পারিবারিক ইতিহাস

হাসন রাজার পারিবারিক উৎস ইতিহাস উদঘাটনে প্রধানত তিনটি মূল তথ্যসূত্র কাজ করেছে, এক: ‘দেওয়ান বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, দুই: হাসন রাজার প্রথমপুত্র খান বাহাদুর গনিউর রাজার রেখে যাওয় অনেক তথ্যকথা ও তাঁর অন্যান্য দলিল আর তিন: সার্বিকভাবে সিলেট সুনামগঞ্জের ইতিহাস। পরিবারের উৎস-ইতিহাস সন্ধানের সাথে সাথে আমরা এই অধ্যায়ে ঐতিহাসিক এক ধারাবাহিকতায় খুজে নেব হাসন রাজা ও তাঁর পূর্বপুরূষগনকে ।

চার কি পাঁচ খৃষ্টপূর্বে মৌর্যবংশীয় সম্রাট অশোকের সম্রাজ্য প্রায় সমস্ত উত্তরভারত জুড়ে বিস্তৃত ছিল। গুপ্ত-সম্রাজ্যের অধীনেও প্রায় সমগ্র ভারতকে একীভুত করা হয়। গুপ্ত সম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতের অসংখ ছোট ছোট খন্ড রাজ্য বিভক্ত-আকারে হিন্দুরাজ কর্তৃক শাষিত হয়ে আসছিল। পরবর্তীকালে ভারতের একীভুতকরনের প্রক্রিয়া শুরু হয় মুসলমানদের আক্রমনের পর থেকে। উত্তর-ভারত-ইতিহাসের একাদশ শতাব্দির মধ্যভাগে এই অঞ্চলে তুর্ক-আফগান আক্রমনের সাথে ভারতে দিল­ীর সুলতানী রাজত্বের শুরু। এই সুলতানী যুগেই লোদি, তুগলক আর সাঈদ বংশীয়রা ভারতের উত্তরাংশ রাজত্ব করেন। এই যুগেই হাসন রাজা-পরিবারের আদি পুরুষ ভরদ্ধাজগোত্রিয় সূর্যবংশসম্ভুত রাজা রামচন্দ্র সিংহদেব বসবাস করতেন বানারসীতে। ভরদ্ধাজ ঋষিই হলেন এই ভরদ্ধাজগোত্রের প্রবর্তক। বানারসী শহরটি হাজার বছর ধরে সমস্ত উত্তরভারতে একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্ররূপে পরিগনিত হচ্ছিল। তবে হাসন রাজার তৃতীয়পুত্র একলিমুর রাজার আত্মজীবনীতে তাঁদের বাসস্থান সম্পর্কে ভিন্নমত পুষন করে বলেন: “অযোধ্যা নিবাসী ভরদ্ধাজগোত্রীয় সূর্য্য বংশ তালিকা বংশের সন্তান ‘রামচন্দ্র সিংহ দেব’ ক্ষত্রিয় কুলের নক্ষত্র স্থানীয় ব্যক্তি।” এই পরিবারের পুরুষগনের ‘কৌলিন উপাধি ছিল সিংহদেব’। অনেক বছর পরে কোন এক সময় রামচন্দ্র সিংহদেবের উত্তরসূরী তিলোত্তমচন্দ্র সিংহদেব নামক এক অধস্তন বংশপুরুষ এক পর্যায়ে কোন এক অজানা কারণে বানারসী থেকে রায়বেরিলিতে চলে আসেন এবং অযোধ্যার রাজ্যের আউদ রাজবংশীয় এক রাজকন্যাকে বিবাহ করেন।

ষোড়শ শতাব্দিতে এসে তৈমুরলংগ বংশীয় মোগলরা যখন সমস্ত ভারত জুড়ে মোগল সা¤্রাজ্য কায়েম করেন, ঐ সময়ই ভরদ্ধাজগোত্রিয় রামচন্দ্র সিংহদেবের ক্ষত্রিয় উত্তরপুরুষ রাজা বিজয় সিংহদেব ষোড়শ শতাব্দির মাঝামাঝিতে পারিবারিক কুন্দল ও মনোমালিন্য-হেতু এবং উপোর্যপোরি মোগলদের আক্রমনে জর্জরিত হয়ে অযোধ্যা ছেড়ে দিয়ে এলাহাবাদে চলে আসেন এবং সেখান থেকে পরে বর্ধমানে এসে উপস্থিত হন। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁরই আপন ভাই দূর্জয় সিংহদেব। দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ জানিয়েছেন, “ভাগ্য বিপর্যয়ে তাঁরা আরও পূর্বদিকে রওয়ানা দিয়ে” বাংলার যশোর জিলায় উপস্থিত হন এবং হাবেলি পরগনার কাগদিগি নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। দক্ষিণ রাঢ় নামে তথাকথিত এই অঞ্চলে পাঠানদের সহায়তায় দুইভাই বিজয় সিংহ ও দুর্জয় সিংহ একটি খন্ড-রাজ্য প্রতিষ্টিত করেন। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বর্ধমান থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত হুগলি ও ভাগিরতি তীর ধরে প্রায় সমস্ত হুগলি জেলা ব্যাপি একটি বিরাট সমতল ভুমি বিস্তৃত অঞ্চলটিকেই রাঢ় অঞ্চল নামে অভিহিত করা হতো। অজয় নদী রাঢ়ের মধ্যভাগ দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হওয়ায় অঞ্চলটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে। নদীর উত্তরাঞ্চলকে উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণাঞ্চলকে দক্ষিণ রাঢ় নামে অভিহিত করা হতো। এটি ধরা হতো যে, রাঢ় ভুমাঞ্চল ভাগিরতির পশ্চিমাঞ্চল মুর্শিদাবাদ থেকে শুরু করে বঙ্গোপোসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় প্রাচীন কাল থেকেই, ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু বিজয়ী এবং বিজিত রাজ-রাজাদেরকে এই রাঢ় এলাকায় পাড়ি জমাতে দেখা যায়। একাদশ শতাব্দির সেন রাজারাও ভারতের দাক্ষিণত্য থেকে এই অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বিজয় সিংহ ও দুর্জয় সিংহদেব যখন অঝোধ্যা থেকে এলাহাবাদ-বর্ধমান হয়ে বাংলার এই দক্ষিণ রাঢ় অঞ্চলে এসে উপস্থিত হন, তখনও উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সমগ্র অঞ্চলটি মোগলদের করতলগত ছিল না। বাংলার পাঠান কর্তৃক শাসিত ছিল বলে অঞ্চলটিকে মোগলদের আয়ত্তে আনার লক্ষ্যে সম্রাট আকবরের সময়ে (১৫৭৬-১৬০৫) এবং ত্বদ্বীয় পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাতটি বছর পাঠানদের সাথে যুদ্ধ কলহে কেটেছে। দীর্ঘ ৩৬ বছর যুদ্ধ-বিগ্রহের পর ১৬১২ খৃষ্টাব্দে এই অঞ্চলে মোগলদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। মোগলেরা নামেমাত্র বাংলার প্রভু ছিলেন। প্রকৃত প্রভু ছিলেন বার ভুইয়া ও আফগান নায়কগন।

খুব সম্ভবত: মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাষনামলের (১৬০৫-১৬২৭) কোন এক সময়ে দক্ষিণ রাঢ়ের এই ছোট রাজ্যে পারিবারিক আভ্যন্তরিন কলহে রাজা বিজয় সিংহদেব তাঁর ভাই রাজা দুর্জয় সিংহদেবের সাথে এক প্রতিকুল অবস্থার সম্মূখীন হন। দুর্জয় সিং রাজ্য পরিচালনার ভার নিজের হাতে নিবার জন্যে দৃঢ়ভাবে জেদী হয়ে উঠেন। ভাইয়ের সাথে কোনরকম ঝগড়া বিদ্রোহ এড়ানোর লক্ষ্যে বড় ভাই রাজা বিজয় সিংহদেব রাজ্য ত্যাগ করেন। উল্লেখ্য দুর্জয় সিংহদেবের বংশধররা পরবর্তীকালে কয়েকযুগ ধরে এই স্থানে অবস্থান করেন এবং অপর ভাই রাজা বিজয় সিংহের পরবর্তী বংশধর হাসন রাজার বাবা আলী রাজার সময়কাল পর্যন্ত সিলেটে তাঁদের যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিজয় সিংহ বিরাট একদল লোক লস্কর নিয়ে যখন বাংলার উত্তর-পূর্বদিকে যাত্রা করেন, তখন এই দুরের যাত্রীদলে সঙ্গী ছিল হিন্দু সমাজের বিভিন্ন স্থরের নানা বর্ণ-শ্রেনীর্ভূক্ত একদল লোক। এদের মধ্যে পারিবারিক কুল-পুরুহিত থেকে শুরু করে গুরু, ব্রাম্মন, অভিজাত কায়স্থ, নাপিত, ধুপা, তেলি, মালি, কৈবর্ত, মাঝি এবং জেলেও ছিলো। অবশেষে রাজা বিজয় সিংহ সিলেট অঞ্চলে এসে পৌছলে বিশ্বনাথ উপজেলাধীন বর্তমান কোনাউরা নামে অভিহিত গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। দেওয়ান আজরফ জানান তাঁর সময় পর্যন্ত কৌড়িয়া পরগানার অন্তর্ভুক্ত ‘কুনাউরায় এখনও রাজা বিজয় সিংহের গড়, দীঘিও দালানাদির চিহৃ পাওয়া যায়।’ কথিত আছে, রাজা বিজয় সিংহদেব তাঁর স্ত্রীকে ভীষনরকম ভালবাসতেন আর সেকারনেই তাঁর স্ত্রীকে দেয়া সমস্ত মূল্যবান সোনা ও প্রস্তরখচিত অলংকারদি নিয়ে সিলেটে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দেওয়ান বাড়ীর ইতিহাসে বিবৃত আছে যে “তাঁহার রাণীর নাসিকার একটি স্বর্নঘঠিত বহুমূল্য প্রস্তরখচিত নথ এখনও তদ্বীয় বংশধর দেওয়ান আজিজুর রাজা চৌধুরীর নিকট আছে।” দীর্ঘ পথভ্রমনের পর এবং স্থান পরিবর্তনের কারণে তিনি শারিরীকভাবে অতি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর সন্তান যুবরাজ অজিত সিংহদেব (১৫৯৩-১৬৭৮) হাবেলীসহ সংলগ্ন এলাকার সমস্ত উন্নয়ন কাজের দায়ীত্বাভার সমজিয়ে নিন।

