হাসন রাজার মানসলোকের পরিচয় পাওয়া যায় তার রচিত গানের ভিতর। তার বাস্তব জীবনের ব্যক্তিগত পরিচয়ও ফুটে উঠেছে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে, যা প্রভাতকুমার শর্মা সংকলিত করেছেন তার প্রবন্ধে। ‘হাসন রাজার চরিত্রে উদারতা, ক্ষমা, করুনা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি গুণের যে নিদর্শন পাওয়া যায় সেগুলো ছিল তার প্রকৃতিসঙ্গত, তা না থাকলেই বরং অবাক হওয়ার কথা ছিল। কারণ অন্তরে অন্তরে যিনি ছিলেন পরমাত্মার স্পর্শ লাভে উন্মুখ, তার জীবনবোধ সংকীর্ণতার গন্ডিতে সংকুচিত থাকতে পারে না, বিশ্বমানবের সঙ্গেই তার আত্মীয়তা।’
হাসন রাজাকে জড়িয়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেবের অনেক ঘটনা-বর্ননা তার শশুর অর্থাৎ হাসন রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র গনিউর রাজার বক্তব্যের সাথে কোন কোন সময় বেশ কিছুটা ভিন্নতা দেখা দিলেও - দার্শনিক এই অধ্যাপকের একটি বিশ্লেষনী উক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ন মনে হয়: হাসন রাজার ‘সত্তায় একজন সৌখিন জমিদার, একজন দাঁতা ও দয়ালু ব্যক্তি, একজন কবি ও একজন দার্শনিক এমনভাবে মিশে রয়েছিল যে, তার এক রূপের প্রকাশের পরে অন্য রূপের প্রকাশে সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হত। লাট সাহেবের দরবারে যিনি শাহানশাহী লেবাস পরে প্রথম শ্রেণিতে আসনগ্রহণ করে তার নিজের ও বংশের মানমর্যাদা রক্ষা করতেন। তিনি যখন গায়েনদের নিকটে বসে তাদের একজনের মত হাসি-ঠাট্টায় রত হতেন, তখন এরূপটি সকলের কাছেই আশ্চর্য বলে মনে হত।
প্রভাতকুমার তার লেখায় কেবলই হাসন রাজার চিন্তার প্রসারতা নিয়ে আলাপ করেননি, সেই চিন্তার ভেতরকার মানুষের স্বরূপটাও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সর্বাগ্রে তার চোখে ধরা পড়েছে হাসন রাজার উদারতা। উদারতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন- ‘মলিকপুরের জমিদার গোবিন্দবাবুর সঙ্গে জমিদারী লইয়া তাহার বিবাদের অন্ত ছিল না। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যের অভাব ছিলনা। আদালতে মোকাদ্দমা হইতেছে, এদিকে দু’জনে বসিয়া খোসগল্প করিতেছেন’ পরবর্তীকালে গোবিন্দবাবুর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে তিনি তাকে সাহায্য করেন। তেমনি আয়াতুউল্লার মিথ্যা মামলার পরও তার স্বভাবগত উদারতার কারনেই অসুস্থ আয়াতুলাকে সাহায্য করেছেন এবং মৃত্যুর পর তার দুই সন্তানকে লালনপালন করেছিলেন। তার নিত্যসহচর বিখ্যাত উদাই জমাদার এর আত্মীয়স্বজ্বন, বুধাই, মোবারক আলীসহ আরো অনেকেই হাসন রাজার বাড়ির কর্মচারি হিসেবে তখনও জীবিত ছিলেন যখন প্রভাত কুমার শর্মা হাসন রাজার বাড়িতে তাদের সাক্ষাৎ পান। শর্মা বুধাই এর কাছ থেকে উদ্ধার করেছিলেন উপরের এই স্মৃতিরোমন্থনের কথাটি। হাসন রাজার স্বচ্ছ নির্মল মন গোড়ামি ও সংকীর্নতার উর্দ্ধে ছিলো। প্রভাত কুমার যে ঘটনাটির কথা তুলে ধরেন তা সময়ের জন্যে খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে কেননা একজন জমিদারের বেলায় সেটি একেবারে বিশ্ময়কর ছিল।
