কাজের পড়িসর

হাসন রাজা যেদিন থেকে তার পিতার জমিদারী চালানোর ভার কাঁধে চাপালেন, সেদিন থেকে তিনি এলাকার বিশেষত: লক্ষনশ্রী ও রামপাশায় তথা সুনামগঞ্জ ও বিশ্বনাথ এলাকায় অসংখ্য বিচারকার্যের কর্তব্যও পালন করতে শুরু করেন। তার ন্যায়-বিচার পদ্ধতি এবং ন্যায়পূর্ন-রায়গুলার কথা শুনে দুর-দুরান্ত থেকে দলে দলে লোকজন এসে তার কাছে বিচার আচার চাইতো। একসময় বিচারের সংখ্যা অধিক হওয়াতে হাসন রাজা বিশেষ একদল ন্যায়পরায়ন কর্মচারী নিয়োগ করেন। মারাত্বক ফৌজদারী মামলাগুলো তার কাছে উত্তাপন হলে সেগুলার প্রাথমিক লিখিত জবানবন্ধী নিয়ে স্থানীয় আদালতে সৌপর্দ করা হতো। এমনকি সুনামগঞ্জ কোর্ট ছাড়াও সিলেট জেলা কোর্টে সমজিয়ে দেওয়া হতো এ সমস্ত মামলা। একসময় বিচারের সংখ্যা খুব বেশী বেড়ে যাওয়ায় হাসন রাজা তার কর্মচারীদের দিয়েই এগুলোর বিচার করিয়ে নিতেন। বিচারে কোনো জটিলতা দেখা দিলে সেগুলোর বিচার নিজেই করতেন।

নিম্নে হাসন রাজা কর্তৃক একটি বিচারকার্যের নমুনা দেয়া হলোÑ একবার লক্ষনশ্রীতে হুমান আলী নামে এক গুন্ডাপ্রকৃতির লোক এলাকার দরিদ্র যুবতি মেয়েদের উপর বলাৎকার আচরণ করে। এমনি অবস্থায় হাসন রাজার কাছে অভিযোগ আনা হলো। তখন তাকে নিজেকে সংযত করার নির্দেশ দেন। তাকে জানিয়ে দেয়া হলো যদি এমন কাজে আবার লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আসে, তাহলে তার উপর কঠিন শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। কিছুদিন পর সে এলাকার বাইরের নবাগত খাসিয়া মহিলাকে বলপূর্বক বিয়ে করতে চায়। খাসিয়া পরিবারটি কোনো উপায়ন্ত না দেখে কোন একজন লোকের পরামর্শে অভিযোগটি হাসন রাজার দরবারে পেশ করে। ঢোল পিটানো হলো সমস্ত অঞ্চলজুড়ে যে, শুক্রবার বাদজুম্মা হাসন রাজার দহলিজে একটি গুরুত্বপূর্ন বিচার স¤পন্ন হবে। এইদিন বাদজুম্মা দলে দলে লোকেরা সেখানে এসে উপস্থিত। যখন বিচার বসে, খাসিয়া মহিলা জানালো, হুমান আলীর হাতে সে উক্তত্যের শিকার হয়। সমস্ত সাক্ষ্য ও শুনানীকার্য শেষ হওয়ার পর হাসন রাজা সকলকে উদ্দেশ্য বললেনÑ ‘আমার বিচারের আগে উপস্থিত সবাইকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাইÑ এই খাসিয়া পরিবারের মহিলাটি কি মানবগুষ্টির একজন কিনা? তোমরা তার জবাব দাও।’ সবাই সমস্বরে জানালোÑ ‘সাহেব সে তো আমাদের মত একজন মানুষ।’ সাহেব জানালেনÑ ‘তাহলে এই শহরে সবার মত সেও এইখানে থাকার অধিকার রাখে। আমি তার পরিবারকে এই শহরেই একখানি জায়গা দান করলাম।’ তিনি আরো মজলিসকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘হুমান আলীকে সতর্ক করার পরও যখন মানুষের উপর তার অত্যাচারী অভ্যাস পরিহার করানো গেলো না, এবার সবার সামনে তার একটি শাস্তি হওয়া চাই। তাকে আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে সে তার বাড়িঘর বিক্রি করে সিলেটের কাউকড়াইল গ্রামে চলে যেতে হবে। অন্যথায় জমিদার সরকার তার সমস্ত বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করবে এবং তার বিরোদ্ধে আদালতে চার্জসিট দাখিল করা হবে।’

