সমকালীন বিশ্বে হাছন রাজার প্রাসঙ্গিকতা

পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা মানুষে মানুষে আন্তঃযোগাযোগের উপায় কী? জানি, এ প্রশ্নটি অন্তত বিশ-পঁচিশ বছর বয়সি যে কোনো তরুণের কাছে হাস্যকর প্রশ্ন হিসেবেই চিহ্নিত হবে আজ। প্রশ্নকারীর দিকে বিস্ময়-বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে সে বলে উঠবে একটি মাত্র শব্দ ‘ইন্টারনেট’! কেবল তো তথ্যের আদান প্রদান নয়, কেবল খোঁজ-খবরের জন্যে নয়, চিন্তারও তো যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কিন্তু যে যুগে ইন্টারনেট ছিল না, কী হতো কখন? খুব বেশী অতীত হয়ে যায়নি সে সময়। তখন টেলিফোন আর ডাক যোগাযোগই ছিল ভরসা। কিন্তু তার আগে? তারও আগে? কবুতরের পায়ে খবরের টুকরো বেঁধে দেয়া তো সকলের জন্যে চালু ছিল না। সে তো বাদশাহী কারবার। অথবা যদি আরও খোলাসা করে বলি, কী করে যোগাযোগ হতো ইরান দেশের কোনো মানুষের সঙ্গে লক্ষণশ্রী গ্রামের কোনো মানুষের কিংবা রামপাশা থেকে জার্মানির কারও সঙ্গে? অথবা, সুনামগঞ্জের সঙ্গে কলকাতা কিংবা ইতিহাসের সুদূর উজ্জয়িনী বা কলিঙ্গ নগরের? সময়ের হিসেবে যোগাযোগ সহজ নয়। সহজ নয় আরও এক হিসেবে, হয়ত একজন পÐিত জ্ঞানী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত আর অন্যজনের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাই নেই। কেমন করে যোগাযোগ হয় তাঁদের? দেখা হয় নাই, চিঠি বিনিময় হয় নাই, একে অপরকে জানার সুযোগ হয় নাই, মহাকালের হিসেবে একেকজন একেক সময় জন্মেছেন তবু তাদের যোগাযোগ হয়ে যায়! জগতকে দেখায় ও দেখানোয়; জীবনকে বোঝায় ও বোঝানোয় আর সত্যকে অনুভবে ও সন্ধানে তাদের আন্তঃযোগাযোগ ঘটে যায়। তারা যেন একে অপরের আত্মীয় হয়ে ওঠেন।

সময় কিংবা স্থানের দূরত্ব তাদের চিন্তার ঐক্য প্রকাশে বাধা হয়ে উঠতে পারে না। যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি, ‘ওয়াইজ ম্যান থিংস অ্যালাইক!’ এই জ্ঞানীরা নানা দেশে, নানা কালে তাদের চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সকলেই যে সেই জ্ঞানের অনুভবকে প্রকাশ করতে পেরেছেন তা নয়। কোনো জ্ঞানী তাঁর সমকালে জ্ঞান প্রকাশের অপরাধে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। লাঞ্ছনা শুধু নয়, রীতিমত মৃত্যুদÐ ধার্য হয়েছে তাদের জন্য। হয়ত বহু যুগ পার হবার পর অজ্ঞানীদের বোধোদয়ের মধ্য দিয়ে পুনরায় আদৃত বা নমস্য হয়েছেন তারা। দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন অনেকে, হচ্ছেন আজও। আপোষ করেছেন কেউ কেউ; অনুচ্চারে কেটে গেছে বাকী জীবন। মূল কথা হলো, জ্ঞান উড়ছে বাতাসে, জ্ঞান প্রকাশ পাচ্ছে উচ্চারণে, জ্ঞান প্রকাশিত হচ্ছে কাগজে কিংবা ভার্চুয়াল মিডিয়ায়। আজ থেকে নয়, সভ্যতার শুরু থেকেই এটা চলমান। লক্ষ কোটি মানুষের চারপাশে ঘুরছে জ্ঞানের ঘূর্ণি। কেবল কান পেতে শুনবার, চোখ মেলে দেখবার, হৃদয়ে অনুভব করবার মতো মন যার আছে সে-ই সে ঘূর্ণিতে নিজেকে হারায়। ‘বলাকা’য় যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে/ অলক্ষিত পথে উড়ে চলে/ অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফুট সুদূর যুগান্তরে।’ সেই সব বাণী শুনতে কি পায় সবাই? পায় না তো!