আইন-ই-আকবরী ইতিহাস অনুসারে ‘মোগলাধীন এই এলাকাটি জলাবদ্ধ ছিল। এলাকাটি ‘ইলাম‘ তালিকাভূক্ত ছিল। ‘ইলাম’ শব্দটি মানে হল ‘খালি ভূমি’, ‘জনহীন’ ও ‘পতিত এলাকা’। কুনাউরা এরকমই একটি স্থান ছিল। পরবর্তীকালে এর নামকরনটি করা হয়। রাজারা এই খালি জায়গাটিতে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাছাড়া এই এলাকার এক বিরাট অংশ ‘জলগড়’ নামে পরিচিত ছিল। এমনকি দেওয়ান আনোয়ার খাঁর সময় হতেও আজ পর্যন্ত রামপাশা এষ্টেটের তৌজি ও দলিলপত্র মোতাবেক কুনাউরা এবং এর পার্শবর্তী গ্রামসমূহকে ‘জলকর’ মৌজা বলে উলে­খ আছে। প্রতিয়মান হয় যে, ‘জলগড়’ শব্দটি পরে ‘জলকর’শব্দে পরিবর্তিত হয়েছে। কুনাউরা নামে গ্রামের পরিচয় ঘটেছে পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্থের সময়। যুবরাজ অজিত সিংহদেব বহু দুর দুরান্তের লোকজনকে উৎসাহ উদ্দিপনা দিয়ে এই এলাকায় নিয়ে আসেন এবং নুতন বসতি স্থাপনে লোকজনকে সবরকম সহায়তা দান করেন। অবশেষে দেখা যায় এই এলাকায় ক্রমে ক্রমে নুতন নুতন জনবসতি গড়ে উঠে। বর্তমান বিশ্বনাথ উপজেলার পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরাংশের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অঞ্চলই ছিল তাঁর অধীনে। মোগল প্রশাসনের সাথে কোনরকম বাধা-বিরোধ বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিলেটে অবন্থানরত মোগল ফৌজদার মির্জা সালেহ আফগান (১৬২৪-১৬২৭) মুহাম্মদ জামান আগা (১৬২৭-৩৭) প্রভৃতির পাশাপাশি তিনি এই অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালিয়ে যান। এখানে উলে­খ করা যেতে পারে যে, বিখ্যাত Resident Collector রবার্ট লিন্ডসে সাহেব বলেছেন During the Mogul government a considerable military force was kept up at Sylhet for its defence, —the troops were maintained on the feudal system, and had lands allotted to them under the hills for their military services ঐ সমস্ত মুগল সামন্তরা স্থানীয় স্বাধীন রাজাদের সাথে মিলিতভাবে সমস্ত সিলেট অঞ্চলকে বহিরাগত শত্রæদের আক্রমন হতে রক্ষায় উদ্যোগী হন এবং এইভাবেই ঐ সময় ক্রমে ক্রমে এলাকার ভূমিসমূহ কৃষিকার্যের আওতায় আনা হয় । অজিত সিংহদেব যখন মারা যান, তখন তাঁর তিন পুত্র রাজা সুবিধরাম সিংহদেব (১৬২৩-১৬৮৮), রাজা ব্যথিতরাম সিংহদেব এবং রাজা শ্রীনাথ সিংহদেব মধ্যে বয়োজৈষ্টই রাজ্যভার গ্রহন করেন। তাঁর দুই পুত্র রাজা অভিমূন্যরাম সিংহদেব (১৬৫১-১৭০৬) ও রাজা প্রতাপ সিংহদেব (১৬৫৪-১৭১৬)। পারিবারিক ঐতিহ্যানুসারে প্রথমপুত্র অভিমূন্যরাম সিংহদেব বাপ-দাদার দায়িত্ব হাতে নেন এবং তাঁদের পদানুসরণ করে আবারো এলাকার উন্নয়ন সাধন করেন। রাজা প্রতাপ সিংহদেবের দুই পুত্র সন্তান ছিলেন। রাজা অভিমূন্য সিংহদেবের একমাত্র পুত্র এবং এই বংশের বিংশতম প্রজন্ম পুরুষ রাজা রনজিৎ-রাম সিংহদেব, যাঁর কৃতিত্ব তাঁকে এই বংশের অন্যতম বিখ্যাত পুরুষের স্থানে অধিষ্টিত করেছিল। রাজা রনজিৎ সিংহদেব (১৬৭৬-১৭৪৮) পাশা খেলার উদ্দেশে তাঁর এক ব্রাম্মণ বন্ধুর বাড়ীতে প্রায়ই ঘনঘন যাতায়াত করতেন। এই ব্রাম্মণ বন্ধুর বাড়ী কাপনা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। কিংবদন্তী যে, রাজা রনজিৎ কোনদিনই তাঁর বন্ধুর সাথে খেলায় জয়ী হতে পারেননি। কিন্তু একবার তাঁরা পরস্পর জায়গা বাজি রেখে খেলতে শুরু করলে রাজা রনজিৎ সিংহদেব ভগবান শ্রী রামের নামে খেলার চাল দেন এবং শেষপর্যন্ত খেলায় এই প্রথমবারের মত জয়ী হন। এই জয়ের কিছুকাল পরই বিজয়সিংহের এই অধস্তন চতুর্থ পুরুষ কুনাউরা ছেড়ে দুই মাইল দক্ষিণপূর্বে কিছু লোকজনসহ বসবাসের জন্যে চলে আসেন এবং বানারস নিবাসী তাঁর বংশের আদিপুরুষ রাজা রামচন্দ্র সিংহ দেবের নামে এই এলাকার নামকরন করেন ‘রামপাশা’। তাঁরই সময় রামপাশায় পরিখাসহ একটি প্রাসাদদূর্গ গড়ে উঠে।’ ( আলমনুর রাজা) এই দূর্গ-প্রাচীরের ধংসাবশেষ আজো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।

রাজা রনজিৎ সিংহদেব মোগল সম্রাট আকবর ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে তাঁর নিজের এলাকাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করে তুলেন এবং বিশ্বনাথ এলাকার এক বিরাট অংশকে তাঁর শাষনের আওতায় নিয়ে আসেন। রনজিৎ সিংহদেব এ-পর্যন্ত স্বাধীন একজন আঞ্চলিক শাষক ছিলেন যখন সদর সিলেটে শমশের খান (১৭২৮-৪০) ফৌজদার হিসেবে দীর্ঘ ১৩ বছর কাটালেন। কিন্তু শমশের খানের এলাকা বিভক্তিকরনের কৌশলে স্থানীয় জমিদার কিংবা ছোট ছোট রাজারা খুব একটা স্বস্থিতে ছিলেন না। তিনিই বিদ্রোহী রহিম আফগানকে পরাজিত ও নিহত করে শমশের খাঁ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৭৩৯ সালে ইটা পরগনা থেকে কিছু ভূমি খারিজ করে শমশের খাঁ তাঁর নিজের নামে শমশের নগর সৃষ্টি করেন। এমনি নাজুক অবস্থাতেও বিচক্ষন রনজিৎ সিংহদেব সিলেটের ফৌজদারের সাথে সমজোতা বজায় রেখেই তাঁর বিশাল জমিদারী স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে সমর্থ হন।