‘বুধাই’ ছিলেন বাড়ির একজন প্রাচীন কর্মচারী। তার মুখ থেকে শোনা প্রভাতকুমার শর্মার লেখায় কতকগুলো কাহিনী শুনে নেওয়া সত্যিই কৌতুহলপূর্ণÑ “একদিন রাত্রে আমি বাজার হইতে ফিরিতেছি। বর্ষাকাল মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে। আমি বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিয়াছি, এমন সময় দেখি ঘোড়ার ঘরে আলো দেখা যাইতেছে। এত রাত্রে ঘোড়ার ঘরে আলো দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়া গেলাম। একটু অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম; ‘কে?’ উত্তর হইল; ‘আমি, এদিকে এসো’। স্বরে বুঝিলাম হাসন রাজা সাহেব, আমি তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইলাম। দেখি এক থাল খাবার আর এক গ্লাস জল লইয়া সাহেব দাঁড়াইয়া আছেন। সম্মুখে এক বৃদ্ধা, এক যুবক ও দুইটি শিশু ঘাসের উপর পড়িয়া আছে। এখন যায়-তখন যায় এমনি অবস্থা, অনাহারে মরমর হইয়া রহিয়াছে। সাহেব বলিলেন, ‘আলোটা তুলে ধর।’ আমি আলো তুলিয়া ধরিলাম; তিনি তাহাদিগকে যতœ সহকারে আহার করাইলেন এবং ঘুমাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। কিছুদিন পরে বৃদ্ধা ও যুবকটি টাইফয়েডে মারা যায়! সেই যুবকের ছেলে দুইটি বাঁচিয়া ছিল। একটির নাম রাখা হয় মুছলিম, অপরটির নাম মমিন। তিনি তাহাদিগকে লিখাপড়াও শিখাইয়া ছিলেন। মমিন মারা গিয়াছে, মুছলিম এখনও কোথায় যেন কনস্টেবল হইয়া আছে।”
জমিদারী জটিলতার নিরসনের ক্ষেত্রে হাসন রাজার মারমুখী, অত্যাচারী কিংবা উচ্ছৃংখল ছিলেন না; বরং পরম সহিষ্ণু মনোভাবে উদারতা প্রদর্শন ছিল তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে প্রজাকুলের হৃদয় জয় করতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী জমিদার। হাসন রাজা ছিলেন ‘সন্ন্যাসী-রাজা; রাজর্ষি’। অন্যত্র এ কথাও জানা যায়, “ইতর প্রাণী পর্যন্ত যে তাহার দয়া হইতে বঞ্চিত হইত না, সেই সম্বন্ধে একটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি। একদিন তিনি ঘোড়ায় চড়িয়া রামপাশা যাইতেছিলেন। রামপাশার প্রজা তখন বিদ্রোহী। মাঠের উপর দিয়ে যাইতে যাইতে দেখিলেন একস্থানে কতগুলি বিড়ালের বাচ্চা পড়িয়া আছে। অসহায় শাবকগুলি দেখিয়া তাহার মনে করুণার সঞ্চার হইল; তিনি তৎক্ষনাৎ ঘোড়া হইতে নামিয়া এক এক করিয়া শাবকগুলো কোলে তুলিয়া লইলেন। তারপর নিকটবর্তী এক বাড়িতে পৌঁছিয়া গৃহস্থের হাতে দশটি টাকা গুঁজিয়া দিয়া বলিলেন, ‘তুমি, এই বাচ্চাগুলো পালন কর, বাকী যা খরচ হয় আমার কাছ থেকে নিয়ো।’ তার এই গল্প শুনিয়া রামপাশার বিদ্রোহী প্রজাদের মন গলিয়া গেল। তাহারা ভাবিল; এমন যিনি, তাহার সঙ্গে কোন বিবাদ করা অনুচিত এবং সেই দিনই যাহার যাহা বাকী খাজনা পরিশোধ করিল।” এরপর এও জানা যায়, যে পরিবারে বিড়ালের বাচ্চাগুলো স্থান পেয়েছিল, হাসন রাজা তাদেরকে অনেক জায়গা জমি দান করেন। এইভাবে রামপাশার জমিদারীর অধীন প্রজাবিদ্রোহের পরিস্থিতি প্রশমিত হয়।
