মানব-প্রেম ও ঈশ্বর-প্রেম এ দু’ই হাসন রাজার মধ্যে ছিলো। মানব প্রেমী, হাসন রাজার মধ্যে কোনো সময়ই মানববিমুখতার লেশমাত্র ছোয়াও ছিলো না। মানুষের মাঝে খুঁজেছেন সৃষ্টির উৎস পরমসত্তা। এই পরমসত্তা সম্পর্কে তিনি স¤পূর্ণ সজাগ ছিলেন বলেই তার মধ্যে কখনও উন্নাসিক মনোভাব আসেনি। দেওয়ান আজরফ-এর মতে, ‘যদিও তার জন্ম আধুনিক যুগেই হয়েছিলো, তবুও তার চরিত্রে ছিলো মধ্যযুগীয় ভাবধারার ছাপ।’ কিন্তু আমাদের এই ব্যাপারটিতে কিছুটা মতান্তর রয়েছে এজন্যে যে মধ্যযুগীয় চারিত্রিক ভাবধারার কারণে তার মুসলিম পূর্ব পুরুষদের ধ্যানধারনা তার মগ্ম চেতনায় ক্রিয়াশীল থাকলেও আদতে ‘হাসন রাজা স্বচ্ছ নির্মল মন, গোড়ামী ও সংকীর্ণতার উর্দ্ধে ছিলো, ধর্মে কর্মে উদারতা ছিলো তার সহজাত বংশগতগুণ।’
বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও সুফি সাধনা-চিন্তা-চেতনা সমন্বিত হাসন রাজার চিত্ত তথা পরম প্রজ্ঞা ‘হাসন জান’ অবলোকন করতে পেরেছে তার পরম স্রষ্টার অস্থিত্বকে, তার সহ-অবস্থানকে। নৃপেন্দ্র লাল দাসের অভিমতে, বাউল, সুফি, বৈষ্ণব আর তান্ত্রিক সমস্ত শিরোপাকে ছিন্ন ভিন্ন করে হাসন রাজাকে একান্তই ‘হাসন রাজা বলে চিহ্নিত করতে হলো।... বাউল ও সুফিমত তার সঙ্গে মিশেছে কবির নিজস্ব চিন্তা আর কবির লোকজ ভাবনা, লগ্ন হয়ে আছে সেই মননে এবং এসবের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে যে মত তাকে বলা যেতে পারে হাসন মতবাদ বা হাসনিক মতবাদ।’
হাসন রাজা উন্নাসিকতা এড়িয়ে প্রেমাস্পদের সাথে, পরম স্বত্ত¡ায় বিলীন হওয়ার সাহসিক ঘোষণা দিয়েছেন। তার পরম পাওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে কিন্তু কোন সময়ই কোন বিশেষ রাজনৈতিক ধর্মীয় মতানুসারী গোষ্ঠী-সচেতন হয়ে অথবা তাদের সন্তুষ্টি অর্জনে কোন ভাবানুভূতি প্রকাশ করতে হবে এ নিয়ে হাসন রাজার কোন মাথা ব্যথা ছিলো না। গভীর অনুরাগের সাথে হাসন রাজা ‘নিখিল বিশ্বে’ সর্বন্তকরণে বিশ্বাস করতেন। অর্থাৎ তার সর্বেশ্বরবাদে প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিলো। তার এই গভীর ভরসা যেমনি আসমানী শক্তিতে, তেমনি তার গভীর আস্থা ও স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো মাটিতে, মানুষের পারস্পরিক অন্ত:সংস্পর্শে। নিখিল-বিশ্ব যেভাবে চালিত হচ্ছে সেই সর্বশক্তিমান সর্ববিরাজমান মূল শক্তি আল্লাহর অমোঘ নির্দেশে সেই পরম-সত্ত¡া যে জীবাত্মাতে ধরা পড়েছে তাও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। এমন বিশ্বই হাসন রাজার মনে ছিলো বলে উভয় মাটি এবং আসমানী বন্ধন আর শক্তিতে তার সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিলো। মাটিতে পেয়েছেন তিনি ঐশী শক্তির সন্ধান আর তাই এখানেই তার নৈতিক ভিত্তি। ব্রহ্মান্ডের পরমসত্ত¡াকে স্বীকার করতে গিয়ে মাটির মানুষকে অস্বীকার করা আর অন্যদিকে মাটির মানুষকে ভালোবেসে কুলে টেনে নিতে গিয়ে বিশ্বব্রহ্মান্ডের ¯্রষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করার ঔদ্ধত্য হাসন রাজার নেই।