রনজিৎ সিংহদেবের পাঁচ পুত্রসন্তান ছিলেন, যথাক্রমে সুন্দরাম সিংহদেব, সম্পদরাম সিংহদেব, বানারসী সিংহদেব, জগৎরাম সিংহদেব এবং চান্দিরাম সিংহদেব। তৃতীয় পুত্র বানারসীরাম সিংহদেব ( ১৭০৪-১৭৮১) এর জন্ম হয় যখন তাঁর পিতামাতা উত্তর ভারতের বানারসে তীর্থভ্রমনে ছিলেন। এজন্যে জন্মস্থানের নামে তাঁর নামটি হয়ে যায় ‘বানারসীরাম’। রনজীৎ সিংহদেবের ষাট বছর বয়স্কালে তাঁর প্রথমপুত্র সুন্দরাম সিংহদেব ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সম্পদরাম সিংহদেব গান-নৃত্যে সর্বক্ষন আসক্ত থাকার কারণে শাষনকার্যে অমনোযোগী হয়ে উঠেন। এমনি পরিস্থিতিতে পিতা রনজিৎ সিংহদেব বৃদ্ধ বয়সে তৃতীয় পুত্র রাজা বানারসী সিংহদেবকেই বেঁচে নিলেন শাষনকার্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পন করার জন্যে। বানারসীরাম পিতার বাধ্য ও উপযুক্ত পুত্র সন্তান হিসেবে সায়সম্পদ, লোকলস্কর ও এলাকা উন্নয়নের দায়িত্ব কাধে চাপিয়ে অত্র এলাকায় সিলেটের একজন অত্যন্ত প্রথিতযশা শক্তিমান স্থানীয় শাসক হিসেবে আভির্ভূত হন। এই সময়ই তাঁদের ভূসম্পত্তির এক বিরাট অংশ মোগল দেওয়ানী আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। যখন সিলেটের ফৌজদার আলীকুলি বেগ (নবাব)। সিলেটের নবাবের সাথে সাক্ষাতে ও মাহাত্ব্যে তিনি মুগ্ধ হন। তিনি ফৌজদার/তথা নবাবকে কৌড়িয়া পরিদর্শনে আমন্ত্রন জানান। শোনা যায় এই আলীকুলি রামপাশার ঐতিহাসিক পরিখাযুক্ত বাড়িটি পরিদর্শন করেন। প্রজাহিতৈষী কর্মতৎপরতা দেখে অবশেষে ফৌজদার আলীকুলি খাঁর সুপারিশেই রাজা বানারসীকে ১৭৪৬ সালে ‘দেওয়ান’ উপাধিতে ভূষিত করার ব্যবস্থা করেন। খাঁন বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজার বর্ননায় পাওয়া যায়, “বানারসী সিংহদেব অত্যন্ত দয়াদ্রচিত্ত ও দাতা ছিলেন। একদা ‘দেওয়ানী কর’এর সমস্ত অর্থ এক কন্যাদায়গ্রস্থ ও পুত্রের উপনয়নে দায়গ্রস্ত ব্রাম্মন, দরিদ্র ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত ব্যক্তিগনকে বিতরন করিয়া দেওয়ার কারণে ফৌজদার আলীকুলী বেগ (১৭৪৪-১৭৪৮)এর কাছে কর অনাদায়ে সময় চান। কিন্তু ফৌজদার অর্থাৎ নবাব অনাদায়ের কারণ জানিতে পারিয়া ঐ-বছর সম্পূর্নভাবে তাঁহার জন্যে কর মৌকুফ করিয়া দিন।”বানারসী সিংহদেব তাঁর প্রতিভা, গুনাবলী এবং সমাজে বিভিন্নরকম অবদানহেতু তাঁর ৪২ বছর বয়সে ‘দেওয়ান’ উপাধি লাভের প্রামানিক তথ্যাদির উৎসেরও খোঁজ পাওয়া যায়। উপরন্তু জানা যায় যে, সম্রাট মুহাম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮) রাজত্ব-সময়ে সারা ভারতের ‘দেওয়ান’ উপাধি তালিকায় লাহোরের দেওয়ান মুকুন্দচান্দ দাশ বর্মনের নামের পরপরই দ্বিতীয় নামটি আসে দেওয়ান বানারসীরাম সিংহদেব। অনেকে অবশ্যি ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ প্রদত্ত দেওয়ান উপাদির সাথে এই ‘দেওয়ান’ উপাধিকে মিশিয়ে দেন। এই উপাধি প্রাপ্তির পরপরই তিনি তাঁর নিজের নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। সেই গ্রামটি ‘বানারসীপুর’ নামে এখনও টিকে আছে। তাঁর নিজের সম্পত্তি হতে বিপুল পরিমান সম্পদ ও অর্থ দরিদ্রজনের কল্যাণে ও ধর্ম-চর্চা ও ধর্ম-শিক্ষায় দান করেন।

ওদিকে আলীকুলির সময় থেকেই পুরো সিলেট জুড়ে পাহাড়িয়া জাতীরা বা সিমান্তে বসবাসকারী খাসিয়া ও কুকী জাতি প্রায়ই সমতল এলাকায় নেমে এসে লোকের উপর নানান রকম অত্যাচার অবিচার ও উৎপাত করতো। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে সুনামগঞ্জে সিমান্তরক্ষাকারী সেনাপতি অয়েজউদ্দীন কোরেশীর সাথে এই বানারসী সিংহদেবের পরিবারের একটি ঐতিহাসিক পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠে তা আমরা পরবর্তিতে জানবো।

১৭০৮ সালে সুবা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। সিলেট -সুনামগঞ্জ সিমান্তবর্তী অঞ্চল হিসাবে এ সব এলাকায় ফৌজদারের পদ ঐ সময় থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পূর্বোল্লিখিত রবার্ট লিন্ডসের মতে বাংলার সুবাদারের আত্মীয় বা সম্ভ্রান্তবংশীয় ব্যক্তিগনকে সিলেটে ফৌজদার নিযুক্ত করা হতো। ১৭৫৯ থেকে ১৭৬২ সাল পর্যন্ত সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফৌজদার ছিলেন নওয়াজিশ মুহম্মদ খান। সিলেটের ফৌজদার নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের সময় “তাঁর অধিনস্থ নায়েব ফৌজদার ছিলেন অচল সিং”। । নওয়াজিশ খাঁ অত্যন্ত উদারপন্থী নবাব ছিলেন। নানা হিন্দু গুনিজনকে তিনি সহায়-সুবিধা ও ভূমিদান করে তাঁদের মন জয় করেন। “১৯৬২ সালে এই ফৌজদার দানিশমন্দ খাঁকে ভূমিদান করেন।” । আনুমানিক ১৭৫৯ সালের প্রথম দিকে বানারসী সিংহদেব তাঁর পুত্র বিরেন্দ্ররামকে নিয়ে ফৌজদারের সাক্ষাৎ নেন এবং তখন থেকেই ফৌজদারের সাথে কৌড়িয়ার রাজবংশেরও সৌহার্দ্য-সম্পর্ক আরো গাঢ়তর হয়ে উঠে। এদিকে দিল­ীর সিংহাসনে ১৭৫৯ খৃষ্টাব্দে একই বছরে তিন মোগল সম্রাটের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তিন তিনটি পট পরিবর্তিত হয় । মোগল সম্রাট আজিজ উদ্দিন দ্বিতীয় আলমগীরের (১৭৫৪- ১৭৫৯) শাসনাবসানে তৃতীয় শাহজাহান সিংহাসন আরোহন করেন, কিন্তু বছর শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় শাহ আলম (১৭৫৯-১৮০৬) সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। ভারতবর্ষে মোগল প্রশাসনের এই ক্রান্তিলগ্নে সিলেটে আমাদের আলোচ্য বংশের ভিতরেও এক অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটে। রাজা বিরেন্দ্ররাম সিংহদেব (১৭২৯-১৭৯৭) যিনি হবুকালের মরমি কবি হাসন রাজার প্রপিতামহ তিনি হিন্দু রক্ষনশীল সমাজ ও পরিবেশের ভিতরে থেকেও এক ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক জ্ঞানের স্পৃহা ও দৃঢ় গুন-বৈশিষ্ট্যের কারনেই হয়তো জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি সমমর্যাদা দিতে কুন্ঠা বোধ করতেন না। তাঁর খোলাখুলি মনোভাব থাকায় জাত-বেজাত উপেক্ষা করে সকল মানুষের সাথে মিশতে পারতেন। ফলশ্রæতিতে তাঁরই কাকাত ভাইয়েরা পরশ্রিকাতর ও প্রতিহিংশাপরায়ন হয়ে উঠেন এবং তাঁকে ধর্মবিদ্ধেষী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি সুপুরূষ ছিলেন বলে স্থানীয়বাসীরা তাঁকে ‘শ্রীরায়’ বলে ডাকতো। প্রখর বুদ্বিদীপ্ত জ্ঞানপিপাসু বিবেচনায় পিতা বানারসী সিংহদেব তাঁর পুত্রের উপযুক্ত বয়সে হিংগাজিয়া (বর্তমান কুলাউরা উপজিলা অধীন) নিবাসী পরমাসুন্দরী জমিদার কন্যা সর্বানন্দা দেবীর সাথে বিবাহ দেন। এই সময় সারা ভারত জুড়েই হিন্দু জমিদার এবং প্রভাবশালীরাও ফার্সি ভাষা চর্চা করতে দেখা যায়। ইতোমধ্যে ইসলামী দর্শন ও বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্তে¡র ঐক্য-চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রানিত হলেন বিরেন্দ্ররাম। এক পর্যায়ে দার্শনিক মওলানা রুমীর বিখ্যাত কাব্য ‘মসনবি’ তাঁকে আকৃষ্ট করে এবং সে-কাব্যসম্ভার পাঠ-সম্পন্ন করেন। ওদিকে তাঁর গোত্রিয় ভাইয়েরা একদিন তাঁকে নিয়ে মৃগয়ায় যাওয়ার পথে মাহুতের (হাতিচালক) হাত থেকে পানি পান করেন। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞাতি-ভাইয়েরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে তাঁদের সঙ্গ ত্যাগ করে রামপাশার বাড়ীতে ফিরে যেতে বাধ্য করেন এবং তাঁকে কাশিধামে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেন। পরে যখন তিনি বাড়ীতে ফিরে এলেন এবং পিতা বারানসীরামের কাছ থেকেও কোনরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে বিরেন্দ্ররাম তাঁর ঘোড়াটি নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সিলেটে পৌছে ফৌজদার নওয়াজিশ মোহম্মদ খানের (১৭৫৯-১৭৬২) কাছে উপস্থিত হন এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে ‘বাবু খাঁন’ নাম ধারন করেন ।