যার যার সময় থেকে, যার যার ভৌগোলিক সীমানায় থেকে যার যার মতো জীবন-সত্য বাণীতে রূপান্তরিত হয়ে পৃথিবীর মহাকালের পথে যখন গুঞ্জরিত হয় তখন এক সময় আমরা আবিষ্কার করি, কী করে মিলে গেল পৃথিবীর এক প্রান্তে থাকা কোনো মহৎ-প্রাণের উপলব্ধিজাত জীবন-সত্য অন্য প্রান্তের মহৎ-প্রাণের সঙ্গে! অথচ তাদের দেখা হয় নাই পরস্পরের সঙ্গে কোনো কালে। গ্রন্থ বিনিময় হয় নাই। প্রচার হয় নাই তাৎক্ষণিক তবু মিলে যায়Ñ মহৎ-প্রাণ, জ্ঞানীর বাসনা, দার্শনিকের ভাবনা অন্য কোনো মহৎ বা জ্ঞানী বা দার্শনিকের জীবনবোধের সঙ্গে।

যখন হাছন রাজা লেখেন :
গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতে ডুরি।
হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি\
মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
যেমন ফিরায়, তেমনে ফিরি, এমনি ডুরির ফান্দা\

মনে পড়ে, একাদশ শতকের আরেক দার্শনিক ও নানা প্রতিভার অধিকারী কবি ওমর খৈয়ামকে। দু’জনের সময়কাল, স্থানকাল ভিন্ন, দু’জনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাত্রাও ভিন্ন তবু জীবন-সত্য আবিষ্কারে তাদের কেমন অভিন্ন ঐক্য!

খৈয়াম লিখেছিলেন :
আমরা দাবা খেলার ঘুঁটি, নাইরে এতে সন্দ নাই!
আসমানি সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই।
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব,
খেলার শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!
[১৬১ সংখ্যক রুবাই, কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত]

উপনিষদে রয়েছে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ ‘আত্মাকে জানো’। ভারতবর্ষের উল্টো প্রান্তে সক্রেটিস বলেছেন, কহড়ি ঞযুংবষভ,Ñ ‘নিজেকে চেনো’ আর সেই সকল সময় পার হবার বহু বছর পর, অজপাড়াগাঁয়ের এক অশিক্ষিত জমিদার বললেন, ‘হাছন রাজায় আপন চিনিয়া এই গান গায়।’ তাঁরও মৃত্যুর ঠিক এক বছর পূর্বে কলকাতা তোলপাড় করে উচ্চারণ করছেন আরেকজন তরুণ বিদ্রোহী ‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!Ñ’ কেউ কাউকে চেনে না, কেউ কারো লেখা পড়েনি অথচ মিলে যাচ্ছে সকল উপলব্ধি, সকল বাসনা! মিলে যায়, সুনামগঞ্জের ‘কেবা আসে কেবা যায়, এ দেহের মাঝার।’ এর সঙ্গে কুষ্টিয়ার ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’ মিলে যায়, ‘অচিন পাখি’ আর ‘মন মনিয়া’র ডাক। মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায় চিরকালের প্রশ্ন, চিরকালের সত্য-সন্ধান। হাছন রাজা প্রশ্ন করেন যখন, ‘কোথায় ছিলায় কোথায় আইলায় কোথায় তোমার ঘর। / কোনখানে থাকো তুমি জানো নি খবর রে\’

এ প্রশ্ন খৈয়ামেরও :
স্রষ্টা যদি মত্ নিত মোরÑ আসতাম না প্রানান্তেও
এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্ছা নেই মোটেও।
সংক্ষেপে কই, চিরতরে নাশ করতাম সমূলে
যাওয়া-আসা জন্ম আমার, সেও শূণ্য শূণ্য এও!
[১৩ সংখ্যক রুবাই, কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত]

