পর্যটন

মরমি দর্শনে হাসন রাজার বিচরণ বলতে মূলত তার নৈসর্গিক এক পর্যটকের পরিক্রমণকেই বুঝায়। সেই পর্যটনে তার ভিতর-বাহির বিচরণ করে রঙ্গের মানুষকে খোঁজে দেখার যেনো অন্তহীন এক প্রয়াস। প্রিয়ার জন্যে তিনি পাগল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জীবনভর। রাতভর জেগে তার এই দেখা পাওয়ার আশায় তিনি প্রার্থনায় রত হলেন আর সেক্ষেত্রে তিনি মুসলিম সমাজের সকল প্রচলিত রীতি পরিত্যাগ করে, এ বিশ্ব সংসারকে একটি বিস্তৃত মহাসাগর রূপে নিজের চোখে অঙ্কিত করেছেন। হাসন রাজা নিজেকে এ সংসারে একজন পর্যটক হিসেবে ধারণা করেছেন। এ পর্যটক আবার নানা অভিজ্ঞতা লাভে ব্যস্ত। তিনি স্বদেশে ফিরে যেতে চান। তবে তার সম্মুখে রয়েছে এক বিরাট নদী। এ নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম একখানা নৌকা এবং তার মাঝি ‘গফুর'-অর-রহিম। প্রথমে খেয়ানীর নির্দয়তা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে তিনি ভয়ে কাঁপতে থাকেন। অতি সহজেই খেয়ানীর সহানুভূতিপূর্ণ বদনমন্ডল আর তার কোমল হৃদয়ের আভাস পেয়ে তিনি উল­সিত হয়ে বলেন ‘খেওয়ানীর মুখ দেখিয়া মনে হইছে আশা।’ তবে এ পথের পথিকের নিকট মাত্র একটি লক্ষ্য একটি বাসনাই বর্তমান। এ এমনই স্পষ্টই যে তিনি অস্থিরতায় কাতর হয়ে পড়েছেন। তিনি অপ্রকৃতিস্থ। একটি ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এত পরিক্রমণের পর যখন দেখা গেলো হাসন রাজা যেনো এক সর্বেশ্বরবাদের দ্বারে এসে উপস্থিত হলেন। এবং পরিচয় মিললো যে তার এই সর্বেশ্বরবাদিতা একটু ভিন্নতর, যেখানে কপটতা ও ভন্ডামীর উপস্থিতি একবোরেই অসহণীয়।

ছোটবেলা থেকেই হাসন রাজার ঘুরে বেড়ানোর একটা অদম্য কৌতুহল ও আগ্রহ ছিল। এ প্রসঙ্গে প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেনÑ ‘যে সমাজে যে পরিবেশে ও যে নৈসর্গিক ভূখন্ডের বৈচিত্র্যলীলার রাজ্যে তিনি জন্মেছিলেন, তাদের প্রতি তার নাড়ির টান ছিল। সিলেটের নদী-নালায়, খাল-বিলে, হাওরে, পাহাড়ে, গ্রামাঞ্চলে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়ে মন-প্রাণকে যেন সজীব সতেজ করে আনার জন্য তিনি নিয়মিত পর্যটনে বেরুতেন’ । সুরমা নদী ছিল তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। এই সুরমার বুকে হাসন রাজা কত যে জল-সিক্ত হয়েছেন, আর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের কলোধ্বনিতে কত যে তার ভাবে কৃষ্ণ-রাধার লীলাখেলা চলেছে সেকি আন্দাজ করার মত? ‘সুরমা নদী দিয়ে তিনি চলেছেন তার রংয়ের পানসী ভাসিয়ে গান হচ্ছে।’ এবং নদীর কলোধ্বনির সাথে গানের তালের জুড়া মিলিয়ে সুরসায়রে ডুব দেয়া হয়েছে। মুজতবা আলী হাসন রাজার রসবোধের কথাটি বলতে গিয়ে, আমাদেরকে শুনিয়েছেন যে তার ভাওয়ালি বজরা নৌকা চড়ে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সখটিও ছিলো অতিমাত্রায়। তিনি জানান, ‘আসলে হাসন রাজার ডাঙ্গায় বড় একটা থাকতেন না। তিনি বাস করতেন তার বিরাট ভাওয়ালি নৌকায়। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সে নৌকা উজান ভাটি করতো। সে নৌকা আলোকোজ্জ্বল এবং তার পাড় পর্যন্ত ভেসে আসতো সুমধুর সঙ্গীত।’ সুরমার জলে গান আর নৃত্যে ভরপুর সেই আলোকজ্জল ভাওয়ালি বজরা অপূর্ব হয়ে উঠতো রাতের আঁধারে।