দেওয়ান বাড়ীর সংক্ষীপ্ত ইতিহাসে জানা যায়, “রাজা বাবু খানের ধর্মান্তরের সংবাদ শুনিয়া এলাকার নি¤œ-বর্ণ বহু হিন্দু পরিবারগুলাও তাঁহাকে অনুসরন করে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। তাঁহাদেরই উত্তরসূরীরা এখনও রামপাশা, মনোহরপুর এবং লক্ষনশ্রীর তেঘরিয়া মৌজাতে বংশ পরম্পরায় বসবাস করিতেছে।” রাজা বাবু খানের ধর্মান্তরের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী শ্রীমতি সর্বানন্দা দেবি বিবাহত্তোর পিত্রালয়ে (বর্তমান কোলাউড়াধীন) হিংগাজিয়ায় অবস্থানেকালে গোপনে রাতের বেলায় আত্বহত্যা করেন। । অন্যদিকে পুত্রের ধর্মান্তরে রাজা বানারসী সিংহদেব মানসিকভাবে এমনই পর্যুদস্তু হয়ে পড়েন যে, ভগ্ন হৃদয়ে তিনি নিজ রাজ-প্রাসাদ ভেঙ্গে ফেলেন। এরপর তিনি সিলেটের ফৌজদার নওয়াজিশ মোহম্মদ খানের কাছে একটি রুপার হাতি উপহার পাঠান। সাথে ছেলেকে ফেরৎ পাঠাতে অনুরোধ জানান। কিন্তু ফৌজদার রাজী হননি। তখন তিনি আবার অনুরোধ জানালেন যে, ছেলেটিকে যেনো তাঁদের সমতূল্য একটি অভিজাত মুসলিম পরিবারের কন্যার সাথে বিয়ে দিয়ে বংশের কৌলিণ্য রক্ষা করা হয়। এবারের অনুরোধটি ফৌজদার সাহেব রক্ষা করলেন। ‘নওয়াবের (ফৌজদার) প্রস্তাবে পূর্বোলি­খিত সুনামগঞ্জের সেনাপতি কোরেশ বংশীয় অয়েজউদ্দিন কোরেশির বোন সহরজাহান বানুর সহিত দেওয়ান বাবু খান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন’। পুত্রের ধর্মান্তরে বানারসী সিংহদেব ভেঙ্গে পড়লেও তাঁর জমিদারী পরিচালনায় ফৌজদারের সাথে কোনরূপ সম্পর্কের ভাটা পড়েনি। পরবর্তীকালে কম্পানী আমলে প্রথম ইংরেজ প্রতিনিধি মি: সামনার, দ্বিতীয় প্রতিনিধি প্রথম কালেক্টার মি: থেকারে এবং পরে কালেক্টার হলান্ড সাহেবের পক্ষ থেকেও কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে জমিদারী চালিয়ে যান বানারসীরাম। পুত্র বিরেন্দ্ররাম ওরফে বাবু খানের বিবাহের পরপর ফৌজদারের সাথে যোগসাজসে বানারসীরাম সিংহদেব পুত্র বাবু খান ও পুত্রবধুকে সাদরে নিজগৃহে নিয়ে আসেন এবং বিষয় সম্পত্তি পুত্রের কাছে সমজিয়ে দিয়ে ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন। এই সময় পিতা ও পুত্র উভয়ই নিজ নিজ ধর্ম ও বিশ্বাস নির্ভর করে আপন আপন দৈনন্দিন জীবনযাপনে ব্রতী হন। তাঁদের মধ্যে কোনরুপ দ্বিধাদন্ধের অবকাশ ছাড়াই ধর্মবিশ্বাসের উর্দ্ধে থেকে পিতাপুত্রের ¯েœহ-প্রীতি আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালবাসা সত্যিকার মানবিক প্রতিমূর্তি ধারন করে। বানারসী সিংহদেব এই সময় কাটলিপাড়ায় দুটি মন্দির তৈরী করেন, একটিতে তিনি নিজ গৃহদেবতা বৃন্দাবনচন্দ্র বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। ওদিকে বাবু খানের ধর্মান্তরের পরও তিনি পিতার ধর্ম ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন, এবং স্থাণীয় বেশ কিছু মন্দির উপাসনালয়ের নির্মানকার্য্য করিয়ে দিন। ধর্মীয় ভিন্নতা বড় ছিল না, বরঞ্চ একই ঘরে দুই ধর্মের একটি সুন্দর সহবস্থানে সত্যিকারভাবে মানব-জীবন ও মানবকর্ম যেনো হয়ে উঠেছিল উজ্জলতর ।

বাবু খানের সর্বোতো চেষ্টায় স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ন ও সহমর্মী পরিবেশ বজায় থাকে। নিজ দায়িত্বে বাবু খান মানুষের সহায়-সুবিধার্থে কাপনা নদীর উত্তর-তীরে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন, যা অদ্যাবধি ‘বাবুনগর‘ নামে তাঁর স্মৃতি বহন করছে। কিছুদিনের ভেতরেই বাবুখানের স্ত্রী সহরজাহানের গর্ভে জন্ম নেন দুই পুত্র দেওয়ান কেশোয়ার খান (১৭৬০-১৭৯৮)ও দেওয়ান আনোয়ার খাঁন (১৭৬২-১৮০০)।

বাবু খানের সাহিত্য কর্ম

রাজা বিরেন্দ্র রাম সিংহদেব ওরফে বাবু খানের নিজহস্তে ফার্সি ভাষায় লিখিত একখানা গ্রন্থ দেওয়ান আজীজুর রাজা সাহেবের কাছে গচ্ছিত ছিল বলে “দেওয়ান বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে” লিখা আছে। ‘তাঁর মৃত্যুর পর তদ্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্র দেওয়ান হাসননুর রাজার হাতে বহুদিনের যতœসহকারে এই বইটি গচ্ছিত থাকে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ সালের ভূমি-জরিপকালে আনুমানিক ৫৫/৫৬ সালের দিকে জরিপের সরকারী কর্মচারী ও দায়িত্বশীল জরিপ অফিসার রামপাশার হাসন রাজার বাড়ির তউজিস অফিসে তাদের জরিপ কেন্দ্র খোলেন। ঐ সময় জরিপ মেজিষ্ট্রেটের এক আত্মীয় মাহবুবুর রহমান নামক এক ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বিশ্বনাথে রামপাশার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। দেওয়ান হাসননুর রাজার সাথে সাক্ষাৎ হলে পর তিনি আগ্রহভরে ঐ গ্রন্থটি চেয়ে নিন এবং ফার্সি ভাষায় লিখিত এই বইয়ের অনুবাদ করার প্রতিশ্রæতি দিন। উক্ত ব্যক্তিকে হাসননুর রাজা বাবু খানের বইখানা হস্তান্তর করেন। কিন্তু দুঃভাগ্যবশত পরবর্তী কালে তার কাছে অনেক লেখালেখি করার পরও বরিশাল নিবাসী উক্ত ব্যক্তি আর বইখানি ফিরত দেননি। দেওয়ান একলিমুর রাজা তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থেও উলে­¬খ করেছেন: “বীরেন্দ্ররাম সিংহদেব অতি সুপুরুষ ও ফারসীনবীশ কবি ছিলেন। তাঁহার রচিত হস্তলিখিত একখানা ফার্সীগ্রন্থ এখনও আমাদের হাতে আছে। ইনিই আমাদের বংশের প্রথম কবি।”

তাঁর বইটির নাম ছিল “রওশনী ওহদত”। গ্রন্থখানির লেখক বাবু খান তাঁর কবি পরিচয় দিয়েছেন অনেকগুলো কবিতা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এবং এই বইতে সংক্ষিপ্ত বংশ ইতিহাসবৃত্তান্তও লেখা ছিল বলে হাসননুর রাজা জানান।

তাঁর দুই পুত্র ও পরবর্তী বংশধরগন

পুত্র আনোয়ার খাঁনের বয়স যখন ২০ বছরের কাছাকাছি তখন তাঁর পিতা রাজা বাবু খাঁন প্রায় পঞ্চাশ উর্দ্ধ। এই সময়ই সারা আসাম ও সিলেট জুড়ে এক বিরাট এলাকা বন্যাকবলিত হয়। হাসন রাজার জন্মের ঠিক ১০০ বছর আগে রবার্ট লিন্ডসে (জন্ম: ২৫ জানুয়ারী ১৭৫৪) জন্ম নেন। এই বিখ্যাত রেসিডেন্ট কালেক্টার লিন্ডসে সাহেব ১৭৭৮ সালে সিলেট এসেছিলেন। তখন দেওয়ান বিরেন্দ্ররাম ওরফে বাবু খান বহাল তবিয়তে রামপাশা অবস্থান করছিলেন। লিন্ডসে সাহেব তাঁর দীর্ঘ বার বছরের কালে সারা সিলেটে মহরমের সময় একবছর এক ভীষন বর্ন-দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধে আর চারদিকে উত্তপ্ত হাওয়া বইতে থাকে, তখন কৌড়িয়া পরগনা তথা সারা বিশ্বনাথ জুড়ে নব্যমুসলিম রাজা বাবু খানের সর্বতো প্রয়াসে এলাকায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এক সংহতি-শান্তির পরিবেশ বজায় থাকে। লিন্ডসে সাহেবের সময়েই ১৭৮১ সালের জুন মাসে সিলেটের বড় বন্যায় বিরাট জনপদ জনহীন হয়ে যায়। দশদিন যাবৎ অনবরত বৃষ্টির কারণে ধানের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়, নদীর পানির বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ঘরবাড়ি, গরু, মহিষ ভেসে যায় এবং হাজারো লোকের প্রানহানী ঘটে। সরকারী সাহায্য সত্তে¡ও লিন্ডসের অনুমান মতে এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ শাপলা, শালুক ও ঘাসপাতা প্রভৃতি খাবার খায়। এই সময়ই বাবু খাঁন ও তাঁর পুত্রদ্বয়ের জন্যে শুধুমাত্র বন্যার ভয়াবহতাই প্রকট ছিল না, উপর্যপোরি ঐ সময় বানারসী সিংহদেবের মৃত্যু পুত্রপৌত্রদেরকে শোকের ছায়ায় শোকাভিভূত করে তুলে।