‘হাসন রাজার জীবন দর্শনের বিশেষত্ব এখানেই যখন তিনি তার জীবনে দেহের ও মনের সবগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তির মাধ্যমে যে সর্বেস্বরবাদ প্রতিষ্ঠার করার সাধনা করেছেন।’ হাসন প্রানপ্রিয়া বন্ধের কাছে প্রত্যাবর্তন করছেন, মিলিত হচ্ছেন সেই সত্যে এবং সেই সার্থকতাকে তিনি নমাজের মতো ত্যাগ তিতিক্ষার পর যে বেহেস্তের মতো অর্জন, তার ছেয়েও বড় সত্য অর্জন লাভ করতে পেরেছেন। তার ব্যক্তিক ‘আত্মমূখীন সংস্কৃতির সর্বশেষ পর্যায়ে আরোহন করেই’Ñ যে দর্শন ও অভিজ্ঞতার উচ্চানুভূতি তুলে ধরার প্রয়াসেই শুধুমাত্র ব্যস্ত ছিলেন না, মানব জীবনে প্রতিফলিত স্রষ্টার বা পরম স্বত্ত¡ার উপলদ্ধি লাভ করতে পরম নিষ্টার সাথে সচেষ্ট ছিলেন। স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাবার লক্ষ্যে মানবজীবন-বোধ এবং এক সু-উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত সত্যের কথা বার বার বলেছেন। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টি পর¯পর কাছাকাছি টেনে নেবার ঐকান্তিক প্রয়াসমূখীতা ধরা দিয়েছিলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছেও। আর সেজন্যেই রতন রতনকে চিনেছেন। তাই হাসন রাজাও এসেছিলেন গানের ডালি নিয়ে।
হাসন রাজা কষ্মিনকালেও প্রজা অত্যাচার, প্রজা উৎপীড়ন বা জুলুমবাজীর আশ্রয় নেন নি। প্রামাণিক কোনো ভিত্তি বা সত্যতা ছাড়াই হাসন রাজাকে উৎপীড়ক বা জুলুমবাজী হিসাবে দেখার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। কোনো কোনো নাট্যকার কিংবা চলচিত্র নির্মাতা ছবি নির্মাণে কিংবা ব্যবসা করার নিমিত্তে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছেন। তারা হাসন রাজাকে শুধুমাত্র অত্যাচারীই বানাননি, উপরন্তু তারা তার চরিত্রকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ প্রশংসিত হাসন রাজাকে তারা কদাকার মনোভাবে দেখেছেন এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার প্রয়াত লোক-সাহিত্য গবেষক প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত ১৯৭৬ সালে তার ‘গানের রাজা হাসন রাজা’ গ্রন্থে উলেখ করেছেনÑ ‘বাংলাদেশের একজন তরুণ নাট্যকার... কল্পনার রঙ ফলিয়ে এক মুখরোচক নাটক সৃষ্টি করেছেন বলে শুনেছি। তিনি লিখেছেন হাসন রাজা নাকি যৌবনে এত উচ্ছৃংখল ছিলেন যে, সুরমা নদীতে নৌকাযোগে কোনো সুন্দরী নারীর যাতায়াত করার জো ছিল না, হাসন রাজা তাকে জোর করে নিজের হেরেমে নিয়ে আসতেন। একবার এক বোরখা পরা নারীকে জোর করে নিয়ে এসে দেখেন যে, তিনি আর কেউই নন, স্বয়ং তার মা। ইত্যকার ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই হাসন রাজার মনে বৈরাগ্য দেখা দেয়। এইসব চমকপ্রদ ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত হয়ত জমজমাট নাটক রচনার পক্ষে সুলভ উপাদান, তবে তার দ্বারা যদি কোন কল্পিত নায়কের চরিত্র সৃষ্টি করতেন, তাতে কারো কিছু বলার থাকতো না। কিন্তু এইসব কল্পিত ঘটনাকে একটি বাস্তব চরিত্রের উপরে আরোপ করা শালীনতা বা ন্যায়নীতির পরিচায়ক নয়।’