শোনা যায় কোনো-কোনো সময় জোৎস্নার রাত্রিতেও বজরা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে খুবই ভালোবাসতেন তিনি। এই জোৎসনা রাতের বজরাতে হাসন রাজার কত যে গানের আসর চলতো তার ইয়ত্তা ছিল না। সুনামগঞ্জ শহর তখনকার সময়ের লক্ষণশ্রী পরগনার একাংশ একটি দ্বীপের মত ছিল। চারদিকে তার হাওর, বিলঝিল আর নদী নিয়ে অপূর্ব হয়ে উঠতো প্রতিটি জোৎ¯œা রাত। হাসন রাজার সময় তো কোনো বিদ্যুতের সুযোগ ছিল না। জোছনা রাতে হাসন রাজা তার বাড়ির সাথে উত্তরদিকে প্রবাহমান সুরমার জলের শ্রোতে ঝলমলে রূপের খেলা দেখতেন।

সুনামগঞ্জের এই অপরূপ রাতগুলোকে নিয়ে হাসন রাজার এই সৌন্দর্যবোধকে কালজয়ী করে রাখার লক্ষ্যেই পরবর্তীকালে সুনামগঞ্জের জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি তারই প্রপৌত্র মমিনুল মউজদীন অভিনব এক উদ্যোগ নেন। এই জোৎ¯œার রাতগুলোকে ধরে রাখার জন্যে সারা শহরবাসীকে নিয়ে তিনি জোৎ¯œা-রাত উদযাপন করতেন। জ্যোৎ¯œা রাতে সারা শহরের বিদুৎ-এর আলো নিভিয়ে দেওয়া হতো। আর তার সাথে আবার বিদ্যুৎ-সাশ্রয় ঘটতো। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ১৪ বছরের জনপ্রতিনিধিত্বকালে এই চর্চার মধ্য দিয়েই মমিনুল মউজদীন এই জ্যোৎস্না রাত উদযাপন করতেন। এই জনপ্রতিনিধি জীবদ্বশায় মূল স্বপ্ন ছিল সারা বাংলাদেশের প্রতিটি মফস্বল শহরে এই চর্চা ছড়িয়ে দেওয়া।

আসা যাক হাসন রাজার বজরার কথায়। হাসন রাজার বজরা নৌকা বা হাউস বোট ছিলো। অনেক কক্ষবিশিষ্ট বজরা ছিল এক একটি ভাসমান বাড়ি। সেখানে যেমনি ছিলো গানের জলসা ঘর, তেমনি ছিলো হাসন রাজা ও তার স্ত্রীদের জন্যে দু’টি স্বয়নকক্ষ, বাবুর্চিখানা, পরিচারক-পরিচারিকাদের জন্যে সতন্ত্র কক্ষ। সেই আমলে এই নৌকায় গোসলখানা ও শৌচখানা ছিলো। শেষ বয়সে এই শখের বজরাখানি তার দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান হাসিনুর রাজাকে দান করেছিলেন। বজরা নৌকার প্রতি হাসিনুর রাজার প্রবল আকর্ষণ ছিল। তিনি বহুদিন বাবার মত এই বজরাখানি ব্যবহার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে শ্রীআইলের চৌধুরী পরিবারের কাছে বজরাখানি বিক্রি করেছিলেন। দেওয়ান আলমনুর রাজা জানান, ১৯৫৫ সালে তার যৌবনকালে এই বজরাখানি একবার চড়ার সুযোগ হয়। তখন অবশ্য এই ভাসমান হাউস বজরা ছিল শ্রীআইলের চৌধুরীদের মালিকানায়। তাতে স্থানীয় বাসিন্দারাও নদী পার হতো।