আলোচ্য বংশের ধর্মান্তরিত রাজা বিরেন্দ্ররামের পুত্র আনোয়ার খানই হলেন হাসন রাজার দাদা। গনিউর রাজার তথ্যকথায় জানা যায়; পূর্নবয়স্ক হওয়ার পরই তাঁর মামা ‘অয়েজউদ্দিন চৌধুরী কন্যা দৌলত বিবিকে পরগনে কৌড়িয়া, মৌজে রামপাশা নিবাসী দেওয়ান আনোয়ার রাজা ওরফে আনোয়ার খাঁর নিকট বিবাহ দিয়াছিলেন।” দেওয়ান আনোয়ার খান সত্যিকার অর্থে একজন ধার্মিক ও দয়ালু লোক ছিলেন। বিশাল হৃদয়ের মানুষ বলে তিনি জীবনে বহু মসজিদ ও মন্দির নির্মানে প্রচুর সহায়তা করেছেন। তাঁর ৩৮ বছরের ক্ষনস্থায়ী জীবনে রাজাগঞ্জের আখড়া, টেংরার জগন্নাৎ আখড়া, গোপাল গাওয়ের আখড়া, রামপাশার মসজিদ, বড়দিঘি খনন প্রভৃতি নির্মানকার্য বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য। তাঁর নিজের নামানুসারে ‘আনোয়ারপুর’ নামে একটি গ্রাম নির্মান করে তাঁর অনুগত লোকদেরকে বসবাসের জায়গা করে দেন। তাঁর স্ত্রী দৌলত জাহানের গর্ভে জন্ম নেন দেওয়ান আলম রাজা এবং দেওয়ান আলী রাজা। আলী রাজাই হাসন রাজার পিতা, যিনি সিলেট অঞ্চলে এই বংশের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বশালী ও প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন।

এদিকে লিন্ডসে সাহেবের পর অপেক্ষাকৃত নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় জন উইলিস (১৭৮৯-১৭৯৩) সিলেটে রেসিডেন্ট কালেক্টার হয়ে আসেন। তাঁর সময়টি ছিল এই এলাকার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ন। তাঁর সময়েও খাসিয়াগন বারবার উৎপাত করতে থাকে। পরে তিনি কৌশল-নীতি অবলম্বন করে এই উৎপাতের নিরসন ঘটান। ১৭৮৯ সালে এক লক্ষ টাকা ব্যয়ে সিলেটে প্রথম জেল নির্মান করেন তিনি। ১৭৯৩ সালে বিলাতের কর্তৃপক্ষ থেকে মঞ্জুরী আস্লে পরে ‘দশশনা’ বন্দোবস্থ চিরস্থায়ী বন্দোবস্থের রূপ নেয়। লর্ড চার্লস কর্নওয়ালীস (১৭৮৬-১৭৯৩) এই সময় ভারতবর্ষের অধিপতি। আমাদের কবির পূর্ববংশীয় ভ্রাতৃদ্বয় দেওয়ান কেশোয়ার খান ও আনোয়ার খান তাঁদের পিতা রাজা বাবু খানের অনুমতি নিয়ে নিজ নিজ পুত্রগনের নামে তাঁদের পূর্বের পারিবারিক সায়সম্পত্তি-সব চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় নিয়ে আসেন। ভূসম্পত্তিগুলা চিরস্থায়ী তালুক বন্দোবস্থ করাতে গিয়ে কিশোওয়ার খানের পুত্র দেওয়ান কামদার খানের নামে ৩নং তালুক কামদার খান তালুক হিসেবে এবং আনোয়ার খানের পুত্র আলম রাজার নামে ৪নং তালুক আলম রাজা তালুক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই তালুক দুটো সিলেটের বৃহত্তর তালুক হিসাবে অভিহিত হত। ((Records of Permanent Setlement Archive,Talluk No: 3 and Talluk No: 4 with other talluks, ph: Couria, 1793)). এই সময় বিশ্বনাথ ছাড়াও সিলেট সংলগ্ন শহরের আশপাশ জুড়ে, ফেন্চুগঞ্জে, মৌলভিবাজার ও ছাতকে কয়েকটি তালুক বন্দোবস্থও নেয়া হয়।

আগেই বলা হয়েছে কয়েক বছর আগ থেকেই আনোয়ার খানের নানার বাড়ি এবং শশুরবাড়ি সুনামগঞ্জে পাহাড় থেকে নেমে এসে পাহাড়ী খাসিয়াদের দল সুরমা নদী পার হয়ে লোকেদের উপর নানারূপ উপদ্রব লোটতরাজ করতো। তেঘরিয়াতে অবস্থানরত অয়েজউদ্দিন কোরেশী তাঁর অপর কন্যা ছবর জাহানকে ঐ সময় এক দক্ষ তীরন্দাজের পরিচয় পেয়ে সদবংশীয় জালশুকার জমিদার-পুত্র মোহাম্মদ লায়েক চৌধূরীর কাছে বিবাহ দেন এবং মেয়ে ও মেয়ে-জামাইকে নিজঘরের পাশে বাসস্থান বানিয়ে দিয়ে লক্ষনশ্রী পরগনার দুই নম্বর তালুক মোহম্মদ লায়েক নামে বন্দোবস্ত করিয়ে নেন। কথিত আছে, উক্ত মোহাম্মদ লায়েক একদিন নিজ শশুরের বাড়ীর দেয়ালের উপর দাড়িয়ে নদীর উত্তর পারে এক খাসিয়া বা গারমর্গে তীর বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে আর কখনও তারা দক্ষিণ পাড়ে এসে অত্যাচার করার সাহস পেতনা। তখন অবশ্যি সুরমা নদীর প্রশস্থতা ও গভীরতা কম ছিল। বর্নীত এই মোহাম্মদ লায়েকের ঔরূসে ও স্ত্রী ছবর জাহান বিবির গর্ভেই প্রখ্যাত আমির বক্স চৌধুরীর জন্ম। তাঁর নামে লক্ষনশ্রীর ছয় নম্বর তালুক ‘মহাম্মদ আমির’ বলে বন্দোবস্ত নেয়া হয়েছিল। এপেনডিক্স:২ এই তালুক বন্দোবস্ত থেকে এ-ই পরিলক্ষিত হয় যে, ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জে যেমন নানা অয়েজউদ্দিন কোরেশীর মেয়ে বংশসম্ভূত নাতি আমির বক্স চৌধুরী জন্মলাভ করেন, ঠিক তেমনি তাঁর আরেক মেয়ে বংশসম্ভূত নাতি আলম রাজা তাঁদের বনেদি পরিবারের ভিটেস্থল রামপাশায় জন্মলাভ করেন ।

রাজা বাবু খানের ধর্মান্তরের পরপরই ভারতে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম (১৭৬১-১৮০৫)এর শাসনকাল শুরু হয়। এই সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানী, বেঙ্গল, বিহার ও উড়িষ্যায় রাজষ¦ আদায়ের জন্যে দেওয়ানী ফরমান লাভ করে। এদিকে এই কালটি এই বংশের বানারসীরাম সিংহদেবের কাল থেকে শুরু করে বাবু খান, আনোয়ার খান ও আলী রাজার জন্মকাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অনেক লেখক, গবেষক এমনকি দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ সাহেবের মত বিজ্ঞজন কোন গবেষনা এবং প্রামানিক তথ্য ছাড়াই একটি ভ্রান্তিজনক তথ্য পরিবেশন করেছেন এই যে “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় হাসন রাজার পিতা আলী রাজা জীবিত ছিলেন। তিনি তাঁর কৌড়িয়া পরগনাস্থিত ভুস¤পত্তি তাঁর চাচাত ভাই কামদার খাঁ ও আপন ভাই আলম রাজার নামে বন্দোবস্থ গ্রহন করেন। এজন্যে বিশ্বনাথ থানার অন্তর্গত কৌড়িয়া পরগনার ৩নং তালুকের নাম কামদার খাঁ এবং ৪নং তালুকের নাম আলম রেজা।” প্রকৃতপক্ষে আলী রাজা তাঁর বড়ভাইদের নামে বন্দোবস্ত করাতে সক্ষম নন এ কারনে যে হাসন রাজা সাহেবের মা-র বিবাহ ইংরেজী সন ১৮৫৩-তে, হাসন রাজার জন্ম ১৮৫৪ ইংরেজী সনে এবং খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজার তথ্যবিবরনী অনুয়ায়ী আলী রাজার জন্ম তারিখ “৭ অগ্রাহায়ন ১২০৭ বাংলা” এবং একলিমুর রাজার ৪৪নং পত্রে “দাদা (আলী রাজা ) বাঁচিয়াছিলেন বাহাত্তর (৭২) বছর” বলে উলে­খ আছে, দেওয়ান গনিউর রাজা, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফসহ বিভিন্ন লেখকের মতানুসারে আলী রাজার মৃত্যুতারিখ হলো ইংরেজী ১৮৭১ সনে। তাই বস্তুত: অন্যান্য পারিবারিক দলিল পত্রাদি এবং উপরের তথ্যাদি পর্যালোচনা করার পর একটি হিসাব পাওয়া যায় যে : চিরস্থায়ী বন্দোবস্থের পূর্বে আলী রাজার জন্মই হয়নি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ৭ বছর পর ১৮০০ সালে তাঁর জন্ম হয়। তাই সহজেই অনুমেয়, হাসন রাজার পিতামহ এবং পিতামহের বড়ভাই (অর্থাৎ আলী রাজার বাবা আনোয়ার খাঁ এবং চাচা কিশোয়ার খাঁ) তাঁদের আপন আপন জৈষ্ট্য পুত্রদের নামে চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ গ্রহণ করেছিলেন, যখন আলী রাজার জন্মই হয়নি।