অন্যদিকে, লেভ তল্স্তোয়, যিনি :
‘আ-কৈশোর জীবন-জিজ্ঞাসার প্রচÐ তাড়নায় সত্য সন্ধান করতে গেছেন অস্থানে-কুস্থানে-ধর্মক্ষেত্রে-কুরুক্ষেত্রে-সমবেত যুষুৎসবের মধ্যেÑ সর্বত্র খুঁজেছেন জীবনকে, মানুষকে, সেই সঙ্গে জীবন-মৃত্যু, ঈশ্বর-নিরীশ্বর, ইহকাল-পরকাল নিয়েও চিন্তাকুল, প্রশ্নাকুল হয়েছেন। একটি ছেঁড়া কাগজের পৃষ্ঠায় লেখা তাঁর এক অভিনব দলিল পাওয়া গেছে, তাতে ৬টি অজানা প্রশ্ন :

১. আমি কেন বেঁচে আছি?
২. আমার অস্তিত্বের কারণ কি? অন্যেরই বা বেঁচে থাকার কি কারণ?
৩. আমার বা আরও অনেকের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি?
৪. আমার ভেতরকার শুভ-অশুভ শক্তির তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য কি?
৫. আমাকে কিভাবে বেঁচে থাকতে হবে?
৬. মৃত্যু কি? কেমন করে তার হাত থেকে বাঁচা যায়?
[লিও টলস্তয়, অজয় কুমার ঘোষ, নন্দনতত্ত¡ জিজ্ঞাসা, সম্পা: তরুণ মুখোপাধ্যায়]

হাছন রাজার মনেও কি বারবার ঘুরপাক খায়নি এমনই ছয়টি প্রশ্ন? সেই দূর বরফের দেশের লম্বা কোট পরিহিত তলস্তোয় আর ভাটির বৃষ্টি¯œাত ভ‚গোলে লুঙ্গি পরা হাছন প্রশ্ন-বন্ধনে কেমন সহোদর হয়ে ওঠেন!
কিসের আশয় কিসের বিষয়, কিসের জমিদারি।
কিসের হয় রামপাশা, কিসের লক্ষণছিরি\


অথবা,
হাছন রাজা বলে আমার কি লিখছে ললাটে।
যা লিখিয়াছে নিরঞ্জন সে কি আর মিটে রে\

এমন গভীর জীবনবোধ খৈয়ামের এসেছিল নানাবিধ কাজের অবসরে। কবিত্ব তাঁর পেশা ছিল না। জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিত, ভ‚গোল, সময়বিদ্যা ইত্যাদি নানান চিন্তাধর্মী মগজ-খাটানো কাজের ফাঁকে ফাঁকে রুবাইয়ে অদৃষ্টের প্রতি প্রশ্ন তুলে হয়ত জীবন-রহস্যের সন্ধান খুঁজে নিতে চেয়েছেন তিনি। আর বিশাল জমিদারির তদারকি করতে করতে বিপুল ভোগ ও অনাচারের জীবনে বিপন্ন বোধ করে প্রাচীন খ্রিষ্টীয় ধর্ম বিশ্বাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তলস্তোয়। মুক্তি খুঁজেছেন ধর্মে, নিপীড়িত প্রজার দুঃখ মোচনে, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। শিল্পের স্বরূপ এ নিজের ফেলে আসা যাপিত জীবনাচারের বিপরীতে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে নতুন এক জীবনবোধের উচ্চারণে চমকে দিলেন গোটা জগতকে! যাপিত জীবনের সকল পাপক্ষয়ের জন্যে প্রায়শ্চিত্যের আয়োজনই করলেন যেন।

জীবনের বিশেষ এক পর্যায়ে এসে এমন পরিবর্তন পৃথিবীব্যাপী তো ঘটছেই। বিশেষত যাপিত জীবনের চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হবার পর। যেমনটা ঘটেছিল কাজী নজরুল ইসলামের বেলাতেও।

হাছন রাজা যখন লেখেন :
লাগল রে, পিরিতের নিশা, হাছন রাজা হইল বেদিশা।
ছাড়িয়া দিব লক্ষণছিরি, আর রামপাশা\
ছাড়িয়া যাব আরিপরি, আর ছাড়ির লক্ষণছিরি।
বন্ধু কেবল মনে করি জঙ্গল করব বাসা\