তার কৈশোর ও যৌবনকাল থেকেই লোকের দৈন্যদশায় তিনি কাতর ও অধীর হয়ে উঠতেন। কৈশোরে যখন গরীব মা বাবার দিগম্বর সন্তান বালক বালিকা তার নজরে পড়তো, তখন তিনি অস্থির হয়ে তাদের মধ্যে নুতন কাপড় ও খাবার বিতরণ করতেন। মুঠি মুঠি কাচা পয়সা, এমনকি গরীব লোকের মাঝে কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সা বিতরণ ও দুস্তদের মধ্যে বসত-বাড়ির জায়গাও দান করতে ও দ্বিধাবোধ করতেন না। লক্ষণশ্রীর চৌধুরী আমির বক্সের পিপিলিকার প্রতি অগাধ দয়া-সহানুভূতির জানা যায়। ঠিক তার মত হাসন রাজার মধ্যেও আমরা সেই দয়াপরবশ গুণের সমাবেশ দেখি। কখনো কখনো তাঁকে দেখা যেতো পিপিলিকার সারি সারি শ্রোতকে অনুসরণ করে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন। অপূর্ব এই পিপঁড়ার দলবদ্ধ কর্মকাণ্ডে তিনি বিমোহিত হতেন। আবার তাদের জন্যে খাদ্যের যোগানের তাগিদ বোধ করতেন। আমির বক্সের মত তিনিও প্রতি সপ্তায় দুই সের পরিমাণ চিনি খরচ করতেন পিপঁড়ার খাদ্যের জন্যে। তথ্যটি ‘দেওয়ান বাড়ির ইতিহাস’ এ পাওয়া যায়।
আবার প্রভাতকুমার শর্মা তার লেখায় জানিয়েছেন ‘তাহার বাড়ীর লোকের কাছ হইতে জানা গিয়াছে তিনি মাছি ও পিঁপড়ার প্রতিও সদয় ব্যবহার করিতেন।’ হাসন রাজা সব সময় চাইতেন সবুজ প্রকৃতি ও পরিবেশ যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকুক। সবুজ গাছপালার পরিবেশ কোনো রকম ক্ষতিগ্রস্থ অথবা কোনো পাখি-প্রাণী নিধন হোকÑ তা তিনি কখনো ভালো চোখে নিতেন না। উলেখ্য তখনকার লক্ষনশ্রী পরগনা যেটি বর্তমান সুনামগঞ্জ শহর থেকেও প্রায় দশগুণ বড় ছিল সেই এলাকায় তিনি কোনো প্রাণনাশ কিংবা গাছপালা নিধনে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করতেন। বিশেষত: পশুপাখির প্রতি যতœবান থাকতেই তাঁকে বেশির ভাগ সময় দেখা যেতো। প্রাণীজগতের ক্ষেত্রে তার অগাধ ভালবাসা-দয়ার কথা-কাহিনী অনেক শুনা যায়।
স¤্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দিক্ষীত হন এবং তার শাষন-প্রনালীতে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিনি সকল রকম ফাউনা বা পশুপাখির নিরাপত্তার জন্যে আইন বিধান করেন এবং রাজ-শিকার বন্ধ করেন। অশোকই ছিলেন সর্বপ্রথম শাসক যিনি বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন। হাসন রাজাও সবুজ প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণের পক্ষে ছিলেন। সেজন্যে তিনি আর দশজনকে নিয়ে সাধারন সাদামাটা প্রকৃতির মাঝেই থাকতে ভালোবাসতেন। জীবনে তিনি বিশাল জমিদারির দায়িত্ব পালনের পরও পশুপাখির প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে সবুজ গাছপালা সংরক্ষনেও যথেষ্ট নজিরবিহীন উৎসাহ ও কৌতুহল দেখিয়েছেন।
২.