‘১৮০০ সালে আনোয়ার খানের স্ত্রী দৌলতজান বানু অন্তসত্বা ছিলেন। তখন তাঁহার স্বামীর মৃত্যু হয়। এই সময় তাঁহার মৃত্যুর পরপরই একই মাসে কনিষ্ট পুত্র আলী রাজার জন্ম হয় ৭ অগ্রাহায়ন ১২০৭ বাংলায়। এই বছর আলী রাজার জন্মকালে সিলেটের কালেক্টার ছিলেন সি, জে, আমুটি (১৭৯৭-১৮০৩)। এই আমুটি সাহেব সিলেটে দশ হাজার টাকা ব্যায়ে কাছারী ঘর নির্মান করেন। “১৮০১ সালে সিলেটের লোক সংখ্যা ১,০৩৬,৬৩৭, নৌকার সংখ্যা ২৩,০০০ ও তালুকের সংখ্যা ২৭,০০০ ছিল বলে জানা যায়।” আলী রাজার জন্মের বছর থেকে হাসন রাজার জন্মের পূর্ব পর্যন্ত ১২ জন কালেক্টার সিলেটে আগমন করেন। দেওয়ান আনোয়ার খান ও তাঁর ভ্রাতা দেওয়ান কেশোয়ার খান ইহলোক ত্যাগ করায় আলম রাজার ও কামদার খান তাঁদের আপন আপন পিতার সহায়-সম্পত্তির অধিকারী হন। তার কিছুদিন পর কামদার খানও তিন কন্যা রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আলম রাজা মানসিকভাবে মুসড়ে পড়েন। এমনি অবস্থায় অধিক পান সেবন হেতু একদিন রাত্রে তিনি বিষমে আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়েন এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। দেওয়ান আলম রাজার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে যখন তাঁর ছোট ভাই আলী রাজার বয়সটি ছিল মাত্র ১৯ (উনিশ)। আলম রাজা বিবাহ করেছিলেন করনসির মুতিরগায়ের দেওয়ান পরিবারে। এই পরিবারের আদি পুরুষ হযরত শাহ সোলেমান করনী কোরিশী (রহ:), যিনি হযরত শাহজালাল (রহ:)এর ৩৬০ আওলিয়ার অন্যতম। এই পরিবার হতে এক দীর্ঘ কেশবতী পরমাসুন্দরী যুবতী কন্যাকে স্ত্রী হিসেবে পানি গ্রহণ করেছিলেন আলম রাজা। স্থানীয় বাসিন্দারা বিশেষত: মহিলা সম্প্রদায় মনে করতো এই পরমাসুন্দরী আর কেহ নন, যেনো কোন এক হুরপরীর রুপধারিনী। এত অল্প বয়সে শান্তিপ্রিয় আলম রাজা মারা যাবেন, তা অনেকের জন্যে কল্পনাতীত ছিল। স্বামীহারা বিধবা স্ত্রীকে তাঁর বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকেই এই সন্তানহীন অপরুপাকে অন্যত্র বিবাহ দেয়া হয়। অন্যদিকে কামদার খানের মাতুলালয় ছিল পাড়–য়ার প্রসিদ্ধ জমিদার বাড়ী। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, দুই ঐতিহাসিক অচ্যুতচরণ চৌধুরী ও সৈয়দ মুর্তাজা আলীর মতে, ছাতক বাজার স্থাপিত হওয়ার আগেই পাড়–য়া অঞ্চলটি একটি প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে চালু ছিল। সৈয়দ মুর্তাজা আলী এই স্থানটিকে পান্ডুয়া নয় বরঞ্চ ‘পাড়–য়া’ নামেই চিহিৃত করেছেন। ‘আসলে লিন্ডসে বর্ণিত পান্ডুয়া বর্তমান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। ....ধলাই নদীর একদম তীর থেকে মাইল খানেক পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জনপদ পাড়–য়া। সিলেটের এককালীর প্রশাসক লিন্ডসে সাহেবের বর্ণনা পাঠ করলে সহজেই অনুমেয় বর্ণীত এই পান্ডুয়া এই পাড়–য়া । পুত্রহীন অবস্থায় কামদার খান মারা যাওয়ায় তাঁর ঘনিষ্টজন কেউ না থাকায় নিজ পৈত্রিক সম্পত্তির অংশসমূহ ছাড়াও উল্লেখিত পাড়–য়ার জমিদারীতে মাতুলালয় থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি আলী রাজার হাতে চলে আসে। দেওয়ান আলী রাজার ১৪ বছর বয়স এবং চাচাত ভাই দেওয়ান কামদার খানের ১৯ বছর বয়সের সময় নিজ ভাই আলম রাজা মৃত্যু পথে যাত্রা করলে তিনি বিষাদে মুমুর্ষ হয়ে পড়েন। লক্ষ্য করা যায়, এই পরিবারে আপনজনের মৃত্যু জন্ম জন্মান্তর ধরে যেনো আকস্মিকতায় ভরপুর। এমনি এক আকস্মিকতায় আলী রাজার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল।

আপন ভাই এবং চাচাত ভাইয়ের সকল সম্পত্তি ও তাঁর বিশাল এই জমিদারী এস্টেইট-গুলো যেনো প্রথমদিকে আলী রাজার জন্যে সামলানো একেবারে অসম্ভব ছিলো। ঐসময় হাসন রাজার পিতা আলী রাজার মাঝেও একটি জীবন-নির্লীপ্ততা দেখা দেয়Ñ প্রসঙ্গটিঁ পরে আলী রাজা অধ্যায়ে আলোচনা করা যাবে। যাইহোক আলী রাজা অত্যন্ত প্রভাবশালী জমিদার হিসেবে প্রতিষ্টিত বলে সিলেটে কালেক্টারগন তাঁকে যথেষ্ট সমিহ করতে শুরু করে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় সিলেটের কালেক্টার ছিলেন মি: হেউড। ১৮৫৯ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল এই দীর্ঘ ৭ বছর ধরে থাক্্ জরিপ চলে।

১৮৬৩ সাল পর্যন্ত এতদিন বড়লাটের এজেন্ট চেরাপুঞ্জি থেকে আসাম শাসন করতেন। ১৮৬৪ সালে শিলং শহরে আসামের রাজধানী স্থাপিত হয়। মি: টেইলার বদলি হয়ে যাওয়ায় পর কালেক্টার হয়ে আসেন পরপর মি: ড্রামন্ড ( ১৭৬৪-৬৫), মি: ওয়ালটন (১৮৬৫-৬৮) ও মি: ক্যাম্পেবেল (১৮৬৮-৭০)। ১৮৬৯ সালের ভূকম্পনের বেগ পাটনা থেকে বার্মা পর্যন্ত অনুভূত হয়। সিলেট শহরের গির্জার চুড়া, কাচারী গৃহ, সার্কিট হাউসের বাংলাঘর প্রভৃতি বহু দালানকোঠা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এই ভূকম্পনে যেমনি রামপাশার রনজিৎ সিংহের তৈরী প্রাচীর ফেটে বেশ কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ে ও দালানের ক্ষতিসাধন হয়, ঠিক তেমনি লক্ষনশ্রীর বাড়ীর সিমানা দেয়ালে বিরাট রকমের ফাটল-চিহৃ ও ভাঙ্গন ধরে। ১৫ বছর বয়স্ক দেওয়ান হাসন রাজার মনে এক গভীর ভাবনার দাগ কেটে যায়। ১৮৭১ সালের প্রথমভাগে সিলেটের শেষ কালেক্টার নিযুক্ত হন সাদারল্যান্ড সাহেব (১৮৭০-৭৪)। এই বছরই তরুন হাসন রাজার জীবনের উপর এক বড় ঝড় বয়ে যায়। প্রথমেই উনচল্লিশ (৩৯) বছর বয়স্ক বড়ভাই ওবায়দুর রাজার মৃত্যু তাঁকে ভীষনভাবে এক মৃত্যুভাবনায় ফেলে, ঠিক তার চল্লিশ দিনের মাথায় বাবা আলী রাজার মৃত্যু তাঁকে বিষাদের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।