তখন জানতে ইচ্ছে হয়, কি কি ত্যাগ করলেন হাছন? অবাধ নারী-সঙ্গ? হাতি-ঘোড়া-কবুতর নিয়ে বিলাসিতা? আর নিজের বাড়িঘরের যতœআত্তি? ‘বন্ধু কেবল মনে করি জঙ্গল করব বাসা\’Ñনা, জঙ্গলেও যাননি হাছন। তাঁরই নাতি দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ‘দেওয়ান হাসন রাজা’ প্রবন্ধে জানিয়েছিলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় হাছন রাজার পিতা আলী রেজা স্ত্রীর সম্পত্তিসহ প্রায় তিন লক্ষ বিঘা জমির মালিক ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হাছন রাজা সেই বিপুল সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করতে পেরেছিলেন কি আদৌ? তলস্তোয় যেমন প্রায়শ্চিত্য করতে চেয়েছেন শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে তেমনিভাবে হাছন তাঁর প্রজাদের জন্যে উন্নয়নমূলক কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কি? কেবল ‘পরের মন্দ ছাড়িয়াছি দোজখেরি ডরে।’Ñ এতেই সীমাবদ্ধ থাকেন তিনি? ঊনত্রিশ বছর বয়সে যেমন রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেছিলেন বুদ্ধ, স্ত্রী-পুত্র-রাজব্যাসন সব ছেড়ে পথে নেমেছিলেন মানুষের মুক্তির অন্বেষায় তেমনি করে সংসার ত্যাগ করতে পারেননি হাছন। কেননা ততদিনে, ‘পুতের দাড়ি পাকিয়ে গেল নাতির উঠিল রেকি,/ এখনও সংসারী কামে রহিলায় ঠেকি\’

তবে সংসারের সেই ঠেকার জীবন আগের মতো থাকেনি। জাঁকজমক, বিলাসে হয়ত রাশ টেনেছেন। সেকি কেবল বয়সজনিত কারণে, যেমন সকলেরই ঘটে! না, তেমন করে নয়। এই জায়গাতেই অন্যদের সঙ্গে হাছনের প্রধান পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়।

হাছনের নতুন জীবনোপলব্ধি কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সৃষ্টিশীলতায় রূপান্তরিত হতে থাকে। ‘অশিক্ষিত’ হাছন মুখে মুখে প্রচার করতে থাকেন নব-উপলব্ধির বয়ান। নিজের মুখের সামনেই আয়না ধরেন, নিজেই নিজের নব রূপে চমকে ওঠেন! এই চমক কেবল রূপ দেখে নয়, এই চমক তাকে এলোমেলো করে দেয় অন্তরের তাবৎ পরিবর্তন দর্শনে। জীবনকে যেভাবে দেখে এসেছেন এতকাল ধরে, সেই চেনা জীবন অচেনা ঠেকে তাঁর নিজের কাছেই। ফলে, কখনো তাঁর মন ‘উদাস’ হয়ে ওঠে, কখনও ‘দিওয়ানা’, কখনও ‘আউলা’ আর শেষ পর্যন্ত নিজেকেই মনে হয় ‘বাউলা’! তারপর এক সময় যখন আত্মবোধন ঘটে তাঁর এবার কাঁধে তুলে নেন নতুন দায়িত্ব। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন লিখেছিলেন তাঁর ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ প্রবন্ধে, ‘যে এতদিন দর্শক ছিল সে হল প্রদর্শক, দ্রষ্টা হয়ে বসলো দ্বিতীয় ¯্রষ্টা। অরূপকে রূপ দিয়ে, অসুন্দরকে সুন্দর করে, অবোলাকে সুর দিয়ে, ছবিকে প্রাণ, রঙহীনকে রঙ দিয়ে চললো মানুষÑ’ হাছনও চললেন সেই পথে। আসলে প্রকৃত বাউল হবার মতো উপায় ছিলো না হাছন রাজার। তাঁর দৌহিত্র দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সে বিষয়ে স্পষ্টই জানিয়েছেন। বাউল হবার জন্যে নির্দিষ্ট আচারগুলো পালন করেননি হাছন। ‘বরং উল্টোদিকে তিনি চিশ্তিয়া তরীকার সৈয়দ মাহমুদ আলী বলে পাঞ্জাব থেকে আগত এক পীর সাহেবের কাছে মুরীদ হয়েছিলেন এবং আজীবন তাঁর দীনাতিদীন ভক্তরূপে তাঁর চরণ-সেবা করেছেন।’