হাসন রাজার সময়কার কিছু দলিল লেখক, কর্মচারী এবং তার জেষ্ঠ্য পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার লেখা থেকে পাওয়া যায় যে, হাসন রাজা মূলত: একজন ভ্রমণবিলাসী জমিদার ছিলেন। মূলত তার অনুসন্ধিৎসু মনের কারণেই হাসন রাজা ছিলেন একজন সচেতন পর্যটক। ছেলেবেলায় যেমন পাখির পিছন পিছন ঘুরে বেড়িয়েছেন খরছার হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়, কাঙলার হাওড়, দেখার হাওড়, ঝাওয়ার হাওর কিংবা লাইয়া, গুজারিয়া বিল, ক্ষিরা বিল, কুইয়া বিল, চন্দার বিল, দেওলা বিল, বাওন বিল, রওয়া বিল, রক্তি নদী প্রভৃতি, ঠিক তেমনি প্রসারিত দৃষ্টি নিয়ে বরাক নদীর উৎস থেকে প্রবাহিত হয়ে সুরমা-কুশিয়ারা বিভক্তিতে করীমগঞ্জ এলাকায়, আজমিরিগঞ্জ পার হয়ে মেঘনার উপত্যাকায় কিংবা গোয়ালন্দ পর্যন্তও নৌকাপথে যেতে তিনি কসুর করেননি।

দেওয়ান আজরফ জানিয়েছেনÑ ‘বর্ষাকালে কোড়া শিকারে তিনি ব্যাপকহারে দেশী ভাওয়ালী, পানসি ও অন্যান্য খোলা নৌকাসহ এক বিরাট জলীয় কাফেলা গঠন করে সুদুর করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর পর্য্যন্ত এবং পশ্চিমদিকে ময়মনসিংহের নেত্রকোনা মহকুমার শেষ সীমা পর্য্যন্ত জল-বিহার করতেন।’ বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশ ঘুরতেও হাসন রাজার সুযোগ হয়েছিল। গনিউর রাজার তথ্যকথায় জানা যায় যে, ১৮৯১/৯২ থেকে শুরু করে ১৮৯৭/৯৮ সাল পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা এবং কলকাতায় একাধিকবার যাতায়াতের সুযোগ হয়েছিলো। সম্ভবত ১৮৯১/৯২ সালে হাসন রাজা কলিকাতা ভ্রমণে গিয়ে আলীপুর এলাকায় ইংরেজদের কর্তৃক নির্মিত চিড়িয়াখানা দেখতে যান। এই চিড়িয়াখানায় নানান জাতের প্রাণী পাখি দেখে হাসন রাজা বেশ চমকে উঠেছিলেন। দুনিয়ার সকল প্রাণীসকল একত্রে যেনো জড়ো করে এই চিড়িয়াখানায় আটকে রাখা হয়েছে। চিরদিন দেখেছেন খোলা আকাশের নীচে এসব পাখি প্রাণী মুক্ত স্বাধীন হয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। আলিপুরের এই চিড়িয়খানা দেখে হাসন রাজার মাঝে এক ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়, তিনি বিচলিত হন। গনিউর রাজার তথ্যভান্ডারে উল্লেখিত তার এক ভক্তের কাছ থেকে জানা যায়, ‘কলকাতার আলীপুরের পাখিদের দশা দেখলে বুকটা আমার ধরফরাইয়া উঠে। আমাদের এই মাটির পিঞ্জিরার মাঝেই তো কত কষ্ট।’