এতদিন যাবৎ সিলেট ছিল ঢাকা বিভাগের কমিশনারের শাসনাধীন। ১৮৭৪ সালে সিলেটকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় ও আসামের সাথে যুক্ত করা হয়। আসাম চীফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ হিসাবে ঘোষনা দিলে সিলেটে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এবছরই বড়লাট নর্থব্রোক সিলেটবাসীদেরকে শান্তনা দেয়ার জন্যে সিলেটে আসেন এবং ওখানে একটি দরবার বসে। পিতা আলী রাজা দুনিয়াতে আর নেই। পিতার অনুপস্থিতিতে বড়োলাটের দরবারে পুত্র হাসন রাজার সেখানে হাজির হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। মৃত্যুর ক’মাস আগে বাবার সঙ্গ নিয়ে পুত্র হাসন রাজার দেখা হয় মি: সাদারল্যান্ড সাহেবের সাথে। সাহেব কিন্তু সেদিন বুদ্ধিদীপ্ত হাসন রাজাকে স্মরনে রেখেছিলেন। সে-যাইহোক সেদিন ১৮৭৪ সালে বড়লাটের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন তরুন সাহসী হাসন রাজা। সেদিন সমস্ত আসাম এবং সিলেটের ছোট ছোট রাজা এবং জমিদাররা সবাই গিয়ে উপস্থিত হন বড়লাটের দরবারে। মাত্র ২০ বছরের তরূন হাসন রাজাকে দেখামাত্রই কালেক্টার সাদারল্যান্ড সাহেব হাসন রাজাকে চিনতে ভুল করলেন না। একটি খোলা পালকি চড়ে, পালকিটির সামনের দিকে দু’জন লাঠিয়াল, চার জন বেয়ারা কাঁধে চড়ানো, তার ঠিক মাথার উপরে বাঁশের একটি বড় রঙ্গীন ছাতা। হাসন রাজার একপাশে পানদান, অন্যপাশে পিকদান হাতে নিয়ে দুজন বেয়ারা চলেছে, পিছনে পানির পাত্র নিয়ে আরেকজন এবং আরও ঘটিবাটির একটি বিরাট বহর। তাঁর দেহ সৌষ্ঠবে চমৎকৃত হয়ে বড়লাট নর্থব্রোক পরিচয় প্রদানকারী সাদারল্যান্ড সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন Who is this young gentleman? Where does he live? উত্তর আসে: at Sunamganj. বড়লাট একটা আশ্চর্য হয়ে বললেন: But he looks like a upcountry rajah. কর্মচারী প্রত্যোত্তরে বললেন: Origin of his family come from Oudh. They migrated to Bengal in sixteenth century.

ইংরেজির তরজমা হল: এই বহরের পরিবেশ দেখে বড়লাট জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই তরুন যুবকটি কে? মনে হচ্ছে উত্তরপশ্চিম এলাকার কোন রাজপুত্র’ ? বড়লাটকে সাদারল্যান্ড সাহেব জানালেন, ‘তিনি সুনামগঞ্জের পাড়াগাঁয়ের লক্ষণশ্রী পরগনার জমিদার আর কৌড়িয়া পরগনার অভিজাত জমিদার আলী রাজার পুত্র হাসন রাজা। ষোরশ শতাব্দিতে এরা অযোধ্যা থেকে পাড়ি দিয়ে এদেশে এসেছেন’। মঞ্চের কাছাকাছি আসলে পর হাসন রাজার সাথে বড়লাটের দৃষ্টি বিনিময় হয়। সম্ভ্রমের সাথে সাদারল্যান্ড সাহেব তাঁকে স্বাগত জানান এবং তাঁর জন্যে বিশেষভাবে আসন গ্রহনের ব্যবস্থা করা হয়। এই একই বছর ১৮৭৪ সালের অক্টোবর মাসে মি: সাদারল্যান্ড সিলেট ছাড়ার সাথে সাথে মি: এ,এল ক্লে প্রথম ডেপুটি কমিশনার হিসাবে কার্যভার গ্রহন করেন। কর্নেল আর,এইচ, কিটিং (১৮৭৪-৭৮) তখন আসামের প্রথম চিফ কমিশনার ছিলেন। শোনা যায় সুনামগঞ্জের উন্নয়ন বিষয়াদি নিয়ে ঐসময় হাসন রাজা শিলং সফর করেন এবং কর্নেল কিটিং এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। ( উল্লেখ্য কর্নেল কিটিং কর্তৃক দেয়া হাসন রাজাকে একটি সম্মানজনক সার্টিফিকেট তাঁর লক্ষণশ্রীর বাড়িতে বহুকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলদেশ স্বাধীণতার যুদ্ধের সময় বাড়িতে কে বা কারা লুটপাটের সময় অনেক জিনিসের সাথে সার্টিফিকেটটিও চিরদিনের জন্যে সরিয়ে নেয়।) ঐ সময় সারা সিলেটের শাসনকার্য্য সিলেট সদর থেকেই নির্ধারিত হত। কিন্তু এলাকার শাসনকার্য্যরে সুবিধার জন্যে ১৮৭৭ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমার সৃষ্টি হয় এবং ১৮৭৮ সালে করিমগঞ্জ ও হবিগঞ্জ মহকুমাও সৃষ্টি করা হয়। এই সময় হাসন রাজার জন্মভুমি সুনামগঞ্জে ব্রিটিশ সরকার বেশ কিছু সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যে শহরের এলাকাটি বন্যা সীমারেখার উপরে উত্তলিত করার উদ্দেশে হাসন রাজার স্বরাণাপন্ন হয়। যেহেতু তাঁর আবাস স্থলটি ছিলো মহকুমা সদরদপ্তরের ঠিক নিকটবর্তী এবং সর্বতোভাবে হাসন রাজা নিজে এলাকার উন্নয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বলে তিনি মি: ক্লে সাহেবের অনুরোধকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। তাঁর নিজের জমিদার এলাকার আওতাভূক্ত ঝাওয়া ও বাওনের আমন ক্ষেত এলাকা থেকে বিনামূল্যে প্রচুর মাটি এবং খনন কার্যে জনশক্তি সরবরাহ করলেন। তার ফলে কৃত্রিম উপায়ে এই দুটি এলাকা হয়ে গেলো দুটি কৃত্রিম বিল এলাকা: ঝাওয়া বিল এবং বাওন বিল। এরপর ১৮৮২ সালে দক্ষিন শ্রীহট্ট বা মৌলভিবাজারকেও মহকুমা করা হয়। মি: এ,এল ক্লের পর ডি,সি হয়ে আসেন মি: লটমন জনসন (১৮৭৮-৮৫)। মি: জনসন অত্যন্ত জনপ্রিয় ডি,সি ছিলেন। এই সময় সিলেট জুড়ে একটি আধুনিকতার ছুঁয়াচ লাগে। ১৮৭৮ সালে সিলেটে মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপিত হয়। সিলেট শহর থেকে রাজধানী কলকাতা ৩৩২ মাইল দুরত্বে ছিল আর শিলং ৭২ মাইল দুরবর্তী। সুনামগঞ্জকে মহকুমায় উন্নীতকরনের ঠিক বছর দুয়েকের ভিতরই হাসন রাজা একটি স্কুল স্থাপনে ব্রতী হন। এই সময়ই যুবক হাসন রাজার মনে প্রেমের অনুভূতির যেমন কাজ চলছিলো ঠিক তেমনি বৃহত্তর জনকল্যানে ব্রতী হবার আগ্রহে তাঁর ভেতরে উদ্দীপনাময় একটি উষ্ণ প্রবাহ বইছিলো ।

সিলেটের ডি,সি মি: ওব্রায়েনের (১৮৯৩-৯৮) সময়ই ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সিলেটের এক ভীষনাকার ভূমিকম্প হয়। এর পূর্বে সিলেটে এতবড় ভূমিকম্প হয়নি। এই ভূমিকম্পকেই আঞ্চলিক ভাষায় ‘বড় ভৈষাল’ নামে ডাকা হয়। আসামের চীফ কমিশনার মি: জে, এস, কটন বড়লাট লর্ড এলগিনকে টেলিগ্রাম করেন যে, সমস্ত সিলেট ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ভূমিকম্পে সিলেটের অনেক প্রাচীন কীর্তি একেবারে লোপ পায়। হাসন রাজার তখন ৪৩ বছর বয়স। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে লক্ষনশ্রীর বাড়ীর চারপাশ ঘেরা দেয়ালের অবশিষ্টাংশ সম্পূর্নভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। তাঁর ধ্বংসাবশেষ এখনো মাটি খনন করলে দৃশ্যমান হয়ে উঠে হাসন রাজার বাড়িতে। ঠিক তেমনি রামপাশায় তাঁর বাড়ীঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে এবং বাড়ীর এলাকার চারপাশ ঘেরা দেয়ালের সামনের দিকটা এখনো কোনরকম টিকে আছে। সিলেটবাসীগন বহুবছর যাবৎ ১৩০৪ বাংলার (১৮৯৭ খ্রি:) ভূমিকম্পকে রেফারেন্স বছর হিসাবে ব্যবহার করতেন।