সত্তর দশকের শেষের দিকে এই সস্থা মুখরোচক কল্পিত চরিত্রায়নে হাসন রাজাকে যেভাবে কলুষিত করার অপচেষ্টা চালানো হয় তার জের ধরেই পূনরাবৃর্ত্তি হয় চাষী নজরুল পরিচালিত ‘হাসন রাজা’ চলচ্চিত্রে। যাঁরা হাসন রাজাকে এভাবে অবমূল্যায়ন করেছেন তা জাতির জন্য দৈনতা। হাসন রাজার চরিত্রে লেশমাত্র অবিচার অত্যাচারের গন্ধ ছিলো না। তিনি মানুষের রাজা ছিলেন, মানবপ্রেমি ছিলেন। লন্ডনপ্রবাসী লেখক ভাই ইসহাক কাজল ‘দেওয়ান হাসন রাজা : মরমী কবিকুল শিরোমণি’ নামে এক প্রবন্ধে উলেখ করেছেনÑ ‘অকপট সত্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সাহসের প্রয়োজন হয়। সাহস মানেই হচ্ছে দ্রোহী। হাসন রাজা যে কেবল একজন মরমী কবি ছিলেন না, একজন সমাজদ্রোহী ছিলেন, সে সত্য প্রকাশে অনেকেই নারাজ।’ কলকাতার শিশু সাহিত্য সংসদ প্রা লি: এর প্রকাশিত পঞ্চম প্রকাশ ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ এ যে অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়, তাতে দ্রোহ বলতে অন্যের অনিষ্টচিন্তা বা অনিষ্টাচরণ, উচ্ছৃঙ্খলতা বুঝায় যা আমরা সাধারণ পাঠক তা-ই জানি। সেটি ইসহাক কাজলের সমাজ সাহসের কথা নয় যা তিনি বলার চেষ্টা করেছেন। সাধারণভাবে এ শব্দটি হাসন রাজার ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে তাঁকে হীনভাবে দেখা হবে। ইসহাক কাজলের লেখাটি বেরুনোর পরপরই লন্ডনে অন্ততপক্ষে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রবাসী ‘হাসন রাজা ট্রাষ্ট লন্ডন’ এর কাছে এই শব্দ বা হাসন রাজার ক্ষেত্রে এ ধরনের টাইটেল প্রয়োগের শুদ্ধ ব্যাখ্যার দাবী করেন। তবে ইসহাক কাজল তার লেখায় এও স্বীকার করেছেনÑ ‘একজন পূর্ণাঙ্গ হাসন রাজাকে পেতে হলে তার পুরো জীবনাচরণ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে, হাসন রাজাকে নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ কিংবা লেখাগুলোতে আমরা কেবল খণ্ডিত হাসন রাজাকেই খুঁজে পাই। হাসন রাজা সম্পর্কে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। তিনি পরস্ত্রী ‘কেড়ে’ নিতেন কিনা সে সম্পর্কে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ হাসন রাজা মানুষের কল্যাণ ও পরোপোকারের স্বার্থে প্রেমের জরুরৎ অবস্থার কথা জোর দিয়ে জানিয়েছেন একের জন্যে অন্যের প্রীতি প্রেম, ভালোবাসার একান্ত প্রয়োজন।
হাসন রাজা মানুষের কল্যাণ ও পরোপোকারের স্বার্থে প্রেমের জরুরৎ অবস্থার কথা জোর দিয়ে জানিয়েছেন একের জন্যে অন্যের প্রীতি প্রেম, ভালোবাসার একান্ত প্রয়োজন। তার কৈশোর ও যৌবনকাল থেকেই লোকের দৈন্যদশায় তিনি কাতর ও অধীর হয়ে উঠতেন। কৈশোরে যখন গরীব মা বাবার দিগম্বর সন্তান বালক বালিকা তার নজরে পড়তো, তখন তিনি অস্থির হয়ে তাদের মধ্যে নুতন কাপড় ও খাবার বিতরণ করতেন। মুঠি মুঠি কাচা পয়সা, এমনকি গরীব লোকের মাঝে কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সা বিতরণ ও দুস্তদের মধ্যে বসত-বাড়ির জায়গাও দান করতে দ্বিধাবোধ করতেন না।