হাসন রাজার পঞ্চাশর্ধো বয়স। বাবার নির্দেশে পুত্র গনিউর রাজা কয়েকটি তালুকের খাজনা আদায়ে তিন দিনের নৌকা সফরে বেরহলেন।
সুনামগঞ্জের সুরমা নদী ভাটি দিয়ে মোহনপুরের জয়নগর বাজার পৌছার আগেই এক তালুকের মড়লের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিরলো। গ্রামের লোক দলে দলে ঘাটে এসে ভিড় জমালো। এক যুবক একটি কুড়াপাখি নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হল। গনিউর রাজা ওই যুবকের পিতাকে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন ‘কুড়াটি কি একদিনের জন্যে ধার নেওয়া যায়? বন্য কোন কুড়া যদি হাওরের মাঝে ভাটির পথে পাওয়া যায়, তাহলে এ দিয়ে কিছু লড়াই করাবার খায়েস হয়েছে। উজান হয়ে ফিরার পথে কুড়াটিকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।’ আফজাল মড়ল উত্তরে জানালো, ‘তার পুত্র এই কুড়াটিকে অত্যন্ত সখ করে লালন পালন করেছে, সে কিছুতেই একে হাতছাড়া করতে রাজী হবে না।’ মোড়লের অপারগতার কথা জানার পর তিনি সেই ঘাটে একমুহূর্ত না থেকে নৌকা ভাসানোর জন্যে মাঝিকে নির্দেশ দিলেন। নৌকা ভাসিয়ে আরও মাইল দুয়েক ভাটিতে যাওয়ার পর তার মন নিরুৎসাহিত হল। মাঝিদের আদেশ দিলেন তারা যেনো নৌকা ঘুরিয়ে নিয়ে উজান বেয়ে বাড়ি ফিরে। তেঘরিয়ার বাড়িতে ফিরে এসে পেয়াদা দিয়ে ঐ মোড়লকে একখানি নোটিস পাঠিয়ে দিলেন এই বলে যে, গত দু’বছরের বকেয়া খাজনাসহ চলতি বছরের খাজনা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে উষুল না করলে অন্যথায় আগামী এক মাসের মধ্যে জমিদার সরকার তাদের জন্যে এই বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করে দখল নেবে।
পরদিন সকালে মোড়ল ভাতিজা ইবদুত তালুকদার ও মোড়লপুত্র হাসন রাজা সাহেবের কাছে এসে হাজির। অন্য সময়ের মত তাদের অভাব অভিযোগ পেশ করে জানায় যে, গনিউর রাজা তাদেরকে উচ্ছেদ করার নোটিস দিয়েছেন। তৎক্ষনাৎ হাসনপুত্র গনিউর রাজাকে ডেকে পাঠালেন এবং মোড়লকে উচ্ছেদের নোটিস দেওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। গনিউর রাজা আবেগস্বরে জানালেন, ‘বারবার অনুরোধ সত্তে¡ও তার ছেলের কুড়াটি যখন একদিনের জন্যেও ধার পাওয়া গেলো না তখন তাদেরকে গত তিন বছরের বকেয়া খাজনা মওকুফ করার অর্থ নেই বলে পরিশোধ করার নোটিস দেওয়া হয়েছে অন্যথায় উচ্ছেদ। হাসন রাজা তার ছেলের এই আবেগের কথা শুনে জানালেন ‘হে ঠিক করেছো, তবে এ-মোড়ল যে এতখানি নিমকহারাম হবে তা কল্পনার অতীত! তাকে আমি যে কতটুকু সাহায্য করেছি তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এরকম একটি কাজ করতে পারলো তা বুঝা কঠিন! যাইহোক এ বিষয়টি আমার কাছে ছেড়ে দাও। দেখি আমি কি করতে পারি।’
ওইদিন বিকালে যখন হাসন রাজা আবারো গনিউর রাজাকে উদাই মড়লের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। সেখানে মোড়লপুত্রের কুড়াসহ মোড়ল ভাতিজা ইমদুত তালুকদারের আনা হলো সঙ্গে কুড়াও। কিছুক্ষনের মধ্যে উদাই মোড়লের বাড়ির পিছনের ছোট পুষ্করিনির দলায় দুটি কুড়াকেই ছেড়ে দেয়ার পর এক মহা লড়াই শুরু হয়। দেখা গেলো মোড়লপুত্রের বড় কুড়াটি হেরে গেলো। বিজয়ী কুড়াটি গনিউর রাজাকে প্রদান করে হাসন রাজা বললেন, ‘গনিউর রাজা এখন মোড়লের এই কুড়াটিকেই তুমি রাখো, তুমি এখন খুশী তো!’ হাসন রাজা তখন মোড়লকে জানালেন ‘ঠিক আছে মোড়ল যাও, বাড়ি যাও। তোমার ভাইকে গিয়ে বলো, তার পুত্রের কুড়াটি কাউকে দেয়ার দরকার নেই এবং তোমাদের বাড়িঘর উচ্ছেদের নোটিস প্রত্যাহার করা হয়েছে।’ গনিউর রাজাও আনন্দমনে সেখান থেকে কুড়াটিকে নিয়ে চলে যান।