হাসন রাজা করিৎকর্মা ছিলেন। তার আয়ুর্বেদীক চিকিৎসা জ্ঞানের কথা শুনলে সত্যি শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করতে হয়। হয়তো-বা স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধ থেকেই তার এই আয়ূর্বেদ চিকিৎসার আগ্রহ জন্মে। অন্যদিকে তখনকার সময়ে সুনামগঞ্জে চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারে ছিলো না বললেই চলে। সেইকালে আনাড়ি আন্কুড়ে চন্দ্রকুমারের মত দু’য়েকজন কবিরাজের ওপর সমস্ত অঞ্চলের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নির্ভর করতে হতো। অনেকেই তার কাছ থেকে নানান রোগ সারাবার জন্যে আয়ূর্বেদীক ঔষধ নিতেন। আয়ূর্বেদীক চিকিৎসা বলতে ভেষচ বা উদ্ভিদের মাধ্যমে যে চিকিৎসা দেয়া হয় তাকে বুঝান হয়ে থাকে। এই চিকিৎসা হাজার বছরের পুরাতন। জানা যায়, হাসন রাজা আয়ূর্বেদ জ্ঞান চর্চার উপর একটি বই লিখেছিলেন যা ‘হাছন রাজার হেকিমী চিকিৎসা শাস্ত্র’ নামে পরিচিত ছিলো। সেই বইখানা সার্বিকভাবে নানান আয়ূর্বের্দিক চিকিৎসা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা ও ঔষধের নাম উল্লেখ আছে। হাসন রাজার মৃত্যুর পর তার বড় কন্যা-সন্তান রওশন হোসেন বানু তার নিজের কাছে রেখে দিন সেই বইখানা। দেওয়ান আজরফ জানিয়েছেনÑ ‘তিনি একজন উচ্চ শ্রেণীর হেকিম ছিলেন।’ তবে হাসন রাজার ‘২নং পান্ডুলিপি রঙ্গীন গানের বই’ নামে যে বইখানা বর্তমান গ্রন্থকারের হাতে পৌছেছে বলে তার কয়েকটি পাতায় এই হেকিমি বনাজি ঔষধ সম্পর্কেও কিছু তথ্যাদি এবং তাতে হাসন রাজার এই বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ এবং চিকিৎসা-চর্চার কথা সহজেই জানা যায়। এখানে অনেকগুলো বনাজি ঔষধের নাম উল্লেখ আছে।

কয়াফফা জ্ঞান-সাস্ত্রে হাসন রাজার ভূৎপত্তি ছিল। তার এই জ্ঞান প্রয়োগ করে তিনি বহু বিচার আচার কার্যও সহজে সমাধা করতে পারতেন। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা হাসন রাজার মানব চরিত্র পঠনে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে। এই শাস্ত্রজ্ঞান তিনি কোথা থেকে আরদ্ধ করেছেন তা সঠিক করে বলা কঠিন। অনুমান করা হয় তার শতস্ফুর্ত মানসিক পর্যায় উন্নত পর্যায়ে পৌছেছিলো বলে আপন গুণে এই জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তবে বর্তমান দুনিয়াতে এই শাস্ত্রজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিমূলক কোন জ্ঞান হিসেবে ধরা হয় না। ভিক্টোরিয়ান আমলে এই জ্ঞানের বেশ কদর ছিল এবং পরে উনিশ

আজরফ সাহেব জানিয়েছেনÑ ‘হেকিমী চিকিৎসা শাস্ত্রে জ্ঞান ব্যতীত তিনি ছিলেন কেয়াফফা তে বিশেষ জ্ঞানী। মানুষের মুখের গঠন, নাক, মুখ চোখ প্রভৃতি দেখে তার চরিত্র সম্বন্ধে সঠিক ধারনা করতে পারতেন। তার কেয়াফফা শাস্ত্রের জ্ঞানের ফল সৌখিন বাহার পুস্তিকার নারী চরিত্রের বর্ননায় পাওয়া যায়।’

তার এই জ্ঞান দিয়ে তিনি শুধু মানুষকেই বিশ্লেষণ করতে পারতেন না, তিনি দুয়েল পাখি, কুড়া, ঘোড়া, হাতি প্রভৃতি পশু পাখিকেও সহজে বিশ্লেষন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতাকে তিনি সৌখিন বাহার পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন। এক্ষেত্রে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেব উল্লেখ করেছেন : ‘তার জীবনী আলোচনা করলে মনে হয় হাসন রাজা নামে কোন এক ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন অসংখ্য ব্যক্তির সমষ্টি। ইংরেজীতে তাকে বলে গঁষঃরঢ়ষব চবৎংড়হধষরঃু....তবে তার সত্ত¡ায় একজন সৌখিন জমিদার, একজন দাতা ও দয়ালু ব্যক্তি, একজন কবি ও একজন দার্শনিক এমনভাবে মিশে রয়েছিল যে তার এক রূপের প্রকাশের পরে অন্য রূপের প্রকাশে সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হতে হয়।’এ প্রসঙ্গে একটি শ্রæত কাহিনী থেকে হাসন রাজার উপরের বৈশিষ্ট্যের কিছু পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়।

হাসন রাজার ভ্রাতুস্পুত্র আজিজুর রাজার কাছ থেকে সংগৃহিত তার পৌত্র দেওয়ান আলমনুর রাজা ঘটনাটি এরকম বর্ণনা করেছেনÑ ‘একবার এক জেলখাটা চোর এসে হাসন রাজার কাছ ভিড়লো। হাসন রাজা তার মুখের দিকে তাকালেন এবং তার চেহারা ছবির একটা নমুনা পেয়ে তিনি তৎক্ষনাৎ তার লোকজনকে ডেকে নিয়ে আদেশ করলেন ‘তাকে দু‘মুঠো খাইয়ে ছয়টি টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও। আশ্চর্য হয়ে তার নায়েব মশাই রাজা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ চোরকে এতো দয়া দেখানোর জন্য তিনি বিগলিত হলেন কেন?’