গনিউর রাজার ভ্রমণ রোজনামচায় তিনি হাসন রাজার ভ্রমণের কথা বলতে গিয়ে একটি তথ্য দিয়েছেন যেÑ যখন ১৩০৫ বাংলার ফাল্গুন কি চৈত্র মাস। ঢাকা সফরে ছিলেন গনিউর রাজা তখন বঙ্কবিহারী নামে ঢাকার এক দোকানদারের কাছ থেকে হাসন রাজার ঢাকা সফরের খবর পাওয়া যায়। গনিউর রাজা নিরাপত্তাজনিত কারণে তার প্রায় আড়াই শত টাকা ঢাকার এই বিশ্বস্থ দোকানকদার বঙ্কবিহারীর দোকানে জমা রাখেন এই উদ্দেশ্যে যাতে ঐ টাকা হতে সময় সময় কিছু কিছু করে নিজ হাতে নিয়ে খরচ করবেন। যখন দেখা গেলো এই টাকার প্রচুর পরিমাণ সময় সময় তার হাতে নিয়ে তিনি বেহিসাবী হয়ে উঠেন এবং যেমনি তেমনি খরচ করতে শুরু করেছেন তখন বঙ্কবিহারী ২৫ বছরের যুবক গনিউর রাজাকে তার পিতা হাসন রাজার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তার কথায়Ñ ‘আপনার বাবা হাসন রাজা সাহেবও ভ্রমণে খুব সৌখিন জমিদার। তিনি যখন এই গেলো-বছর এবং বছর দশেক আগে ঢাকায় আসিয়াছিলেন, তখন এই চৌকবন্দরের উত্তরদিকস্থ ঐ দুইতলা বাড়িটি তিনি ভাড়া নিয়াছিলেন, আমার মনে আছে, আপনার বাবার তো কোনো আজে-বাজে খরচই ছিলো না, বরঞ্চ সেই সময় তিনি আমার (বঙ্কবিহারীর) দোকান হইতে বহুতর জিনিস, জরীর কাপড় ইত্যাদি বাড়ির জন্যে ক্রয় করিয়া নিয়া গিয়াছিলেন। তখন তাঁহাকে মনে হইল, তিনি বড় একজন সদাশয় পুরুষ। তাঁহাকে ভুলা যায় না।’ (গনিউর রাজা, রোজনামচা)

১৯১১ সালে নভেম্বর মাসে তিনি দিলি­র এক দরবারে হাজির হওয়ার জন্য বিশেষ একটি দাওয়াত পেয়ে দিলি­ সফরে রওয়ানা দিতে উদ্যোগ নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিলি­র অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যাওয়ায় সেই সফরটি আর তার হয়ে উঠেনি। অবশ্যি হাসন রাজা মোগলদের রাজধানী দিল্লী প্রায় কয়েকবছর আগে একবার সফর করেছিলেন। তাই ১৯১১ সালে কলকাতা পর্যন্তই সফরটি সীমিত রাখেন। জানা যায় কলকাতায় হাসন রাজার জীবনের শেষ সফরটি ছিল ১৯১৪ সালে। কোর্টে মামলা জনিত কারণে তার এই সফর অল্প দিনের জন্যে ছিল। ঢাকায় শেষবারের মত সফর করেন ১৯১৬ সালে। তখন ঢাকার অবস্থা তেমন ভালো নয়। রাজনৈতিক উত্তেজনায় ভরপুর ঢাকা শহর। অনুমান করা যায় সে সময় মরমি সাধক হাসন রাজা দুনিয়ার এই ঝামেলা জটিলতা থেকে হয়তো নিজেকে দূরেই সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে গনিউর রাজার স্মৃতিতথ্যে তার ঢাকা বা বড় শহর ঘুরে ফিরার একটি চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মমত নির্বিশেষে হাসন রাজার অনুসন্ধিসু মন আর আগ্রহের কারণে তিনি নানান ধর্ম উপাসনালয়গুলো দেখে নেওয়ার সুযোগ নিতেন। গনিউর রাজা আরও উল্লেখ করে বলেন যে, ১৮৯৪/৯৫ সালের দিকে যখন ঘোড় দৌড় উপলক্ষে ঢাকায় হাসন রাজা সাহেব আসেন তখন তিনি রেসকোর্স ময়দানের পার্শবর্তী কালীবাড়ি মন্দিরটি পরিদর্শন করতে ভুলেননি।