জানা যায় এ সময় হাসন রাজা তাঁর পুত্রগনসহ কয়েকবারই ঢাকা সফর করেন। কিন্তু হাসন রাজার মনে তখন বড় বেশী একটি হাহাকার। মা হুরমতজান বানু ১৯০৪ সনে ইহলোক ত্যাগ করেন। মাকে তাঁর নিজের জন্যে তৈরী কবরস্থানে শুইয়ে দিয়ে তাঁর চারপাশে প্রতি নিয়ত ঘুরাঘুরি করতে শুরু করেন। তখনই তিনি যেনো কবরের স্থানটিকে বেশী ভালোবাসতে শুরু করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠন করা হয় এবং লর্ড কার্জন সকল জমিদারদেরকেও এ সংবাদটি পাঠিয়ে জমিদারী দির্ঘায়ু করার আশ্বাস দিলেন। ঢাকাকে করা হলো রাজধানী।

“১৯০৫ সালে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিভাগ ও আসামকে নিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম (বঙ্গসাম) নামে নুতন প্রদেশ গঠন করা। বৃহত্তর সিলেট জেলা এ প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। এই বিভাজন মনে প্রাণে মেনে নিতে না পেরে সিলেটবাসী ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ক্রমাগত বিক্ষোভের ফলে ১৯১১ সালে ১২ই ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক দিবসে দিল­ীতে আয়োজিত দরবার অনুষ্ঠানে বঙ্গ ভঙ্গ রদ ঘোষিত হলে বৃহত্তর সিলেট জেলা পুনরায় আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।”
গণিউর রাজার তথ্যকথার দলিলে জানা যায় হাসন রাজা ঐ সময় দিল­ীর আয়োজিত দরবারে হাজির হওয়ার জন্য বিশেষ একটি দাওয়াত পেয়েছিলেন বিধায় ১৯১১ সালে নভেম্বর মাসে দিল­ী সফরে রওয়ানা দিবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে কলকাতা থেকে দিল­ীতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরের ঘোষনা দেয়া হয়। হাসন রাজা মেনে নিতে পারলেন এই স্থানান্তরের সিদ্বান্তটি। তাই এই বছর হাসন রাজার সফরটি কলকাতা পর্যন্তই সীমিত থেকে যায়। দিল­ীর অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে তিনি সুনামগঞ্জে ফিরে আসেন।
পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের জীবনকাল মাত্র ছয়টি বছর ছিল। সিলেট পূনরায় আসামের জেলারুপে পরিগনিত হয় ১৯১২ সালের ১লা এপ্রিল হতে। ১৯১৪ সালে কবির জীবদ্দশায় তিনি একটি মহাযুদ্ধের দামামা শুনতে পান। মানুষের মনে তখন ভয় ভীতির সঞ্চার চারদিকে ব্যাপ্ত আর হিংশ্রতার আগুন চারদিকে প্রজ্জলিত হয়ে উঠে। ১৯১২ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তখন স্যার আর্চডেইল আর্ল আসামে চিফ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৪ সালের ঠিক আগে বার কি তের সালের দিকে একসময় হাসন রাজা শিলং সফর করেন। ঐ সময় আর্লের সাথে এক সৌজন্য সাক্ষাতের সময় সাথে ছিলেন তাঁর দুর সম্পর্কীয় এক ভাগ্নে ইংরেজ আমলের বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম মহাযুদ্ধের অস্থির অবস্থা আর ভয়াবহতা হয়তো কবিকে ভাবিত করে তুলেছিল। আনুমানিক ১৯১৪ সালের দিকে কোন একটা মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে হাসন রাজা তাঁর জীবনের শেষ কলকাতা সফরটি সম্পন্ন করেন। সফর শেষে পুত্র গনিউর রাজার কাছে বর্ণীত: ‘কলকাতার উপরও যেনো মহাযুদ্ধের একটি কালো ছায়া ছাইয়ে আছে।’ পরে লোকমুখে প্রচারিত প্রথম মহাযুদ্ধের খবরাখবর শুনে দেশে দেশে মানুষের হাহাকার ও প্রানহানীতে কবিকে মরন পথের তলদেশে নিয়ে যায়। সেই সময় হাসন রাজার মাঝে কোন রাজনৈতিক চেতনাবোধ কাজ করেছিল কিনা সেটি অবশ্যি আমরা কিছুটা তলিয়ে দেখতে যাবো ‘হাসন রাজার রাজনৈতিক চিন্তধারা ও তাঁর বাঙ্গালী জাতিসত্ত¡াবোধ’ পরিচ্ছদে। স্যার নিকলাস ডড বিটসন বেল ১৯১৮ সনের ৩ জানুয়ারীতে আসামের চিফ কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। পাদরি ধরনের এই চিফ কমিশনার তাঁর দায়িত্ব গ্রহনের পরপরই সুনামগঞ্জ সফর করেন। সুনামগঞ্জ সফরে এসে এই মানুষটি ও হাসন রাজার মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে তখন থেকেই তাঁদের দুজনার একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে যা আমরা গনিউর রাজার বিবরন থেকে খবর পাই।

১৯২১ সালের ৭ই মার্চ মৌলভিবাজারের যোগীডহরে আসাম প্রাদেশিক খেলাফত কনফারেন্স অনুষ্টিত হয়। সভাপতিত্ব করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। একই বছরে ১৯২১ সালের ২৯ অগাষ্ট সিলেটের শাহী ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্টিত হয় এক বিরাট জনসভা। সভায় বক্তৃতা করেন মহাত্মা গান্ধী, মওলানা শওকত আলী ও মওলানা মোহাম্মদ আলী প্রমূখ সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ। সারা ভারত জুড়ে অখন্ড ভারতের পক্ষে-বিপক্ষে একটি জন গুঞ্জরন শুরু হয়েছে তখন, সেই সময় আমাদের কবির মধ্যেও এই প্রৌঢ় বয়স্কালে অখন্ড ভারতের জন্যে যেনো একটি মমত্ববোধ সার্বজনিন আকুতির মতো দেখা দিয়েছিল বলে পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়। সিলেটের সেদিনকার সভায় উপস্থিত থাকার জন্যে একটি দাওয়াতও তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন অসুস্থতার কারনে তার অবস্থা খুবই সূচনীয়। যেতে পারননি সে সর্বভারতীয় অনুষ্টানে। এমনি অবস্থায় তিনি তখন সুনামগঞ্জে। এর মাস দুয়েক পর এমনই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন যে বাধ্য হয়ে চিকিৎসার আশায় সিলেট যেতে হয় নভেম্বর মাসের পয়লাদিকে। ঐসময় একাধারে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর শেষ কপর্দক সায়-সম্পত্তি এমন কি বাড়িঘর পর্যন্ত উত্তরপুরুষগনের মধ্যে দানপত্র করতে করতে আরো মুমূর্ষ অবস্থায় পৌছেন। তঁাঁর শেষ দু’টি বছর সুনামগঞ্জের লক্ষনশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামের বাড়িতেই কাটলো। এ বছরই স্যার বিটসন বেল আসামের চিফ কমিশনারের দায়িত্ব থেকে গভর্নরে উন্নীত হলেন। তিন মাস দায়িত্বে থাকার পর স্যার উইলিয়াম সিনক্লেয়ার ম্যারিস গভর্ণরের পদে অধিষ্টিত হন। সিনক্লেয়ারের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়েই ১৯২২ সালের ২৩ মার্চে উত্তেজনাপূর্ন কানাইঘাট লড়াই সিলেটে এক জনকম্পনের সৃিষ্ট করে আর ঐ একই বছর সারা ভারত খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে যখন তুঙ্গে, তখন ইংরেজী বছরের শেষ-প্রান্তে ১১ অগ্রাহায়ন ১৩২৯ বাংলায় আমাদের মরমি কবি হাসন রাজা এই নশ্বর পৃথিবীর মাটির পিঞ্জিরার সকল বাধনকে ছিন্নভিন্ন করে চিরতরে রওয়ানা দেন চিরদিনের বাড়ি তাঁর অনেক আঁকাঙ্কিত প্রেমাস্পদ একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ-অভিমূখে।

তথ্যনির্দেশ ও টীকা

১) খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা, দেওয়ান বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
২) দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মরমী কবি হাসন রাজা, নবরাগ প্রকাশনী, ঢাকা
৩) The Hon. Robert Lindsay, Lives of the Lindsays, An anecdotes of an Indian Life
৪) ফজলুর রহমান, সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ, বৈশাখ, ১৩৯৮ বাংলা
৫) খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা, ‘আমার সাহিত্যিক জীবনের অভিজ্ঞতা,’(দেওয়ান সমশের রাজা সম্পাদিত)
৬) খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা, দেওয়ান বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৭) দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, প্রসঙ্গ হাসন রাজা (ড. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত) ১৯৯৮, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৮) ড. এস, এম ইলিয়াছ, “খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজার পত্রাবলী”
৯) খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা, গনিউর রাজার তথ্যকথা বই নম্বর ২
১০) ফজলুর রহমান, সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ, বৈশাখ ১৩৯৮ বাংলা
১১) রবার্ট লিন্ডসে, ‘সিলেটে আমার বার বছর’, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট, দ্বিতীয় সংস্করন: মার্চ ২০১৩
১২) দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সোনাঝরা দিনগুলি, আত্মজীবনী, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৭
১৩) দেওয়ান আলমনুর রাজা চৌধুরীর মূখবন্দী ২০১১