সৌন্দর্য্য বোধ

হাসন রাজার মাঝে সৌন্দর্য্যবোধের এক অনুপম রূপ ফুটে উঠেছে তার গানে। রয়েছে আধ্যাত্মিক সুর ও কথার ব্যঞ্জনা। বাস্তবে তার সৌন্দর্যবোধ ধরা পড়েছে জীবনের চলাফেরায়। প্রকৃতি, মানুষ ও হৃদয়ের পরম প্রেম তার সৌন্দর্যের প্রতিফলন। আধ্যাত্মিক সুরে সুললিত হয়েছে রূপ আর অপরূপের অপূর্ব মিলন, আর পরম সত্ত¡ার বিকাশ। কবিগুরু বলেছিলেন‘সৌন্দর্য যেখানেই পরিণতি লাভ করিয়াছে, সেখানেই সে আপনার প্রগলভতা দূর করিয়া দিয়াছে। সেখানেই ফুল আপনার বর্ণ গন্ধের বাহুল্যকে ফলের গূঢ়তর মাধুর্যে পরিণত করিয়াছে; সেই পরিণতিতেই সৌন্দর্যের সহিত মঙ্গল একান্ত হইয়া উঠিয়াছে। সৌন্দর্য ও মঙ্গলের এই সম্মিলন যে দেখিয়াছে সে ভোগবিলাসের সঙ্গে সৌন্দর্যকে কখনোই জড়াইয়া রাখিতে পারে না। তাহার জীবন যাত্রার উপকরণ সাদাসিদা হইয়া থাকে; সেটা সৌন্দর্যবোধের অভাব হইতে হয় না, প্রকর্য হইতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথ তার ‘মহাস¤্রাট অশোক’ প্রবন্ধে সৌন্দর্য্য ও মঙ্গলকর্মের একটি সমন্বয় খুঁজে পেয়েছিলেন। আর সেই সম্মিলনে ধরা দেয় সহজিয়া জীবনযাত্রায়। হাসন রাজার মধ্যেও সেরকম একটি সৌন্দর্যবোধের উন্মেষ দেখা যায় তার অল্প বয়স থেকে। সে সময় তিনি সুনামগঞ্জের অপূর্ব সৌন্দর্য্যরে মাঝে ঘুরে বেড়িয়েছেন নদীনালা খালে বিলে পাহাড়ে জঙ্গলে।

সুরমার জল-শ্রোতের মাঝে, সুনামগঞ্জের অবারিত হাওর-বিলের জলরাশিতে বজরা নিয়ে প্রকৃতি-সৌন্দর্যের মাঝে ঘুরে বেড়ানো ছিল তার শখ। জৌলুস, বিলাসবাহুল্য আর প্রাসাদতুলনীয় আবাস-নিবাস বর্জন করে তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। স¤্রাট অশোকের বেলায় যেমন কবিগুরু যেমনটা বলেছিলেনÑ ‘অশোকের প্রমোদ-উদ্যান কোথায় ছিল? তাহার রাজবাড়ির ভিতরের কোন চিহৃও তো দেখিনা।’ কিন্তু অশোকের রচিত স্তুপ ও স্তম্ভ ব্দ্ধুগয়ায় বোধি-বটমূলের কাছে দাড়িয়ে আছে। তাহার শিল্পকলাও সামান্য নহে। যে পূন্যস্থানে বুদ্ধ মানবের দু:খ নিবৃত্তির পথ আবিষ্কার করিয়াছেন, রাজচক্রবর্তী অশোক সেইখানেই সেই পরম মঙ্গলের স্মরণ ক্ষেত্রেই কলা-সৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।’ তেমনি মানুষের মাঝে, সাদামাটা জীবনের মাঝে সেই সৌন্দর্যকলা খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই হাসন রাজা অনন্ত ঐশ্বর্য্যকে অকাতরে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে অনেকের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তার আত্মার সৌন্দর্য্য ও আধ্যাত্বিক গানের সৃষ্টিতে পেয়েছিলেন প্রশান্তি।