ইষ্ট ইন্ডিয়া ক¤পানীর আমল থেকে শুরু করে বহু বছর যাবৎ বড়লাটের এজেন্ট চেরাপুঞ্জি থেকে আসাম শাসন করতেন। ১৮৬৪ সালে শিলং শহরে আসামের রাজধানী স্থাপিত হয়। তার কয়েক বছর পর ১৮৮৪ সনে হাসন রাজা চেরাপুঞ্জি গিয়াছিলেন বলে গনিউর রাজার ‘তথ্যকথা’ থেকে জানা যায়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। সাথে আরপিন নগর নিবাসী কাদির বক্স মিয়া সঙ্গী ছিলেন। এতখানি সাহসী উদ্যোমী হাসন রাজা শুধুমাত্র পর্যটনমূখীই ছিলেন না, তার সাথে তার মধ্যে ছিলো উন্নয়নকামী চিন্তার তাড়না। চেরাপুঞ্জি শুধুমাত্র পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বৃষ্টি হওয়ার দেশই নয়, এখানকার আরেকটি বিষয় হাসন রাজার চোখ এড়াতে পারেনি। এক হাতি খেদায় বের হয়ে চেরাপুঞ্জিতে বনাঞ্চলের বিরাটকার গাছগুলো দেখে তিনি কাদির বক্সকে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ ‘কাদির রে, কোথাও এরকম বিরাট বিরাট গাছ তো আর কোনদিন দেখিনি? আমি যদি সুনামগঞ্জে এই গাছগুলো পাইতাম তাইলে সুরমা নদীর উপর একটি পারাপার ব্রিজ বানিয়ে দিতাম সহজে?’ (গনিউর রাজা, তথ্যকথা)

কাদির বক্সের কাছে সেদিন হাস্যচ্ছোলে যে কথা হাসন রাজা উঠিয়েছিলেন তা হয়তো তখনকার দিনের জন্যে সুনামগঞ্জের মত পশ্চাদপদ এলাকায় নদীর ওপর একখানি ব্রিজ তৈরি অবাস্তব একটি কল্পনা ছিলোমাত্র, তা একেবারেই যে অসম্ভব তা আজ আর কিন্তু নয়। সুনামগঞ্জের সুরমার এপার ওপার চলাচল সহজ করে তোলা অবশ্যই সম্ভব। আজ থেকে ১২৮ বছর আগে হাসন রাজার যে উন্নয়নকামী চিন্তা, সেটি এই এলাকার জনগণের বহুদিনের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তীকালে। ওই সময় চেরাপুঞ্জি থেকে ফিরার পথে মুসমাই, মহাদেব বাজার এবং মহাদেব টিলা পার হয়ে আসছিলেন। তখন ঐখানে এক খাসিয়া পরিবারের বাড়িতে পদার্পন করলেন। পথিমধ্যে এরকম হঠাৎ করে উপজাতীর ঘরে উঠার একটি তাৎপর্য্য ছিলো সেদিন। ঐ ঘরে বাস করতো এক বৃদ্ধা। তার সাথে যে হাসন রাজার আপনজনের মতো কথাবার্তা হয়েছিলো তার কিছুটা খবর পাওয়া যায় গনিউর রাজার ভ্রমণকাহিনী রোজনামচা থেকে। হাসন রাজার মৃত্যুর এক বছর পর খাসিয়া বুড়ি গনিউর রাজার কাছে স্মৃতিচারণ করছেÑ “বড় সাহেব কুড়া শিকারে আসলে আমাকে সবসময়ই টাকা দিয়ে যেতেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ও বলতেন ‘ও বুড়ি তুই আমার ভাই সাহেবের বিবাহ দেখিয়াছিস? যখন আমার ভাইসাহেব চৌদলের উপরে বাইজি নাচাইয়া নাচাইয়া দরগামহল্লা সাদি করেন, তখন এ বুড়ি তুই কত বড় ছিলে?’ আমি বলতাম, ‘আমি প্রায় ১০/১২ বছরের ছিলাম, আমার বেশ মনে আছেÑ ঐ সময় লেনে সিপাহিগনের সহিত গুলমাল হইয়াছিল।’