তাহলে জীবনের কী প্রদর্শন করলেন হাছন? অবলাকে কোন সুরে বাঁধলেন? রঙহীন জীবনের কোন অংশকে রঙিন করে তুললেন তিনি? কাল মার্কসের নন্দন বিশ্ব নিয়ে তাঁরই একটি উক্তি প্রচলিত রয়েছে, ‘একটি অসংবেদনশীল কানের কাছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সংগীতও অর্থহীন।’ হাছন প্রদর্শন করলেন এমনই এক জীবন-সত্য একদম নিজের মতো করে। শুধু বললেন না, রীতিমত ‘কিরা-কসম’ দিয়েই বললেন,Ñ ‘অপ্রেমিকে গান শুনিলে কিছুমাত্র বুঝবে না। / কানার হাতে সোনা দিলে লাল ধলা চিনবে না\’ আরও দূর অতীতে প্রাচীন ভারতের মহাকবি কালিদাস বলেছিলেন, ‘অরসিকেষু রসস্য নিবেদনং শিরসি মা লিখ মা লিখ।’ অর্থাৎ ‘অরসিকের কাছে রস নিবেদন করতে যাওয়া দুর্গতি।’ হাছন বলেন :
আমি করি রে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না।
কিরা দেই কসম দেই আমার বই হাতে নিবে না\
...
আমার গান শুনবে না যার প্রেম নাই জানা\

পুনরায় সহোদর হয়ে ওঠেন মহাকবি কালিদাস, কার্ল মার্কস আর হাছান রাজা!
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সমকালীন বিশ্বে হাছনের এই জীবনোপলব্ধির কার্যকারিতা কতখানি? বিশেষত যে বিশ্বে ‘আমিত্বের’ আস্ফালন চলছে ব্যক্তিতে; রাষ্ট্র-যন্ত্রে সেখানে হাছনের অবস্থান কোথায়?

হাছন লিখেছিলেন :
আমি আমি বলে যারা, বুঝে না বুঝে না তারা।
লাগিয়েছে সংসারি বেরা, মূর্খতা ছুটিছে না রে\

‘মূর্খতা’ ছোটানোর আহবান? এক অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নেয়া হাছন নিজেই তো সেই মূর্খের দলভুক্ত ছিলেন। অন্য অর্থে, জীবনের গভীরতম পাঠ গ্রহণের পর এবার নিজেই ‘পিরিতের নেশায়’ হতে চাইছেন ‘বুদ্ধিহারা’। এবার সকল ‘আমিত্ব’ ছেড়ে, হৃদয়ে যে আগুন জ্বলছে, যে আগুন সুরমা গাঙ্গের পানিতেও নেভে না সেই আগুন নেভানোর আশায় ‘তার রঙ্গে’ মিশতে চান। ঠিক এখানেই সমকালীন বিশ্বের যাপিত জীবনের সঙ্গে হাছনের বিরোধ তৈরি হয়। ‘আমিত্ব’ ছেড়ে প্রেমিক হওয়ার বাসনা বন্ধ দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। আধুনিক ডিজিটাল এই বিশ্বে কে খুলবে সেই বন্ধ দরজা? হাছন তো স্পষ্টই উচ্চারণ করেন, ‘অপ্রেমিক তো মানুষ নয় রে, জীবিত থাকতে সে মরা\’ প্রতিযোগিতায় পূর্ণ এত ভোগের, ক্ষমতার উল্লম্ফনে আক্রান্ত বিশ্বে ‘অপ্রেমিক জীবিত’দের হুংকারে হাছনের উচ্চারণ ক্রমশ চাপা পড়ে যায়।