জমিদারি করা যে রকম হয়, সে রকমটা হাছন রাজার ক্ষেত্রে ছিলো না । সম্পন্ন জমিদার বলতে আমরা যেমন দেখি, রাশভারি, দাম্ভিক, বদখেয়ালী, উড়নচন্ডী প্রকৃতির মেজাজ সম্পন্ন অহংবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্বÑ কিন্তু হাছন রাজা তার ত্রিসীমানা দিয়ে ঘোরাফেরা করতেন না। জনগণের সঙ্গে, নিজের প্রজাদের সঙ্গে তিনি এমনভাবে মিশে যেতে পারতেন যে সহজেই সবাই তার কাছে ষেঁষতে পারতো। প্রজাদের থেকে তিনি নিজেকে তফাত করে রাখতেন না। পোশাক-আশাক, আচার আচরণে তিনি তাদেরই একজন হয়ে থাকতেন। তার জীবনযাপনও ছিল অতি সাধারণ। প্রজার সুখে সূখী প্রজার দু:খে দুঃখী। তাদের কল্যাণে তিনি নানারকম কার্যক্রম চালাতেন।
১৯৬০/৬৫ সালের দিকে দিলারাম বিবি তখনও হাসন রাজার নাতি বংশের বাড়িঘরে প্রাচীন একজন কর্মচারিনী-রুপে সময় কাটাচ্ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেনÑ ‘একবার বর্ষাকালে মূষলধারে বৃষ্ঠির পর হাসন রাজার প্রশ্ন জাগে আমার প্রজাগন মাটির ঘরে এই বৃষ্ঠির দিনে কি অবস্থায় কাটাচ্ছে?’ দিলারাম জানালেন, ‘সাহেব, লোকের ছনের ঘরগুলো ছুইয়ে পানি পড়ছে আর কষ্টের মধ্যে তাদের পরিবার পরিজনকে সেখানে কাটাতে হচ্ছে।’ আদেশ দিলেন নৌকার একখানা লগগি দিয়ে তার নিজের ঘরের টুল্লিখানা ছিদ্র করে দিতে। হাসন রাজার ছনের ঘর চুইয়ে তার বিছানার উপর পানি পড়তে থাকে। বড় বাঁশের ছাতাখানা তুলে বিছানাকে পানি থেকে রক্ষা করা হয়। পরদিন নিজে লক্ষনশ্রীর প্রজাগনের ঘরগুলা ঘুরে দেখে বুঝলেন তাদের ঘরগুলার আরো করুণ অবস্থা। পানিতে ভিজে সমস্ত ঘরগুলা সপসপা। এর তিনদিন পর লক্ষনশ্রীর প্রজাগণ কাজ শেষে ঘরে ফিরে সবাই দেখতে পেলো তাদের ঘরে নুতন ছাউনি।
হাসন রাজা তার জমিদারী এলাকার আওতায় অসংখ্য দরিদ্র ও অসহায় লোকজনকে জমি ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। হাসন রাজার এই মানবকল্যানমূখী কার্যকলাপ দেখে সিলেটের স্থানীয় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রশংসিত করেন। প্রজাকুল হাসন রাজাকে অফুরন্ত ভালোবাসতো এবং তাদেও জন্যে হাসন রাজার বাড়ি ছিল একান্ত আপনজনের স্থান। সেখানে যাওয়া আসায় তারা অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। হাসন রাজার প্রথম মেয়ে রওশন হোসন বানু তার পুত্র দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কাছে একটি ঘটনা বর্ননা করেন, ‘ছেলেবেলায় তাদের লক্ষণশ্রীর একটা ছোট মেয়েকে চোরেরা চুির করে নিয়ে যায়। ওদের মেয়ে চুরি করার মোটেই উদ্দেশ্য ছিলো না। ঘন বাদলের দিনে ওরা স্থানীয় চোরদের আহŸানে এসেছিলো হবিগঞ্জের মান্দারকান্দি থেকে চুরি করার উদ্দেশ্যে। স্থানীয় চোরেরা এদের পেশাগত খাতির তোয়াজ না করায় এবং চুরির ব্যাপারে কোনো সাহায্য না করায় ওদের ব্যবহারের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরই পাড়ার এক গরীব লোকের ঘর থেকে সে-মেয়েটি চুরি করে নিয়ে যায়। তারপর এক যুগ চলে