হাসন রাজা আর এই বুড়ির কথোপকথন থেকে যেমনি একটি আন্তরিকতার স্পর্শ পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি ইতিহাসের পাতার সামান্যকিছু হলেও অনন্য এমন একটি আলোকপাত পাওয়া যায় তাতে সিলেট শহরের বুকে তখন ইংরেজ শাষণের হট্টোগোলপূর্ণ একটি প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। বুড়ির সাথে কথাবার্তার পর উঠে পড়লেন তার ফের অভিযাত্রায়। মহাদেবের টিলা পাড় হয়ে খবর পাঠানো হয় যাতে ভোলাগঞ্জে যেনো একটি পানসি নৌকা প্রস্তুত করে রাখা হয় এবং সেখান থেকে ছাতক গিয়ে স্টিমার চড়ে সুনামগঞ্জ পৌছান হয়।

আজকাল যেখানটিতে সুনামগঞ্জ শহরের ‘ট্রাফিক পয়েন্ট’ (ঔঁহপঃরড়হ) বলা হয়, সেখানে এসে দাঁড়িয়ে হাসন রাজা একটু হাফ ছাড়তেন কিছুক্ষণের জন্যে। সেটি বিকালবেলায় শহর জুড়ে পদচারনার কথা। পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মত এই অবস্থানে অনেকে এগিয়ে এসে হাসন রাজার সাথে কুশল বিনিময় করতেন। যারা সাধারণ প্রজা অতি খুশীমনে কাছ থেকে সাহেবকে সালাম জানানোর সুযোগ পেতো। এই পয়েন্টের কাছাকাছি কোন এক জায়গায় রাধা গোবিন্দ দাসের ভাগীরথী ভান্ডার দোকানটি ছিল। তার সামনে দাড়িয়ে হাসন রাজা চলতে চলতে বলে গেলেন ‘গোবিন্দ বেশি করে কিছু তেজপাতা, কিসমিস আর ময়দা পাঠিয়ে দিও, বাড়িতে তুষার সির্ন্নি’র আয়োজন হচ্ছে’।

পশ্চিম বাজার অভিমূখে কখন যে হাটতে হাটতে মধ্যবাজারে মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী পুষ্পরাজের দোকানের সামনে এসে পৌছেছেন তার কোনো খেয়ালও থাকতো না। তখন হয়তো একটু দাঁড়িয়ে হাসন রাজা বলে দিলেন ‘পুষ্পরাজ-ঝি, একশ ধুতি হামারা ঘরমে বেজ দেও।’ অথবা পশ্চিম বাজারের ঠিক আগ মুহূর্তে থেমে ঢাকা নিবাসী সুনামগঞ্জের আব্বাস খলিফা ও তমিজ উদ্দিন খলিফার ভ্রাতৃদ্বয়ের দোকানের সামনে এসে বললেন ‘তমিজ আমার জন্যে কতকটা আতরের শিষি উদাই এসে নিয়ে যাবে’। পথিমধ্যে হয়তো একজন হত-দরিদ্র লোক সাহেবকে তার নিজের অসহায় অবস্থাটির কথাটি জানালো, আর অমনি দয়ালু হাসন রাজা থেকে কিছু একটা পয়সা কড়ি, কিংবা জায়গা জমি চাষবাসের সুবিধা আদায় করে নিয়ে গেলো। এমনি করে আরো কত মানুষ জনের সাথে হাসন রাজার অসংখ্যবার সাক্ষাৎ আর কথোপকথন হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এরকম ধরনই ছিলো হাসন রাজার বৈকালিক ভ্রমনের রূপটি। একদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো, হাটতে হাটতে বিকালের ভ্রমন সান্ধ্যভ্রমনে রূপ নেয়। হাসন রাজা পশ্চিম বাজারে ঠিক পশ্চিম প্রান্তে এসে হঠাৎ করে থেমে গেলেন এবং তার বা পাশের থেকে অর্থাৎ বাজারের ঠিক দক্ষিন পাশ থেকে এক অদ্ভূত সুরের মূর্চ্ছনা তাঁর কানে বাজলো। করিম বকসকে জিজ্ঞেস করলেন ‘এ আবার কোন জাতীয় গান?’ করিম বকসের অবশ্যি কলিকাতায় এ জাতীয় গান অনেকবারের শুনা। সে জানালো, সাহেব ওরা হিন্দুস্থানী রাজ মিস্ত্রি হিন্দুস্থানী গাড়োয়ানদের সুরে ভজন গানে গাচ্ছে। সুনাজানের গানের কথাটি যথার্থই ছিলো

যেইখানে শুনিলা গীত, সেইখানে গমন।

যেখানে হাসন রাজা ফিরছেন সেখানেই তার সুর আর গানের মন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সুদুরপ্রসারী এক সুরের ফল্গুধারা যেনো থেমে নেই। তাঁর প্রিয়তমা খোঁজতে যেনো অস্থির এই সুর আর লয় তাঁর নানান জায়গায় বেড়ানোর মধ্যেই প্রবাহমান ছিলো।

‘সুনামগঞ্জের আধা-গ্রাম শহরে তখন গাড়িঘোড়া যানবহন বলতে কিছুই ছিল না, সকলকেই যাতায়াত করতে হত পদব্রজে। শুধু দিনের বেলায় মেয়েদের আব্রæ বাঁচিয়ে চলার জন্য ছিল গুটিকয়েক ডুলি। সাইকেল তখন আবিস্কৃত হয়ে থাকলেও সুনামগঞ্জে আমদানি হয় নি, মোটর ত স্বপ্ন ।’ হাসন রাজার বাড়ি থেকে একটি রাস্তা দক্ষিণ পূর্বদিকে চলে গিয়ে সিলেট সুনামগঞ্জ প্রধান সড়কে মিলিত হয়েছে। অন্যদিকে এই রাস্তারই অন্য মাথা উত্তর পূর্বদিক হয়ে নদীর পাশ ঘেঁষে সুনামগঞ্জ বাজার এলাকায় গিয়ে মিশে গেছে। প্রায়ই বিকেল বেলায় হাসন রাজা ঘুরতে বেরুতেন তখনকার সময়ের শহরের ছোট রাস্তাগুলো ধরে। বয়স তখন পঞ্চাশর্দ্ধো। বাড়ি থেকে রওনা দিতেন উত্তর দক্ষিণ সড়ক ধরে। এই অপরাহ্ন বেলার ছোট ছোট ভ্রমণে তখন যেনো এক অভিযাত্রী দলের মত এক একটি চিরাচরিত কার্যক্রম থাকতো সঙ্গে এক দল সাঙ্গপাঙ্গ, কেউ ছাতা হাতে, কেউবা পিকদান ধরে আবার কারো হাতে পানদানি। অবিরাম পান খাচ্ছেন হাসন রাজা। পরনে সাদামাটা হাতাওয়ালা গেঞ্জি, তার উপর একখানা আধপৌরে শাল, আর লুঙ্গির মতো করে পেছিয়ে পরা ধুতি থাকতো। ভ্রæক্ষেপ নেই শহরবাসীর কৌতুহলী দৃষ্টিতে। সামনে পড়া লোকজনের কুশল জ্ঞাপনে দ্বিধাহীন উত্তর যেন তার প্রাত্যাহিক জীবনের একটি অংশ ছিল।

শহরের মধ্যখানে গৌরা-রঙ্গের জমিদার নগেন্দ্রকুমার চৌধুরীর একখানি আবাসস্থল ছিল। কোন এক বিকেলে হয়তো হাসন রাজা তার সেই আবাসের সামনে একটু থেমে গিয়ে ভরাট গলায় হাঁক দিলেন ’রাসগোবিন, বাড়িত আছ নিবা?’ বৈকালিক এই ভ্রমণে ওই জমিদারও একেক সময় হাসন রাজার সঙ্গ নিতেন আগ্রহভরে। কোনো সময় হয়তো জুবিলী হাই স্কুলের সম্মূখ ধরে মুশারফ আলী মুক্তার সাহেবের বাসা (বর্তমান আলীমাবাগ) পর্যন্ত পৌছতেন। শহরের বাজার এলাকা থেকে শুরু করে ষোলঘর পর্যন্ত যে লোকেদের বসবাস ছিল সেটিই তখনকার সময়ের সুনামগঞ্জ শহরের জনবসতির একটি সরলরেখা বলা যায়। এর প্রধান কারণ হলো সুরমা নদী বরাবর মানুষের বসবাসের প্রবনতা। অবশ্য এই রাস্তাটি কোর্ট কিংবা জুবিলী হাইস্কুল পর্যন্তই বেশ কিছুটা ছোট পাথর আর বালু দ্বারা মুড়া ছিল। এই রাস্তাটি সুনামগঞ্জে সরকারিভাবে স্বীকৃত প্রথম রাস্তা যা তখনকার ব্রিটিশ শাষকেরা হাসন রাজার অবদান স্বীকৃতিতে রাস্তাটির নাম দিয়েছিল ‘দেওয়ান সাহেব রোড’ নামে।

