসাম্মত সহিফা বানু (ইংরেজি: ১৮৫১-১৯১৭)
হাসনরাজা’র জন্ম: ৭ পৌষ ১২৬১ বাংলা, ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দ
তাঁর মৃত্যু: ২২ অগ্রাহায়ন ১৩২৯ বাংলা, ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ খৃষ্টাব্দ
জন্ম স্থান: লক্ষণশ্রী পরগনা (তেঘরিয়া), সুনামগঞ্জ (বৃহত্তর সিলেট)
পৈত্রিক স্থান: রামপাশা, কৌড়িয়া পরগনা, বিশ্বনাথ, সিলেট
নানার বাড়ি: বল্লি, খালিয়াজুড়ি, নেত্রকোনা (বৃহত্তর ময়মনসিংহ)
জমিদারিত্ব গ্রহন: বাংলা ১২৭৮ ইংরেজি ১৮৭১
সিলেট-অঞ্চল ১৭৬৫-১৭৮২ পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অধীনে ছিল। কোম্পানি আমলের পর ১৮৫৮-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশরাজের সময়কাল। তখন ভারতকে দক্ষিণ এশিয়াতে ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে গণ্য করা হত। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাষনের ইতি টানে এবং ভারতকে ব্রিটিশরাজের ভারতবর্ষকাল হিসাবে আইন পাশ করে। সরাসরি ব্রিটিশ শাষিত এলাকা এবং স্থানীয় রাজাদের শাষিত এলাকা হিসেবে এই শাষণ কায়েম করা হয় এবং তা বহাল থাকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। উল্লেখ্য এই মেয়াদ কালটির শুরু যখন, ঠিক তার চার বছর পূর্বে আমাদের আলোচ্য কবি দেওয়ান হাসন রাজার জন্ম নেন ১৮৫৪ সনে এবং পরে তার চার বছর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্রিটিশরাজ কালে তাঁর সারা জীবন অতিবাহিত হয় । ১৯২২ সনে কবির মহাপ্রয়ান ঘটে এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজের অবসান ঘটে।
হাসন রাজার জন্মের পটভূমিতে বলা যায়, হাসন রাজার মায়ের ১ম স্বামীর নাম ছিলো আমির বক্স চৌধুরী। আমির বক্স ছিলেন একজন ধর্মপ্রান ব্যক্তি। পীর ফকির আওলিয়া বুজুর্গোদের প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ আস্থা। তাই যখনই কোন পীর ফকিরের নাগাল পেতেন, তখনই তাঁকে আকড়িয়ে ধরতেন। ছাড়তে চাইতেন না। তাঁর বাড়িটি ছিল অথিতিশালার মত। অতিশয় অতিথি-পরায়ন আমির বক্স চৌধুরী তার জ্যৈষ্ঠ পুত্রের মাথার উপর খাসার খাঞ্চা তুলে নিজের হাতে চামচ দিয়ে অতিথি মুসাফেরগণকে খাবার বেটে দিতেন। সেখানে হিন্দুস্থানী ফকিরগণসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পীর ফকির আথিত্য গ্রহণ করতেন। সেই সময় কত যে তাঁরা বিদায়ের অথিতি-উপঢৌকনও নিয়ে যেতেন তার কোনো শেষ ছিল না। এই ধারায় কোন কোন পীর ফকির সুনামগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস করার নজীরও পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আমরা পশ্চিম তেঘরিয়া পাড়াস্থ পীর-ফকিরগুষ্টির বসতি স্থাপন গড়ে উঠতে দেখি। প্রায় দুই শত বছরের কালের আবর্তনের পরও আজো সুনামগঞ্জ শহরে পীর ফকিরের যথেষ্ট বংশধরের অস্থিত্ব খুজে পাওয়া যায়।
যাই হোক একদিন এক হিন্দুস্থানী ফকির উপডৌকন না নিয়ে জিদ ধরে বসে পড়লেন যে, আমির বক্স চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্রের চুয়াড়ি তাজি ঘোড়াটি নিয়ে যাবে। তিনি ফকিরকে জানালেন তাঁর বড় ছেলে সখ করে এই ঘোড়াটি কিনেছিলো, সাদা রঙের এই তাজি ঘোড়াটি ছেলের অত্যন্ত সখের, তাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। ফকির জানাল, এই ঘোড়া না দিলে তাঁর আর চাওয়ার কিছু থাকবে না, সে অন্য কিছুই চায়না। এমনি অবস্থায় বাড়ীর ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করায় হুরমতজাহান বিবি ছেলের এত সখের ঘোড়াটি না দিয়ে ঘোড়ার সমান মূল্য টাকা দিয়ে ফকিরকে সন্তুষ্ট করে দিবার পরামর্শ দেন। কিন্তু ফকির জানালো, সে ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই নেবে না। আমির বক্স তাঁর পায়ে ধরে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করার পরও ফকির কিছুই না শুনে চলে গেল।
এই হিন্দুস্থানী ফকিরের প্রস্থানের কিছুদিন পরই আমির বক্স চৌধুরীর তিন ছেলে, যথাক্রমে সিকান্দর বক্ত, রেজওয়ান বক্ত, সৈইদ বক্ত এবং এক কন্যা সওয়ারী বানু বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথে যাত্রা করে। আমীর বক্স চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এর কিছুদিন পর তাঁদের ঘরানা পীর হারুলিয়ার পীরসাব মওলানা সৈয়দ আরজদ আলী সাহেব তেঘরিয়ার সাহেববাড়ীর ঘাটে নৌকা লাগালেন। ঘাটে নৌকা ভিড়ানোর পরপর আরজদ আলী পীরসাব এক শুনা কথায় কান দিলেন। জানলেন, আমির বক্স চৌধুরী এক হিন্দুস্থানী ফকিরের মুরিদ হয়েছেন, তখনই তিনি রাগান্বিত হয়ে নৌকার মাঝিকে আদেশ করলেন এই বলে যে, এক্ষুনি আটকুঁড়ের (নির্বংশ) বাড়ীর ঘাট হতে নৌকা ছাড়ার জন্যে। এই কথা চৌধুরী সাহেব যখন অন্য লোক মারফৎ শুনলেন তখন তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে ফরিয়াদ করলেন, আমার ঘরের পীরসাব যদি এই কথা বলে থাকেন, তাহলে আল্লাহ যেনো তাঁকেও নির্বংশ করেন। এরপর আমির বক্স আর বেশী দিন বাঁচেননি, তাঁর চার সন্তানকে অনুসরন করে তিনি নিজেও পরলোকে পাড়ি জমান। আর অন্যদিকে, হারুলিয়া পিরেরও একমাত্র পুত্র কোনো এক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। হাসন রাজার জেষ্ট্য পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার বিবৃত উপরের দুটি ঘটনা থেকে অনেকটা আঁচ করা যায় যে তিনি তাঁর পিতামহি হুরমতজাহান বিবির স্বামীহারা, পরবর্তীকালে তাঁর স্বামীর খালাত ভাই আলী রাজার সাথে বিবাহবন্ধন এবং পিতা হাসন রাজার জন্মের সাথে যেনো এর একটি অ’লক্ষনীয় অমোঘ সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বলে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছেন।