হাসন দর্শনে রবীন্দ্র মুগ্ধতা
দর্শনচেতনার সাথে বাংলাগানের সংযোগ ঘটিয়েছেন যে ক’জন মরমী সাধক তাদের মধ্যে লালনের পরই উচ্চারিত হয় হাসনের নাম। তাঁর গানে মুগ্ধ করেছিলো আরেক জমিদার নন্দন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। এই মুগ্ধতা অনেকস্থানেই উল্লেখ করেন কবিগুরু।
ছিলেন জমিদার নন্দন। অথচ নিজের গানে লিখেছেন- আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়। বাউলদের স্বভাবসুলভ বিনয়বশত নিজেকে কিছু নয় বলে দাবি করলেও বাংলাগানের অনেক কিছু হয়েই থেকে গেলেন মরমী গানের সাধক হাসন রাজা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাসন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষনটি পরবর্তীতে 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভাষণে হাসন রাজা সম্পর্কে কবিগুরু বলেন- "পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন-
'আমি হইতে আল্লা রছুল, আমি হইতে কুল।
পাগলা হাছন রাজা বলে, তাতে নাই ভুল।।
আমা হইতে আসমান জমিন আমি হইতেই সব।
আমি হইতে ত্রিজগত, আমি হইতে সব।।
আমি হইতে সাউয়াল, আমি আখের জাহের বাতিন।
না বুঝিয়া দেশের লোকে, বাসে মোরে ভিন।।
আমা হইতে পয়দা হইছে, এই ত্রিজগত।
গউর করি চাইয়া দেখ হে, আমারও মত।।
আক্কল হইতে পয়দা হইল মাবুদ আল্লার।
বিশ্বাসে করিল পয়দা, রছুল উল্লার।।
মম আঁখি হইতে পয়দা, আসমান জমিন।
কর্ণ হইতে পয়দা হইছে, মুসলমানী দিন।।
আর পয়দা করিল যে, শুনিবারে যত।
সবদ, সাবদ, আওয়াজ ইত্যাদি যে কত।।
শরীরে করিল পয়দা, শক্ত আর নরম।
আর পয়দা করিয়াছে ঠাণ্ডা আর গরম।।
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় আর বদবয়।
আমি হইতে সব উত্পত্তি হাছন রাজা কয়।।
মরণ জীয়ন নাইরে আমার ভাবিয়া দেখ ভাই।
ঘর ভাঙ্গিয়া ঘর বানানি এই দেখিতে পাই।।
পাগল হইয়া হাছন রাজা কিসেতে কি কয়।
মরব মরব দেশের লোক মোর কথা যদি লয়।।
জিহ্বায় বানাইয়া আছে মিঠা আর তিতা।
জীবের মরণ নাই রে দেখ সর্বদাই জীতা।।
আপন চিনিলে দেখ খোদা চিনা যায়।
হাছন রাজায় আপন চিনিয়ে এই গান গায়।
রবীন্দ্রনাথ বলেন- এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আধিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত।
“রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।”
১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'হিবার্ট লেকচারে' রবীন্দ্রনাথ 'The Religion of Man' নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।
রবীন্দ্রযুগ থেকে আজ অবদি বাংলা গানে কত ভাঙ্গাচোড়া, বাঁক পরিবর্তন হলো। একতারা দোতারা বাঁশি সরিয়ে এলো আধুনিক সব বাধ্যযন্ত্র। এই আসা যাওয়ায় কত শিল্পীও এলেন গেলেন। তবু টিকে আছেন হাসন রাজা। দারুণভাবেই টিকে আছেন। আজো হাসন রাজার মরমীয়া সুর, বাণী সমানভাবে মুগ্ধ করছে শ্রোতাদের। এমনকি রক, ফিউশনের যুগের হেভি মেটালে মত্ত থাকা আধুনিকতম শ্রোতাটিকেও। অনেকটা তার গানের বাণীর মতোই- না জানি কি মন্ত্র করি যাদু করিলো।
হাসন রাজার গানের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসেব জানেন না কেউই। তবে ২০৬ টি গান সংকলিত আছে। ধারণা করা হয় এর বাইরেও অনেক গান রয়ে গেছে হাসন রাজার। গানের মতো হাসন রাজার স্মৃতিচিহ্নগুলোও সংরক্ষনের তেমন উগ্যোগ নেই।
এই মরমী সাধকের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর পরিবারের উদ্যোগে সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিউজিয়াম অব রাজাস। ২০০৬ সালের ৩০ জুন যাত্রা শুরু করে হাসন রাজার নাতি দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত এ যাদুঘরটি। এই যাদুঘরটিতে রয়েছে দেওয়ান হাসন রাজা ও তাঁর পুত্র দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীর ব্যবহার্য মূল্যবান জিনিসপত্র ও গানের পান্ডুলিপি। প্রবেশদ্বারে রয়েছে রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের একটি পিলার।
মিউজিয়ামটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ পবিত্র কোরআন শরীফের ছোট আকারের একটি কপি। কোরআন শরীফটির সাইজ পৌণে এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি। এছাড়া এখানের সংগ্রহশালায় রয়েছে হাসন রাজার ঘোড়ার বেল্ট, তার জন্মস্থান ও জমিদারী এলাকা থেকে সংগৃহিত ইট, রাজার পোষা কুড়া পাখি ও হাতির নামের তালিকা, তার ব্যবহৃত শ্বেত পাথর ও রূপার তৈরী তৈজসপত্র, হাসন রাজাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত পোশাক ও ছবির সিডি, তার স্ত্রীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র, দেওয়ান এমলিমুর রাজার ব্যবহৃত চেয়ার, তার স্ত্রীর ব্যবহার্য সোনার তারের ও রূপার তারের তৈরী পোশাক, তার ব্যবহৃত হিসাবের খাতা, বৃটিশ সরকার প্রদত্ত খান বাহাদুর উপাধির মেডেল ও হাসন রাজার গানের পান্ডুলিপি।
সংরক্ষিত আছে হাছন রাজার পরিবারের ছবি, শ্বেত পাথরের তৈজসপত্র, হাছন রাজার ব্যবহৃত খরম, হুক্কা, লোকবাদ্য যন্ত্র- ঢোলক, একতারা, তুম্বিরা, সারিন্দা, দোতারা ইত্যাদি।
হাসন রাজার বংশধরদের বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মন্ত্রীদের কাছে দেওয়ান তালেবুর রাজার লেখা চিঠি, তার ব্যবহৃত ঘড়ি, কলম, আংটি, দেওয়ান তওয়াবুর রাজা চৌধুরীর ব্যবহৃত ছুরি, দেওয়ান ছয়ফুর রাজা চৌধুরীর সংগৃহীত হাঙ্গরের দাঁত প্রভৃতি। এছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য এই যাদুঘরে হাসন রাজার বংশধরদের একটি তালিকা রয়েছে ।
সূত্র: সিলেট টুডে টোয়েন্ট ফোর