‘দেওয়ান বাড়ির ইতিহাস’ থেকে জানা গিয়েছে যে, শহরের কোনো কোনো স্থানে তিনি ভদ্রলোকের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এজন্যে ভদ্রলোকগণকে আবাস গড়ার জন্যে উৎসাহিত করে অনেক জমিও দান করেন। শহরের দক্ষিণপাশ বরাবর হাসন নগর কুড়িয়ার পাড় ধরে বুড়িরস্থলের দিকে যে কাঁচা রাস্তাটি চলে গেছে তার এক জায়গায় রাস্তাটি বাঁক নিয়েছে, সেখান থেকে সোজা বরাবর হাসন রাজার সময় একটি নুতন রাস্তার কাজ চলছিল। এই রাস্তাটি হাসন রাজার উদ্যোগে ও খরচে হচ্ছিল। পরে এ সড়কটি রবিদাস নামে এক জমিদারের নামানুসারে ‘রবিদাস সড়ক’ নাম দেওয়া হয়। কোর্ট থেকে ষোলঘর অভিমূখী রাস্তার দক্ষিণ পাশের বাসাগুলার পিছন নিয়ে বুড়ির স্থল অভিমূখী রাস্তাটি মধ্যবর্তী এলাকাটি জুড়ে যে একটি বনাঞ্চলের অস্থিত্ব ছিলÑ সেই এলাকাটিকে হাসন রাজা জঙ্গল আবাদ করিয়ে অনেক সাধারণ মানুষকে জনবসতি গড়ার ব্যবস্থা করেন।

বর্তমান সুনামগঞ্জ শহরের মেইন পয়েন্ট থেকে ষোলঘর অভিমূখী যে রাস্তাটি বরাবর চলে গেছে সেটিকে প্রথম মহকুমা প্রশাসক (ঝউঙ) হাসন রাজার সম্মাণার্থে ‘দেওয়ান সাহেব সড়ক’ নামে অভিহিত করেন। কেননা এই শহরের গোড়াপত্তনে পুরাণ টাউন হল, মুন্সেফ এজলাস, হাসপাতাল, থানা, জেল, কোর্ট আদালতের জন্যে সমস্ত জায়গা হাসন রাজার দানকৃত। উকিলপাড়াস্থ ভদ্রজনের জন্যে হাসন রাজার দানকৃত অনেক বাড়িই শহরের প্রথম উন্নতমানের আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছে। শহরের মধ্যখান থেকে একটি ইউ সেইপ (ট-ংযধঢ়ব) ধরে নদীর তীর বরাবর ষোলঘরমূখী রাস্তাটি মহকুমা প্রশাসকের বাংলাঘরের সম্মূখবর্তী স্থান থেকে শুরু করে দক্ষিণমূখী বাঁক নিয়ে বর্তমান থানার পূর্বধার ধরে যে রাস্তাটি স্টেডিয়ামকে বায়ে ফেলে পূবে বুড়ির স্থলের দিকে চলে গেছে, সেটাকে চোখের সামনে রাখলে এই ছোট্ট শহরের একটি বড় জায়গা পরিসরব্যাপী যে রাস্তার রেখাপাত হয়েছিল বহুকাল আগেই, তা-ই আজো সেই চিত্রটি ঠিকে আছে সুনামগঞ্জ শহরে।