সুরমা-কাপনার জলবিধৌত ‘রামপাশা’, ‘লক্ষণছিরি’, ‘রাজাগঞ্জ’Ñএ সীমাবদ্ধ হাছনের জীবনে ‘পুঁজিবাজার’ শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ছিল না। চিনতেন কেবল ‘প্রেমবাজার’, আর ‘ভববাজার’। সেই বাজারের ক্রেতাদেরও বিলক্ষণ চেনেন তিনি,Ñ ‘সুবুদ্ধি ও সাধু যারা, প্রেমবাজারে যায় তারা। / নির্ব্বুদ্ধিরা ভববাজারে, বেগার খাটিয়া মরে রে\’ মনে পড়ে, প্রকৃত ক্রেতা বা ‘গাহক’ ছাড়া ‘কানার হাট-বাজারে’ কোন ধনই বিক্রি করতে রাজি ছিলেন না লালন ফকিরও।
এ কথারই অন্যরকম প্রকাশ ঘটেছিল নিভৃতচারী এক বাঙালি কবির লেখায়। ট্রাঙ্কে লুকিয়ে রেখেছিলেন দিনের পর দিন সেব উপলদ্ধিজাত শব্দমালা। লিখেছিলেন, জীবনানন্দ দাশ, ‘জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।’ ‘সুবুদ্ধি’ আর ‘জ্ঞান’ তো সমান্তরালই। আর খৈয়ামও তো আফসোস করেই বলেছিলেন, ‘বলতে পারো, অসার শূন্য ভবের হাটের এই ঘরে / জ্ঞান-বিলাসী সুধীজনের হৃদয় কেন রয় পড়ে?’ [৩১ সংখ্যক রুবাই, কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত]
সুবুদ্ধিহীন, অসাধু কিংবা ‘অপ্রেমিক জীবিত’দের কুচক্রে নিউক্লিয়াস বোমার হুমকি সাইরেন বাজায় মননে-মগজে; শরণার্থীর ক্লান্ত পায়ের ছাপ বাড়তেই থাকে অজ্ঞাত ভ‚মিতে; অসহিষ্ণুতার তীব্র কোলাহলে, ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারে; সেলফির উন্মাদনায়; ইন্টারনেটের রঙিন চক্রজালে ক্রমশ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে প্রেমবাজার। তখন ক্ষয় হতে থাকা বুদ্ধিতে ধূসর অতীত থেকে মনে পড়ে ‘যেখানেতে প্রেমিকেরা প্রেমের আলাপ করে’, সেখানে, তাদেরই অন্তরে বসতি গেড়েছিলেন একজন, ভোগের প্রেম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রূপান্তরিত হয়েছিলেন অনন্য এক প্রেমিক সত্তায় আর নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন :

হাসন রাজা নিমন্ত্রণ করে, আইসো রে ভাই প্রেমবাজারে।
তুমি আমি সব মিলিয়ে প্রেম বিলাব ঘরে ঘরে\
হাসন রাজা যুক্তি করে, প্রেমিক চলো যাই নগরে।
অপ্রেমিক পাইলে পরে, ধরিয়ে আনব প্রেমবাজারে\

ষাটের দশকের কবি শহীদ কাদরীও কি এমনই চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, শুধু গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ করবে দিনরাত! এভাবেই কি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় মহাকালের পথ-পরিক্রমায় সুবুদ্ধিজাতদের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা?

ভববাজারের রঙিন আলোকছটায় নিয়ত পণ্যের হাতছানির প্রতিযোগিতায় বিহŸল মানুষ ‘প্রকৃত প্রেমিক’ হয়ে উঠুক। ঘরে-ঘরে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে দূরত্ব আর অবিশ্বাসের বদলে প্রেমের বন্ধন মজবুত হোক আর সুবুদ্ধি ও সাধুজনেরা কোলাহলে পূর্ণ পুজিবাজারের বদলে গড়ে তুলুক নিভৃত এক প্রেমবাজার। উল্টো করে বলা যায়, এই বিপন্ন বিশ্বে ‘প্রকৃত প্রেমিকেরা’ই এবার ‘প্রেমবাজার’-এর স্থপতি হিসেবে হাছন রাজাকে নিমন্ত্রণ জানাকÑ তাতে যদি মানবজন্মের মুক্তি মেলে! #

তথ্যসূত্র :
বাউল-ফকির পদাবলি হাসন রাজা, সুমন কুমার দাশ সম্পাদিত, ২০১৬, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা।
‘দেওয়ান হাসন রাজা’, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, প্রসঙ্গ হাসন রাজা, সম্পাদনা : ড. আবুল আহসান চৌধুরী, ১৯৯৮, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৬২, রূপা, কলকাতা।

ড. ফারজানা সিদ্দিকা
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
শাহ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ৩১০০।