গেলো। এ দলের সর্দারের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হলো। তার কাচ্চা বাচ্চা হলো। সে-চোরের সর্দার মরে গেলো। সে গায়ের মধ্যে বেশ এক মাতব্বরনি হয়ে দেখা দিলো এবং জন্মভূমির মায়া ভুলতে পারেনি। তাই চুরি হওয়া থেকে দীর্ঘ চার যুগ পর আবার ফিরে এসেছে তার দেশকে দু’নয়ন ভরে দেখবে বলে। প্রথমে দেখা দেওয়ার পর তাকে কেউই চিনতে পারেনি। তারপর ছেলেবেলার সখি সেহেলির সঙ্গে পুরোনো দিনের কথা নিয়ে আলাপ-আলোচনা কালে তখন সকলেই উল্লসিত হয়ে বললে, ‘ও তুই শাহজান’! এসেই সে প্রথমে গেলো সাহেব বাড়িতে (হাসন রাজার বাড়ি)। তারপর গাজীর দরগায়, ফকির বাড়িতে, মোড়ল বাড়িতে। তার ছেলেবেলার সব পরিচিত স্থানে। এতে প্রমাণ হয় হাসন রাজার স্থানটি কত প্রিয় ছিল সাধারণ মানুষের কাছে।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বর্ণিত একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘একবার লক্ষণশ্রী থেকে তার পৈত্রিক নিবাস রামপাশার যাওয়াকালে তিনি এক মহত্বের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেন। রামপাশা লক্ষণশ্রী থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দুরে অবস্থিত। তিনি শীতকালে বা বসন্তকালে লক্ষণশ্রী থেকে রামপাশায় প্রায়ই পালকীতে যাতায়াত করতেন। তার পাল্কি ছিল ছ’ফুট লম্বা এবং তাতে জাজিম ও তাকিয়া থাকতো এবং আট বেহারা পালাক্রমে এ পালকি বহন করতো। এ জন্য তার সঙ্গে থাকতো কুড়ি থেকে পঁচিশজন মালী।
ফাল্গুন মাস, একটু গরম পড়েছে। সকালে লক্ষণশ্রী থেকে রওয়ানা দিয়ে পৌছাবার সময় রামপাশার কাছেই চন্দেরগাঁও পৌছে গেলেন। একটুখানি তৃষ্ণা দেখা দিল। বেহারাকে চন্দেরগাওয়ের সোহাগ রায় চৌধুরীর বাড়ির কাছে পালকী থামাতে আদেশ দেন। পালকী থেকে নেমে চৌধুরী বাড়ির দিকে অগ্রসর হতেই সংবাদ পেয়ে সোহাগ রায় চৌধুরী দৌড়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে স্বাগত সম্ভাষন জানালেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাসন রাজা তাঁকে এক গøাস পানি সরবরাহ করতে বললেন। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা চলে গেল, সোহাগ রায়ের কোনো দেখা নাই। হাসন রাজার মুখে বিরক্তির চিহ্ন। তবু ভদ্রতার খাতিরে কোনো কথা না বলেই বসে রইলেন। ঘন্টা খানেক পরে হন্তদন্ত হয়ে সোহাগ রায় একটা কাচের গøাসে স্ফটিক স্বচ্ছ পানি নিয়ে এসে কৈফিয়তস্বরূপ বললেনÑ ‘বড় দেরি হয়ে গেছে। আমাদের পুকুরের জল খুবই খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমরা পুকুরের জল জ্বাল দিয়ে খাই। তাতে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের গায়ে আর কোনো ভালো পুকুর নেই। গতিকে একটা পিতলের কলসী দিয়ে লোককে আতাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সে সেখান থেকে আসতে দেরি করায় জল দিতে দেরি হলো, বেয়াদবি মাফ করবেন দেওয়ান সাহেব।’ সমস্ত বিবরণ শুনে হাসন রাজা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেনÑ ‘আপনাদের গাঁয়ে আর একটি পুকুরও নেই?’ সোহাগ রায় মাথা নেড়ে জানালেন না; হাসন রাজা বললেনÑ ‘আমি আপনাদের বৈঠকখানায় বসলাম, এই পুকুর আবার কাটিয়ে তার পানি খেয়ে তবেই রামপাশায় যাবো। যাও উদাই রামপাশায় গিয়ে সকল লোককে বল যেন তারা কোদাল, উড়া নিয়ে আসে। মালীরা রামপাশায় চলে যাও। আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা সিধা-কাঠালি পাড়াতে রোজই যাবে। আমার সঙ্গে মুক্তি ও কয়জন লোক থাকবে এবং রামপাশা থেকে রোজই তিন বেলা আমার খানা নিয়ে আসবে।’
পরের দিন এই মজে যাওয়া পুকুরেরর পানি সেচে প্রায় পাঁচশত মানুষ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খননে লিপ্ত হলেন। পরের দিন মাটি কাটার পর হঠাৎ ঈশান কোণে একটু পানির রেখা দেখা দিল। তাড়াতাড়ি সে জায়গাটা আরও গভীর করে দেবার জন্য হাসন রাজা আদেশ দিলেন। একটু পরে স্ফটিক স্বচ্ছ জল উপরে উঠতে লাগলো। সোহাগ রায় তাড়াতাড়ি তার বাগান থেকে বেল, মালতী, জবা ইত্যাদি ফুল এনে পানিতে ঢেলে নিয়ে পুজা সমার্পন করলেন। তিনি এক কলসি জল নিজ হাতে এনে হাসন রাজার জন্য তুলে আনলেন এবং গøাস ভরে তাঁকে পানি খেতে দিলেন। পানি খেয়েই হাসন রাজা বলেন, আমার কাজ শেষ হয়েছে ভাই। এবার আমি রামপাশায় গেলাম।’ জানা যায় এটি শুধুমাত্র সোহাগ রায়ের বাড়ির লোকের সুবিধার্থে হাসন রাজা পুকুরটি খনন করেননি, বরঞ্চ অত্র এলাকার লোকজনের পানি কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে বলেই তিনি দ্রুত এই পুকুরের খনন করিয়েছিলেন।
তার কৈশোর ও যৌবনকাল থেকেই লোকের দৈন্যদশায় তিনি কাতর ও অধীর হয়ে উঠতেন। কৈশোরে যখন গরীব মা বাবার দিগম্বর সন্তান বালক বালিকা তার নজরে পড়তো, তখন তিনি অস্থির হয়ে তাদের মধ্যে নুতন কাপড় ও খাবার বিতরণ করতেন। মুঠি মুঠি কাচা পয়সা, এমনকি গরীব লোকের মাঝে কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সা বিতরণ ও দুস্তদের মধ্যে বসত-বাড়ির জায়গাও দান করতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
হাসন রাজার প্রজা-প্রীতি মনোভাবের মাঝেও সবসময় এক ধরনের উদারতা কাজ করে। এই উদার মনোভাবের কথা প্রত্যক্ষদর্শী, বংশধর ও অন্যান্যদের কাছ থেকে জানা গেছে যে, হাসন রাজা প্রজার সাথে মেলামেশায় খুবই সহজ সরল ছিলেন। তিনি তার বাড়ির সামনের প্রাঙ্গনে বসে নির্দিধায় লোকজনের সাথে কথা বলতেন এবং তাদের খোঁজ নিতেন। তখন তার পরনে থাকতো সহজ পরিচ্ছদ দূতি আর গায়ে একখানা ছাদর। কখনো তিনি মাঠে ঘাসের উপর বসে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। তার এই সহজ সরল জীবন যাপনে প্রজারা মুগ্ধ হতেন।
হাসন রাজা বোধ হয় সেই নীতি অনুসরণ করলেও নিজের জীবনেও নয়টি বিয়ে সম্পর্ক স্থাপনে গিয়ে তিনি উক্ত স্ত্রীগণের পারিবারিক মান-সম্ভ্রম ও ঐতিহ্যের খবরাখবর নিয়েছিলেন। তাছাড়া তার মেয়েদের বিয়ে দেয়ার সময়ও এই নীতি অনুসরণ করেই সুপাত্রে কন্যাদান করেছেন। পুত্রগণের বেলায় হয়তো ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলতে বিষয়টি তার কাছে একটু প্রকট ছিলো বলে মনে হয়। পুত্রদের বিয়ে সম্পর্ক বিষয়ে তিনি সীমিত ভূমিকাই পালন করেছিলেন। বড় ছেলে গনিউর রাজাকে সখ করেই করিমগঞ্জের কর্ণমধুর অত্যন্ত প্রথিতযশা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জুয়াদ আলী চৌধুরীর কন্যা শ্যামা বিবিকে বিয়ে করান। তবে কণ্যা-ভাতিজিদের বেলায়, এমনকি নাতি নাতনিদের বিয়ে ঠিক করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সজাগভাবে সদবংশীয় সুপাত্রের সন্ধান নিতেন।